সরকারি চাকরিতে তিনটি জিনিস প্রয়োজন- সততা, মমতা ও দক্ষতা

সরকারি চাকরি
সরকারি চাকরি  © প্রতীকী ছবি
পিএসসির প্রতি তরুণ ও চাকরিপ্রার্থীদের যে আস্থা তৈরি হয়েছে সেটি ধরে রাখতে হবে। পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাদিক বিদায়ের আগে আমাকে একটা সাক্ষাতকার দেন। সাক্ষাতকারের শুরুতেই এই কথাটা ছিল। আস্থা ধরে রাখার সেই আহবানটা ছিলো পিএসসির প্রতি। কথাটা যে কতেটা জরুরি ছিল সেটা আশা করি তরুণ প্রজন্ম আজকে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে।
 
২০১৬ সালের ২ মে বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে যোগ দেন মোহাম্মদ সাদিক। এর আগে ২০১৪ সালের ৩ নভেম্বর থেকে কমিশনের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন তিনি। ২০২০ সালের ১৬ সেপ্টম্বরে চেয়ারম্যান হিসেবে তার শেষ কর্মদিবস ছিল। সেইদিন আমি তাঁর দীর্ঘ সাক্ষাতকারটা নিয়েছিলাম। ২০২০ সালের ১৭ সেপ্টম্বর সাক্ষাতকারটা নিয়েছিলাম। সেই সাক্ষাতকারটা আজ ভীষণ প্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছে।
 
আমি প্রশ্ন করেছিলাম পিএসসির চেয়ারম্যান হিসেবে সবচেয়ে বড় অর্জন কী? মোহাম্মদ সাদিক আমাকে বলেছিলেন, ‘পিএসসির প্রতি তরুণ ও চাকরিপ্রার্থীদের আস্থা অনেক বেড়েছে। গ্রামের একজন কৃষকের সন্তানও মনে করেন, ভালো করে লেখাপড়া করলে কোনো তদবির ছাড়া চাকরি হবে। এই যে আস্থা, এটি একটি বিরাট বিষয়। আমি মনে করি, আমার সময়ে সেই আস্থার জায়গাটা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছি। এই কাজে আমার সহকর্মী থেকে শুরু করে সবাই আমাকে সহযোগিতা করেছেন। বিশেষ করে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে যারা ছিলেন তারা কোনদিন তদবির করেননি।’
 
আমার দীর্ঘ দুই দশকের সাংবাদিকতা জীবনের অভিজ্ঞতায় বলতে পারি পিএসসির প্রতি এতো আস্থা নিকট অতীতে আর কখনোই ছিলো না যেটা সাদিক স্যারের আমলে তৈরি হয়েছে। এই দেশের সব প্রতিষ্ঠান যেখানে ধ্বংস হয়েছে সেখানে সাদিক স্যার পিএসসিকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন।
 
আমি আপনাদের সময়টা মনে করিয়ে দেই। দেশে তখন সব পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে বিশেষ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয় তখন যতো পরীক্ষা নিতো তার বেশিরভাগের প্রশ্ন ফাঁস হতো। আর সেই সময় বিসিএসের প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধ হয়ে যায়। কীভাবে সেটা সম্ভব হলো জানতে চাইলে মোহাম্মদ সাদিক বলেছিলেন, ‘আমি চেয়ারম্যান হিসেবে যোগ দেওয়ার পর বিসিএস পরীক্ষার কোনো প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি। এমনকি তৈরি হয়নি বিতর্কিত কোনো প্রশ্নপত্র।’
 
কীভাবে এটি সম্ভব করলেন জানতে চাইলে বলেছিলেন, ‘একটি পরীক্ষার জন্য আমরা আট-দশ সেট প্রশ্নপত্রও করেছি। পরীক্ষার আগে লটারি করে ঠিক করা হয়েছে কোন প্রশ্নে পরীক্ষা হবে। এরপর সেটা সব বিভাগীয় কমিশনারকে জানানো হয়েছে। ফলে, কোন প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা হবে আগে কারোরই জানার সুযোগ ছিল না। এমনকি পিএসসিরও কারোও না। প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধ এটি বড় সাফল্য ছিল।’
 
মোহাম্মদ সাদিক বলেন, ‘এমন এক সময়ে আমরা সেটা করেছি যখন দেশের নানা পরীক্ষায় নিয়মিত প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। কিন্তু, বিসিএসের প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি। প্রশ্নকারক, মডারেটর, পরীক্ষক, পরিদর্শক, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, ম্যাজিস্ট্রেটসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে আলাদা আলাদা বৈঠক করে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়া হতো। সবার সহযোগিতায় এটা সম্ভব হয়েছে। এছাড়া, মৌখিক পরীক্ষার ক্ষেত্রেও ছিল সতর্কতা। পরীক্ষার দিন সকালে বোর্ড নির্ধারণ করা হতো। ফলে, কে কোন বোর্ডে পরীক্ষা দেবে তা জানার সুযোগ ছিল না’।
 
