অ্যান্ড্রয়েড ফোনই সর্বনাশ করছে স্কুল শিক্ষার্থীদের

  © প্রতীকী ছবি

মহামারি করোনার আর্থিক ক্ষতি কাটিয়ে উঠা সময়ের ব্যাপার মাত্র। কিন্তু শিক্ষার্থীদের মনস্তাত্ত্বিক যে সীমাহীন ক্ষতি হয়েছে তা কাটিয়ে উঠা প্রায় অসম্ভব। একজন শিক্ষার্থীর জন্য তার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকদের সান্নিধ্য যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন এর সাথে সংশ্লিষ্ট্য সকলে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিমুখতার পাশাপাশি মাঠে-ঘাটে খেলাধুলাও করতে পারেনি শিক্ষার্থীরা। তদুপরি বাসায় নিয়মিত বাড়তি খাবার এবং মাত্রাতিরিক্ত বিশ্রামের ফলে তাদের শারীরিক বৃদ্ধি হয়েছে বেসামাল। ফলে দৈহিক আকার-আকৃতির সাথে মনস্তাত্ত্বিক বিকাশের বিস্তর অমিল লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

পঞ্চম-ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে অথচ দেখতে নবম-দশম শ্রেণির বাচ্চার মত মনে হয়। যে কেউ দেখলে তাই মনে করবেন। শারীরিক এই অস্বাভাবিক বৃদ্ধিটা তেমন কোন সমস্যা হতো না, যদি এর সাথে সাথে বাচ্চাদের মন ও আত্মার বিকাশ সমান্তরাল হতো। কিন্তু তা একদম হয়নি। অথচ মানুষের দেহ, মন ও আত্মার সঠিক বিকাশকেই শিক্ষা বলা হয়। সরকারি নির্দেশনা ও শিক্ষার্থী ধরে রাখার কৌশল হিসেবে যারা অনলাইন ক্লাসের আয়োজন করেছিলেন তা-ও ছিল নামকাওয়াস্তে। সারা দেশের মোট শিক্ষার্থীর হয়তো পনেরো-বিশ শতাংশ অনলাইন ক্লাসের আওতায় এসেছিলো। তেমন কোন পড়াশোনা হয়নি, উল্লেখযোগ্য কিছু শেখেনি। উপরন্তু অনলাইন ক্লাসের নাম করে তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিলো অ্যান্ড্রয়েড ফোন।

আর এই ফোনই তাদের সর্বশেষ ক্ষতিটুকু করেছে। তাদের  নৈতিক স্খলন ঘটেছে। ইন্টারনেট ব্যবহারের অবারিত সুযোগ তাদের অনেককে করেছে ইউটিউব এডিকটেড, অনেকে হয়েছে পর্নো এডিকটেড। এমনকি অনলাইন অনেককে 'কিশোর গ্যাং' হতে সাহায্য করেছে। অতিরিক্ত ফেইসবুক, ইউটিউব, ইমো এবং অন্যান্য সামাজিক-অসামাজিক সাইডগুলোতে সারাক্ষণ ডুবে থাকার ফলে তাদের স্নায়ু সিস্টেমে অস্বাভাবিক পরিবর্তন এসেছে। কথাবার্তা ও মেজাজে এসেছে খিটখিটে ভাব। রুক্ষতা, কর্কষতা, উগ্রতা ইত্যাদি সেখানে বাসা বেঁধেছে। দৈনন্দিন জীবনেও এসেছে পরিবর্তন। নিয়মিত রাত জাগা, একা একা থাকতে বেশী স্বাচ্ছন্দ বোধ করা, খাবারে অরুচি-বিস্বাদ, সবসময় উত্তেজিত ও মারমার-কাটকাট মনোভাব সেখানে স্থান করে নিয়েছে।

