কারিকুলাম দিয়ে শিক্ষার মান নিশ্চিত করা যায় না

অধ্যাপক ড. মো. কামরুল হাসান মামুন
অধ্যাপক ড. মো. কামরুল হাসান মামুন  © সংগৃহীত

নতুন শিক্ষাক্রমের সমস্যা নিয়ে যতই আলোচনা হচ্ছে ততই দেখি কেউ কেউ উদ্দেশ্য প্রনোদিত হয়ে বুঝে না বুঝে জাপান বা ইউরোপের বাচ্চারা যে স্কুলে ঘর বানায়, রান্না বান্না করে ইত্যাদি নিয়ে লেখা বা ভিডিও শেয়ার করে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। অবশ্যই এইগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শুধু এইগুলো না আরো আছে যেমন পরিবেশকে চেনা জানার জন্য ছেলেমেয়েদের বনজঙ্গলে নিয়ে যাওয়া, রাস্তা পারাপার ইত্যাদিও শেখাতে হয়। অনেকদিন আগে আমি একটা ভিডিও শেয়ার করেছিলাম সেখানে জাপানি বাচ্চাদের বাস বা ট্রেনে সন্তান সম্ভবা মাকে, বৃদ্ধ মানুষ কিংবা প্রতিবন্ধীদের দেখলে সিট ছেড়ে দিতে এইসব শেখানো হচ্ছে। ঘরবাড়ি পরিষ্কার রাখা শেখানো হয়। আমাদের স্কুলগুলোতেও এইসব শেখানো হবে সেটাইতো চাই। চাই বলেই মাঝে মাঝেই এইসব নিয়ে লিখি। কিন্তু এখানে একটা ক্যাচ আছে। কোন ক্লাস বা কত বয়স পর্যন্ত বাচ্চাদের এইসব শেখাবেন। এর উত্তর আমাদের এক বাংলাদেশী মা (Samsunnahar Nora) যিনি জাপানে থাকেন এবং যিনি সেখানে একজন ডাক্তার তার লেখাতেই শুনুন। 

"আমার ছেলে জাপানে স্কুলে পড়ে। এখানে শৃংখলা, নীতি, নৈতিকতা, নিয়মানুবর্তিতা, সামাজিকতা ইত্যাদি শেখানো হয় primary school অর্থাৎ elementary level class six পর্যন্ত৷ আর এখানে পড়ার level অংক, বিজ্ঞান ইত্যাদি অনেক উন্নত এবং চ্যালেঞ্জিং। আমার class four এর বাচ্চার বিজ্ঞান আমাদের দেশের আগের nine, ten level এর। আর অংক তো এতভাবে শেখায়। আর যেগুলো সবাই ছবি দিচ্ছে সেগুলো তাদের পড়ার বাইরের অংশ, কেউ পড়ার অংশটা জানাচ্ছে না, আর ক্লাসে যে পরীক্ষা নেয়, সেগুলোতে marks দেয়, আর আমাদের দেখার জন্য বাসায় পাঠায়। আর ক্লাস seven থেকে শুধু পড়াশোনা, পরীক্ষা।" - বাংলাদেশী মা যিনি জাপানে থাকেন।

আমার স্ত্রী ইতালিয়ান। আমি নিজেও ইউরোপের ৩টি দেশে লম্বা সময় ধরে থেকেছি এবং এখনো প্রতি বছরই যাই। জাপানের মত ইউরোপেও ১২ বছর অর্থাৎ পঞ্চম এবং কিছুটা ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত রান্না-বান্না, মাটি নিয়ে খেলা, ঘর গোছানো, নৈতিক শিক্ষা ইত্যাদি অত্যন্ত সিরিয়াসলি দেওয়া হয়। এইসব শিক্ষার জন্য দরকার উন্নত মানের সৎ এবং শিশুদের বোঝে এমন মানুষদের শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ দেওয়া। এই বাচ্চাদের সকাল থেকে দুপুরে খাওয়া, বিকালে একটু ঘুমানো ইত্যাদিসহ প্রায় বিকাল ৪ থেকে ৫টা পর্যন্ত থাকে। এত দীর্ঘ সময় শিক্ষকদেরকে এদের দেখাশুনা করতে হয় তাই এই শিক্ষকদের উচ্চ বেতন দেওয়া হয়। স্কুলে child psychiatrist ও রাখা হয়। এই বয়সটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। শৃংখলা, নীতি, নৈতিকতা, নিয়মানুবর্তিতা, সামাজিকতা ইত্যাদি এই বয়সের বাচ্চাদের মননে মগজে চিন্তায় চেতনায় একদম গেঁথে দিতে হয় যা সারা জীবন থাকে।