 
আমি নিজে সেই সময়ের স্বাক্ষী। তবে বিসিএসের সময় কিছুটা কমলেও দীর্ঘসূত্রতা সাদিক স্যারের সময়েও ছিলো। আমি তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলাম বিসিএসের দীর্ঘসূত্রতা কিন্তু পুরোপুরি কমেনি। কেন? তিনি বলেছিলেন, ‘আমার সময়ে প্রতি বছর বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি হয়েছে। দীর্ঘসূত্রতা কমানোর নানা উদ্যোগ ছিল। এতোগুলো ক্যাডারের পরীক্ষা আমাদের নিতে হয়, যা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। এক শিক্ষা ক্যাডারেই অসংখ্য ধরনের পদ। ফলে, সময় কমিয়ে আনাটা চ্যালেঞ্জ ছিল। আর আমরা মূলত মার্চ পর্যন্ত কাজ করতে পেরেছি। করোনা না আসলে সবকিছু আরও এগিয়ে যেত। অনেক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারিনি। সামনের দিনগুলোতেও দীর্ঘসূত্রতা কমানোই বড় চ্যালেঞ্জ।’
 
নন ক্যাডারের নিয়োগটিকে বিশেষ সাফল্য হিসেবে উল্লেখ করে পিএসসির চেয়ারম্যান বলেছিলেন, ‘এক বিসিএস থেকে যখন আমরা বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে নিয়োগ দিলাম, যখন হাজার হাজার ছেলেমেয়ে নিয়োগ পেল সবার আগ্রহ আরও বাড়লো। তরুণরা মনে করলো, লেখাপড়া করে বিসিএস উত্তীর্ণ হলে একটি চাকরি হবেই। আর এর ফলে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় যোগ্য কর্মকর্তা পেয়েছে। এটা অব্যাহত রাখতে হবে।’
 
আফসোস নন ক্যাডারের সেই নিয়োগ নিয়ে আজ যেমন নানা প্রশ্ন তৈরি হয়েছে তেমনি বিদায়ী চেয়ারম্যান যে আস্থা ধরে রাখার কথা বলেছিলেন সেই আস্থা নিয়েও নতুন করে জরিপ হতে পারে। পিএসসির প্রতি অনুরোধ গত ১৪ বছরে প্রতিষ্ঠানটির প্রতি যে আস্থা তৈরি হয়েছে সেই আস্থা যেন সামনের দিনে না কমে আরো বাড়ে।
 
আমি অনেক প্রার্থীকে বলেছিলাম, সাদিক স্যার চলে গেলেন বুঝবেন তিনি কী ছিলেন। পিএসসিকে যেই মানে নিয়ে গেছেন সেটা ধরে রাখাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। আর সেটাই আমরা এখন দেখছি। যাই হোক, শেষ করি সাক্ষাতকারের সবচেয়ে প্রিয় অংশটা দিয়ে। মোহাম্মদ সাদিক বলেছিলেন, ‘সরকারি চাকরিতে তিনটি জিনিসের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। সততা, মমতা এবং দক্ষতা। প্রথম দুটি থাকলে দক্ষতা অর্জন করে ফেলা যায়। কিন্তু যদি সততা ও মমতা না থাকে সেই দক্ষতা খুব বেশি কাজে লাগে না।’
 
পিএসসি থেকে শুরু করে এই দেশের যারা সরকারি চাকুরি করেন, যারা নীতি নির্ধারক এমনকি প্রতিটা মানুষকে সেই কথাটাই মনে করিয়ে দেই, চাকুরিতে তিনটি জিনিসের বেশি প্রয়োজন। সততা, মমতা এবং দক্ষতা। প্রথম দুটি থাকলে দক্ষতা অর্জন করে ফেলা যায়। কিন্তু যদি সততা ও মমতা না থাকে সেই দক্ষতা খুব বেশি কাজে লাগে না। কাজেই আপনারা আগে সৎ হন, মানুষের প্রতি মমতা দেখান এবং এরারে দক্ষ হন। সবাইকে শুভ সকাল। শুভ সকাল বাংলাদেশ।
 
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী
 
(ফেসবুক থেকে নেওয়া)

সর্বশেষ সংবাদ