স্কুল ছেড়ে আবার ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুরা

স্কুল ছেড়ে আবার ঝুঁকিপূর্ণ করছে শিশুরা
স্কুল ছেড়ে আবার ঝুঁকিপূর্ণ করছে শিশুরা  © সংগৃহীত

করোনা পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের দরিদ্র ও হতদরিদ্র পরিবারের শিশুরা স্কুল ছেড়ে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে ফিরে যাচ্ছে। বেসরকারি একটি সংস্থার জরিপে এমন চিত্র উঠে আসলেও সারাদেশে তাদের মোট সংখ্যা কত তার পরিসংখ্যান নেই কারো কাছে।

বাংলাদেশে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন নিয়মিত ৩১ হাজার শিশুকে মনিটরিং করে। এর মধ্যে প্রায় আট হাজার শিশুকে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থেকে সরিয়ে স্কুলে নিয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু প্রায় তিন হাজার শিশু আবারও স্কুল ছেড়ে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে ফিরে গেছে।

সংস্থাটির শিশু সুরক্ষা বিভাগের সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার রাফেজা শাহীন বলেন, আমাদের পক্ষেতো সারাদেশে সার্ভে করা কঠিন। তবে আমরা আটটি জেলায় সার্ভে করে দেখেছি, ৭৪ হাজার শিশু স্কুলে না গিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কাজের সঙ্গে যুক্ত। আমাদের প্রতিষ্ঠান থেকে ৩১ হাজার শিশুকে আমরা নিয়মিত মনিটরিং করি।

পড়ুন: শিশুশ্রম নিরসনে সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ: রাষ্ট্রপতি

তিনি বলেন, এর মধ্যে সাত হাজার ৮০০ জন শিশুকে ঝুঁকিপূর্ণ পেশা থেকে সরিয়ে স্কুলে নিয়েছিলাম। করোনা পরিস্থিতিতে তাদের আর স্কুলে রাখা যায়নি। সর্বশেষ গত এপ্রিলে আমরা দেখেছি, এর মধ্যে প্রায় তিন হাজার শিশু আবারও পুরনো কাজে ফিরে গেছে।

এই শিশুদের স্কুলে ফিরিয়ে নিতে সরকারি কোন উদ্যোগ আছে কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, সরকার বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু সেগুলো খুব একটা কাজে আসছে না। যেমন ধরেন সরকার ২৮৪ কোটি টাকা ব্যায়ে একটি প্রকল্প নিয়েছিল। যেখানে এই সব শিশুদের অভিভাবকদের প্রণোদনা দেওয়ার কথা। সেই প্রকল্প খুব একটা কাজ করেনি।

সেভ দ্য চিলড্রেন বাংলাদেশের পরিচালক রিফাত বিন সাত্তার বলেন, সরকার উদ্যোগ নিচ্ছে। কিন্তু আসল সমস্যা তো অর্থিক অস্বচ্ছলতা। এই করোনা পরিস্থিতিতে দরিদ্র আরো দরিদ্র হয়েছে। হতদরিদ্র একটি শ্রেণী তৈরী হয়েছে। এখন পরিবারে স্বচ্ছলতা না থাকলে শিশুকে কিভাবে স্কুলে পাঠাবে? ফলে তারা শিশুকেও কোন না কোন কাজে লাগিয়ে দিচ্ছে। এই কাজটা কিন্তু সাধারণ কোন কাজ নয়, ঝুঁকিপূর্ণ কাজ।