তবে ক্লাস সেভেন থেকে সম্পূর্ণ সিরিয়াস বিষয় যেমন বিজ্ঞান গণিত সমাজবিজ্ঞান, ইতিহাস ইত্যাদি শেখানো হয়। এমনকি অষ্টম শ্রেণীতে উঠলে বিজ্ঞানকে ভাগ করে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও জীববিজ্ঞান আলাদা বিষয় হিসাবে। আর নবম শ্রেণী থেকেতো আরো সিরিয়াস। অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়তে গিয়েই কার কি ভালো লাগে সেই সম্মন্ধে ছাত্র বা ছাত্রী নিজে এবং তার মা-বাবা ও শিক্ষক অনেকটা বুঝে যায়। এই তিন গ্রুপ আলোচনার মাধ্যমে নবম-দশম শ্রেণীতে কি কি বিষয় নিবে তা ঠিক করবে। এই সময় সেখানে অল্প কয়েকটা সকলের জন্য বাধ্যতামূলক বিষয় যেমন ভাষা, ইতিহাস ইত্যাদি রেখে বাকি সব অপশনাল রাখতে হয়। ধর্ম শিক্ষা কেবল অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত থাকতে পারে। নবম শ্রেণীতে ধর্ম যদি রাখতেই হয় সেটা হতে পারে তুলনামূলক ধর্ম তত্ব যেন প্রত্যেকটা ছেলেমেয়ে কিছুটা অন্য ধর্ম সম্বন্ধেও জানে। কিন্তু পৃথিবীর প্রায় কোথাও নবম শ্রেণীতে ধর্ম বাধ্যতামূলক বিষয় হিসাবে রাখে না আমাদের দেশের ইংরেজি মাধ্যমেও নাই।

শেষ করব একজনের একটা মন্তব্য দিয়ে। যার মন্তব্যটি দিব তার নাম Hassan Saad Ifti! তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করে এখন আরেক বিশ্বখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিভার্সিটি অফ মেরিল্যান্ড-এ পোস্ট-ডক করছে। নিচে তার মন্তব্যটি বাংলায় অনুবাদ করে দিচ্ছি।

"নতুন শিক্ষাক্রমটি একটি পুরো প্রজন্ম এবং সম্ভবত পুরো জাতিকে ধ্বংস করার একটি রেসিপি। যখন পশ্চিমের প্রতিটি দেশ (এবং প্রাচ্যেরও) স্টেম শিক্ষার প্রসারের চেষ্টা করছে, তখন বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকরা ঠিক তার বিপরীত দিকে হাঁটছেন। এই যেন একটি বিয়োগান্ত নাটক। এই ধ্বংস লীলা থেকে উত্তরণের এক মাত্র উপায় হলো O/A লেভেলের পাঠ্যক্রমে চলে যাওয়া অর্থাৎ ইংরেজি মাধ্যমে চলে যাওয়া যা নিম্ন আয়ের পরিবারের শিক্ষার্থীদের জন্য শেষ পর্যন্ত বিজ্ঞান অধ্যয়ন করা অসম্ভব করে তুলবে। সেইজন্য যে কোন মূল্যে আমাদেরকে নতুন কারিকুলামকে বন্ধ করতে হবে।" - Hassan Saad Ifti

আমরা করেছি কি বাংলা মাধ্যমকে ইংরেজি বানিয়ে ভার্সন নাম দিয়ে আমাদের ছেলেমেয়েদের পড়িয়েছি। অথচ আমাদের উচিত ছিল ইংরেজি মাধ্যমকে বাংলা করে ভার্সন হিসাবে পড়ানো তাতে অনেকেই আর ইংরেজি মাধ্যমে যেত না। ইংরেজি মাধ্যমে গেলে লেখাপড়াটা সম্পূর্ণ হয় না। প্রতিটা শব্দের যেই একটা মেন্টাল ইমেজ হয় সেটা কেবল মাতৃ ভাষাতেই সম্ভব। তাই ইংরেজি মাধ্যমের যথাসাধ্য বাংলা মাধ্যম অথবা ইংরেজি কারিকুলামকে base ধরে বাংলা মাধ্যমকে তৈরী করা। এতে দুই মাধ্যমের বৈষম্য কমে যাবে এবং একই সাথে বিশ্বমানের শিক্ষা হবে। কিন্তু কারিকুলাম দিয়েতো আর শিক্ষার মান নিশ্চিত করা যায় না। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কারিকুলামতো অক্সফোর্ড, ক্যামব্রিজ, আমিআইটি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কারিকুলাম এর মতোই। কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কেন বিশ্বের তলানিতে? কারণ শিক্ষকদের মান, লেখাপড়া ও গবেষণার পরিবেশের মান, শিক্ষায় বরাদ্দের মান ইত্যাদি। আজকে যদি হার্ভার্ডের সকল শিক্ষক দ্বারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রতিস্থাপিত করা হয় হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে যাবে অনেকটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মত আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মান হার্ভার্ডের মানের কাছাকাছি।

লেখক: অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

(ফেসবুক থেকে নেওয়া)


সর্বশেষ সংবাদ