তাদের এই ভয়ঙ্কর পরিবর্তন পরিবার বা নিকটজনদের দৃষ্টিতে কতটা ধরা পড়েছে জানি না, কিন্তু আমরা যারা শিক্ষার সাথে জড়িত তারা প্রতিনিয়ত এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতি মোকাবেলা করে চলেছি। বাচ্চারা ক্লাসে মনযোগী হচ্ছে না, হোম ওয়ার্ক করে আসছে না, বন্ধুদের মধ্যে গ্রুপিং হয়ে গেছে, অল্পতেই একজন আরেকজনকে অশ্লীল বাক্য বানে জর্জরিত করছে, সামন্যতেই একে অন্যকে শারীরিকভাবে আঘাত পর্যন্ত করছে।

এহেন নাজুক পরিস্থিতিতে বাড়তি বিপত্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছেন স্বয়ং অভিভাবক মহলের একটি অংশ। তারা শিক্ষকদের এই বাস্তব উপলব্ধির সাথে একমত হচ্ছেন না! তারা তাদের বাচ্চাদের নিষ্পাপ, ইনোসেন্ট এবং অন্যদের চেয়ে ভালো বলে সাফাই গাইছেন। শিক্ষকগণ কোন ধরণের শাসন-বারণে গেলে উল্টো তারা শিক্ষকদের উপর নাখোশ হচ্ছেন! ক্ষেত্র বিশেষ হচ্ছেন চড়াও। শিক্ষকদের কাছ থেকে জবাবদিহি নিতে চেষ্টা করছেন। এমতাবস্থায় শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকদের সমন্বয়ে যে সুন্দর একটি শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা হওয়ার কথা ছিল তা আর সম্ভব হয়ে উঠছে না। এই তিন শ্রেণির মধ্যে ব্যবধান বৃদ্ধিতে আল্টিমেট ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম। যার প্রভাবটা হবে আরো মারাত্মক। চার-পাঁচ বছরের মধ্যেই সম্মানিত অভিভাবকবৃন্দ তা স্বীকার করে নিবেন। কিন্তু সে বোধোদয় হবে অনেক দেরিতে। একান্তে চোখের পানিতে বুক ভাসানো ছাড়া কিছু করার থাকবে না তখন।

ততদিনে আদরের সন্তান বিপথগামীদের তালিকায় চলে গিয়েছে! স্কুল-কলেজ ও পড়ালেখার সাথে তার কোন সম্পর্ক নাই! অশ্লীলতার অথৈ সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে সে। কোন একটা ‘গ্যাং এর সাথে জড়িয়ে সামাজিকতা ও নৈতিকতা বিবর্জিত সকল কাজে জড়িয়ে পড়েছে। বড়দের শ্রদ্ধা করা ও ছোটদের স্নেহ করার স্বাভাবিক প্রবণতা তার অভিধান থেকে মুছে গেছে। পিতা-মাতা ও শিক্ষকদের সম্মান করার শাশ্বত আদবও সে ভুলে গেছে। কী ভয়ঙ্কর হতে পারে সে দৃশ্য! নিশ্চয়ই এমন দৃশ্য কারও জন্যই কাম্য হতে পারে না।

একারনে আর সময় নষ্ট না করে প্রত্যেক অভিভাবকের উচিত হবে বাচ্চাদের পড়াশোনা বিষয়ে আরো মনযোগী হওয়া। বাচ্চার স্কুলে মাঝে-মধ্যে আসা, শিক্ষকদের অভিমত জানা এবং সে অনুযায়ী বাচ্চাদের প্রতি তদারকি বৃদ্ধি করা। শিক্ষকদের হাতে বাচ্চাদের তুলে দিতে হবে। শিক্ষকদেরকে আদরের পাশাপাশি মৃদু শাসনেরও অনুমতি দিয়ে রাখতে হবে। পাশাপাশি নিজেরাও তীক্ষ্ণ নজরে সবকিছু খেয়াল রাখতে হবে। মনে রাখবেন, বাচ্চার অতিরিক্ত প্রশংসা ও আদর আপনার সন্তানের ভবিষ্যত বিপদের কারণ হতে পারে। শিক্ষকের বিরুদ্ধে বাচ্চা কর্তৃক কোন অভিযোগ শোনামাত্র আমলে নিয়ে সেন্টিমেন্টাল হয়ে যাবেন না। বাচ্চার সব কথা বিশ্বাস করার কোন কারণ নাই। তবে অবশ্যই স্কুলে এসে শালীনতার সাথে, ভদ্রতা বজায় রেখে প্রকৃত ঘটনা জানার চেষ্টা করার অধিকার আপনার আছে।