কী পরিমান শিশু এখন স্কুলের বাইরে? জানতে চাইলে তিনি বলেন, আসলে আনুষ্ঠানিক খাতেতো শিশুশ্রম বন্ধ। শিশুরা কাজ করে অনানুষ্ঠানিক খাতে। সেখানে খুব একটা হিসাব সরকার রাখে না। ফলে আমরাও খুব একটা হিসাব জানতে পারি না। এই হিসাবটা না পাওয়া গেলে তাদের এখান থেকে বের করে আনাও কঠিন।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৩ সালের জরিপে দেখা যায়, শিশুশ্রমে নিযুক্ত শিশুর সংখ্যা ১৩ লাখ। এটাই সরকারের সবশেষ জরিপ। চলতি বছর শ্রম মন্ত্রণালয়ের লক্ষ্য মাত্র এক লাখ শিশুকে শ্রমমুক্ত করা। ফলে নির্ধারিত সময়ে এই বিশালসংখ্যক শিশুকে শ্রম থেকে ফেরানো কঠিন হয়ে পড়বে।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) ও ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী শিশুশ্রমে নিয়োজিত শিশুর সংখ্যা বেড়ে ১৬ কোটিতে পৌঁছেছে। যা গত চার বছরে বেড়েছে ৮৪ লাখ। কোভিড-১৯ এর প্রভাবের কারণে আরো কয়েক লাখ শিশু ঝুঁকিতে রয়েছে। মহামারির কারণে বিশ্বব্যাপী অতিরিক্ত ৯০ লাখ শিশু ঝুঁকির মুখে বলে সতর্ক করেছে আইএলও ও ইউনিসেফ। ১২ জুন বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে এমন শঙ্কার কথা বলা হয়েছে।

শিশুশ্রম নিরসনে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা খসড়া কমিটির আহ্বায়ক এবং বেসরকারি সংস্থা ইনসিডিন বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক এ কে এম মাসুদ আলী বলেন, আমরা একটা খসড়া ইতোমধ্যে তৈরি করেছি। এখন সেটা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের অপেক্ষায়।

তিনি বলেন, সবশেষ শিশুশ্রম জরিপের সঙ্গে আগের জরিপের তুলনা করলে দেখা যায়, শিশুশ্রম অর্ধেকে নামিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। তবে সে তুলনায় ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম কমার হার অনেক কম। মাত্র ১০ হাজার শিশুকে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম থেকে সরানো গেছে।

মাসুদ আলী আরও বলেন, আমরা মনে করি, এই শিশুদের পরিবারকে সহায়তা না করা হলে তাদের এই কাজ থেকে সরানো কঠিন। পাশাপাশি শিশুকে স্কুলে পাঠালে পরিবারের সদস্যদেরও কিছু প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে হবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমানে করোনা মহামারিতে অর্থনৈতিক ও শ্রম বাজারে ধাক্কা, মানুষের জীবিকার ওপর বিরাট প্রভাব ফেলছে। দুর্ভাগ্যবশত এই সংকট শিশুদের শিশুশ্রমের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। দারিদ্রের কারণে শিশুদের নামতে হচ্ছে কাজে। করোনা মহামারিতে স্কুল বন্ধ থাকায় নিম্ন আয়ের পরিবারগুলো তাদের সন্তাদের কাজে পাঠাতে বাধ্য হচ্ছে। কারণ অনেক অভিভাবকেরই মোবাইল ডাটা কিনে সন্তানকে অনলাইনে ক্লাস করানোর সক্ষমতা নেই।

জাতিসংঘ ২০২১ সালকে ‘আন্তর্জাতিক শিশুশ্রম নিরসন বর্ষ’ হিসেবে ঘোষণা করলেও বাংলাদেশে তা বাস্তবায়ন অনিশ্চিত। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব কে এম আব্দুস সালাম জানান, শিশুশ্রমমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে কাজ করছে সরকার।

২০২৫ সালের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ ৩৮টি খাত শিশুশ্রমমুক্ত করার লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে আটটি খাত থেকে শিশুশ্রম নিরসন করা হয়েছে। এ ছাড়া ২০২১ সালের মধ্যে এক লাখ শিশুর শিশুশ্রম নিরসন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই প্রকল্প শিগগিরই শুরু হবে বলে তিনি আশা করেন। [সূত্র: ডয়চে ভেলে]


সর্বশেষ সংবাদ