নিয়মিত শ্রেণি শিক্ষক, বিষয় শিক্ষক ও প্রধান শিক্ষকের সাথে যোগাযোগ আপনার সন্তানের ভবিষ্যতকে উজ্জ্বল করবে। শুধু বাচ্চার কাছ থেকে শোনে একপেশে ধারণা নিয়ে শিক্ষকের বিরুদ্ধে কটু মন্তব্য বা কোন সিন ক্রিয়েট করলে তা কারো জন্যেই কল্যাণকর হবে না। কোন কোন অভিভাবককে বাচ্চার কথার প্রেক্ষিতে শিক্ষকের সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণ করতে দেখা যায়। যা অত্যন্ত অন্যায় ও গর্হিত কাজ। কেউ কেউ রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব খাটিয়ে শিক্ষককে হুমকি-ধামকি দিয়ে থাকেন। তাদের ধারণা এর মাধ্যমে তাদের বাচ্চার প্রতি শিক্ষকদের যত্ন ও মনযোগ বাড়বে। কিন্তু বাচ্চার সামনে শিক্ষকের অপমান কোনদিন ঐ বাচ্চার জন্য কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না। এ ধরণের অনাকাঙ্খিত আচরণ শুধু সংশ্লিষ্ট্য একজন শিক্ষকের মনেই রেখাপাত করে না, বরং প্রতিষ্ঠানের সকল শিক্ষককে ব্যাথাতুর ও মর্মাহত করে। যা পরবর্তীতে ঐ বাচ্চার জন্য অমঙ্গলের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

তাই, আপনার বাচ্চার কথা-কাজ সব সঠিক, আর শিক্ষক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মানেই সমস্যা- এমন চিন্তা কখনই করবেন না। বরং একজন সচেতন অভিভাবক হিসেবে আপনি গভীরদৃষ্টিতে আপনার প্রাণপ্রিয় সন্তানের আচরণ খেয়াল করুন। তাদের মধ্যে অস্বাভাবিক কোন কিছু পাচ্ছেন কি? তারা কোন কিছু লুকাতে চাচ্ছে কি? ভোরে ও সন্ধ্যার পর পড়ার টেবিলে বসছে তো? বাহিরে অস্বাভাবিক আড্ডা দিচ্ছে না তো? দরজা বন্ধ করে ও রাত জেগে জেগে মোবাইল দেখছে কি? বাথরুমে মোবাইল নিয়ে ঢুকছে না তো? সে কোণ ধরণের বন্ধুদের সাথে মিশছে? তারা কি বখাটে টাইপের? আপনার বাচ্চা সে-রকম কিছু খাচ্ছে বা সেবন করছে না তো? নামাজসহ ধর্মীয় বিষয়গুলোতে তার আগ্রহ বাড়ছে না কমছে?

এই বিষয়গুলোতে আপনি যখন ইতিবাচক ধারণা পাবেন তখন আপনি কিছুটা হলেও নিশ্চিন্ত হতে পারেন। অন্যথায় নেতিবাচক কিছু ধরা পড়লে আপনি তাৎক্ষণিক সাবধান হয়ে যান। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা শিক্ষক বা অন্য কাউকে দোষারোপ করবেন না। অথবা মা ও বাবা নিজেরা একে অপরকে দোষ দিবেন না। বরং মনে করবেন, সামগ্রীকভাবে এটা আমাদের দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যর্থতার কারণেই হয়েছে। দেশের শিক্ষা ব্যাবস্থা এবং সিলেবাস-কারিক্যুলামও এর জন্য দায়ী। তাই সংশোধনের জন্য কাউকে দোষ না দিয়ে নিজেই চিকিৎসা শুরু করে দিন। তবে ভুলেও বাচ্চাকে শারীরিকভাবে আঘাত করতে যাবেন না। এমনকি আপনি যে তার ব্যাপারে নেতিবাচক কিছু জেনেছেন তা-ও তাকে বুঝতে দিবেন না।

উদাহরণ স্বরূপ, একজন ক্যান্সারের রোগীর মৃত্যু অনেকটা নিশ্চিত জেনেও ডাক্তার চিকিৎসা চালিয়ে যান। ডাক্তার রোগীর আত্মীয়-স্বজনকে সবকিছু জানালেও রোগীকে কিছুই জানতে দেন না। ঠিক তেমনি, বিপথগামী কোন সন্তান ও শিক্ষার্থীর ব্যাপারেও শিক্ষক এবং অভিভাবকগণ একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসকের ভূমিকা পালন করবেন। বাচ্চার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে বাসায় এবং স্কুলে সমন্বিত চিকিৎসা কার্যক্রম চালাতে হবে। বাসায় বাবা-মা ও বড় ভাই বোন একসাথে নিয়মিত বসে পরামর্শ করবেন। তার প্রতি যত্ন, সহমর্মিতা, আন্তরিকতা বাড়াবেন। তাকে ‘কোয়ালিটি টাইম’ দিবেন। তার মাথায় হাত দিবেন, একান্তে ছোট কালের কিছু মধুর স্মৃতি স্মরণ করিয়ে দিবেন। কপালে চুমু দিবেন। তার ব্যাপারে আপনারা যে এতদিন কিছুটা গাফেল ছিলেন এটাও তাকে বলে দিবেন।

এ বিষয়ে পারিবারিক আসর, বৈঠক ও সফর কাঙ্খিত ফলাফল বয়ে আনতে পারে। পারিবারিক ট্যুর ও পিকনিকের আয়োজন করা, বাসা-বাড়ির আঙ্গিনা, কোন খেলার মাঠে বা ছাদে পরিবারের সদস্যরা দুটো টিমে বিভক্ত হয়ে খেলাধূলার আয়োজন হতে পারে। কোথাও জায়গা না পেলে ঘরের ভেতরেই ইনডোর গেমের আয়োজন হতে পারে। এতে পারস্পরিক দুরত্ব কেটে গিয়ে সম্পর্ক গাঢ় হবে। শেয়ারিং বাড়বে। মনে রাতে হবে, বাচ্চারা যেন কখনই একাকীত্ব অনুভব না করে। একাকীত্ব থেকেই তারা ভিন্ন দিকে পা বাড়ায়। বিশেষত, তিন বেলা পারলে খুব ভালো, না পারলে অন্তত দিনে একবেলা হলেও পরিবারের সবাই একসাথে এক টেবিলে বসে খাবারের আয়োজন করতে হবে। খাবার টেবিলে বসে বাবা-মা তাদের সন্তানদের সাথে খোলামেলা আলাপ করতে পারেন। যে পরিবারে সদস্যদের মাঝে সু-সম্পর্ক বিরাজমান এবং কথা বলার ফ্রি-ফ্রাঙ্ক পরিবেশ আছে সে পরিবারের সন্তানদের বিপথে পা বাড়ানোর সম্ভাবনা অন্যদের থেকে কম।

পারিবারিক প্রচেষ্টার পাশাপাশি শিক্ষকদের সাথেও নিয়মিত বসতে হবে। শিক্ষকগণও এই বাচ্চাদেরকে নিজেদের সন্তান মনে করে সংশোধনের আন্তরিক ও ধারাবাহিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবেন। এভাবে বাসা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একযোগে তৎপরতা চালালে আশা করা যায় আপনার আদরের সন্তান আবার ফিরে আসবে, পড়ালেখায় মনযোগী হবে। দেশের প্রতিটি শিশু সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে  সুনাগরিক ও কর্তব্যনিষ্ঠ হয়ে বেড়ে উঠুক; অনৈকিতা ও উশৃংখলা তাদেরকে স্পর্শ না করুক এই আমাদের প্রত্যাশা।

লেখকঃ প্রধান শিক্ষক, রমনা মডেল স্কুল


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence