সংকটে উদ্বেগ বেড়েছে প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের, কমেছে উপস্থিতি

মতবিনিময় সভায় বক্তারা
মতবিনিময় সভায় বক্তারা  © টিডিসি ফটো

ছাত্র-জনতার আন্দোলন ও পরবর্তী সময়ের ঘটনাগুলোয় দেশের প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের মাঝে উদ্বেগ বেড়েছে। এর প্রভাব তাদের আচার-আচরণে প্রকাশ পাচ্ছে। সে জন্য প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নে সম্মিলিত উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলছেন বিশিষ্টজনেরা।

রবিবার (২০ অক্টোবর) রাজধানীর কৃষিবিদ ইন্সটিটিউটে ‘প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়ন: আমাদের করণীয়’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। ‘গণসাক্ষরতা অভিযান' এবং ব্র্যাক শিক্ষা উন্নয়ন ইন্সটিটিউট এ মতবিনিময় সভার আয়োজন করে।

মতবিনিময় সভায় বক্তারা বলেন, শিক্ষার্থীদের জন্য আমাদের সবার সম্মিলিত কাজ করতে হবে। শিক্ষার্থীদের উদ্বেগ দূর করতে হবে এবং তাদের সুন্দর আগামী নিশ্চিতে তাদের মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে হবে।

সভায় জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ প্রণয়ন কমিটির সদস্য এবং শিক্ষক নেতা অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ বলেন, কোভিডের আগে যে শিক্ষাক্রম সংস্কার করা হয়েছে, তাতে শিক্ষার অংশীজনদের মতামত নেওয়া হয়নি। এর প্রভাব শিক্ষার্থীদের ওপর প্রভাব পড়েছে। শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখার উদ্যোগ হিসেবে মতবিনিময় আয়োজনকে সাধুবাদ জানান তিনি।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের আগামীর দিনগুলোতে যেন মানসিক স্বাস্থ্য নিশ্চিত করা যায়, সে জন্য কাজ করতে হবে। তিনি শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক এবং শিক্ষার অংশীজনদের নিয়ে শিক্ষায় করণীয় ঠিক করার আহ্বানও জানান।

সভার শুরুতে জানানো হয়েছে, সাম্প্রতিক আন্দোলন ও সহিংসতা শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর গুরুতর প্রভাব ফেলেছে। পাশাপাশি, দেশের নানা এলাকায় আকস্মিক বন্যায় শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে একধরনের ‘ট্রমা’ দেখা দিয়েছে।

সংশ্লিষ্ট অংশীজনের মতামত গ্রহণের লক্ষ্যে প্রশ্নপত্রের মাধ্যমে নির্বাচিত কিছু এলাকায় প্রতিষ্ঠান এবং সংগঠনভিত্তিক মতামত জরিপ গ্রহণ করেছেন গবেষণা দলের সদস্যরা। এর মধ্যে সারা দেশ থেকে দেড় শতাধিক সংগঠন ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান-প্রতিনিধির মতামত গ্রহণ, বিভাগীয় পর্যায়ে ১টি মতবিনিময় সভা ও জেলা পর্যায়ে ৬টি এফজিডি এবং জাতীয় পর্যায়ে মতবিনিময় সভা রাখা হয়েছে।

সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতা বা সহিংসতা এবং প্রলয়ংকরী বন্যার কারণে বিগত এক মাসে ঘটে যাওয়া এমন ঘটনা যা শিশুদের মনে প্রভাব ফেলেছে। এর কারণ হিসেবে গবেষণা বলছে, শিক্ষার্থীরা স্কুল ছেড়ে রাস্তায় নামা, মিছিল, সহিংসতা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, মারামারি দেখা, রাজপথে শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি ছোড়া দেখা বা শোনা এবং স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়া ও কারফিউ ও অবরোধ কর্মসূচির কারণে ঘরে থাকার ফলে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলেছে।

আরও পড়ুন: সরাসরি নিয়োগের দাবি ১-১২তম নিবন্ধনধারীদের
 
প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের পরিবর্তনের ফলে স্কুলে না যাওয়ার প্রবণতা ও পড়ালেখার প্রতি অনীহা, ভয়-ভীতিতে থাকা, ঘুমের সমস্যা হওয়া ও দুঃস্বপ্ন দেখা, বিষণ্নতা ও হতাশাগ্রস্ত হওয়া, মোবাইল ফোনে আসক্ত হওয়া, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া, উচ্ছৃঙ্খলতা দেখা দেওয়া, সহিংস আচরণ করা, পাঠ্যবই বা কারিকুলামে পরিবর্তন নিয়ে ভীতি-উদ্বেগ কাজ করার মতো প্রভাব দেখা গেছে।

এ ছাড়া শিশুদের মধ্যে বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে ছবি ও খবর দেখে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হওয়া, শিশুসুলভ চঞ্চলতা হারিয়ে যাওয়া বা একাকিত্ববোধ সৃষ্টি হওয়া, বন্যার কারণে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়া এবং বিদ্যালয়ে অনুপস্থিতির হার বেড়েছে বলে গবেষণায় উঠে এসেছে।

শিশুর এ সংকটকাল থেকে উত্তরণের জন্য মতবিনিময় সভায় প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার প্রকৃতি ও ধরন সম্পর্কে জানা এবং সংকট উত্তরণে সংশ্লিষ্টদের মতামত গ্রহণ করা হয়েছে।

এ ছাড়া সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় শিক্ষকদের অসম্মান ও হেনস্তার কারণে সৃষ্ট অশান্তি ও তাদের মানসিক অবস্থার উন্নয়নে সুপারিশ, মানসিক স্বাস্থ্যসেবা এবং এ-সংক্রান্ত নীতি প্রভাবিত করার জন্য সুপারিশ তৈরি এবং তথ্য বিস্তরণের কৌশল সম্পর্কে মতামত গ্রহণ করা হয়েছে।

সাম্প্রতিক সংকটে শিশুদের মধ্যে ভয়, আতঙ্ক, দুঃখবোধ, অস্থিরতা, উৎকণ্ঠা, অশান্তি, চমকে ওঠা-বাকরুদ্ধ হওয়া, বিচ্ছিন্নতা বোধ, অসহায়ত্ব বোধ, অপরাধবোধ, ক্লান্তিবোধ এবং রাগের মতো আচরণিক প্রভাব ফেলেছে।

সংকট সমাধানে মতবিনিময় সভায় বিভিন্ন পরামর্শ তুলে ধরেন সংশ্লিষ্টরা। এর মধ্যে শিশু স্বাস্থ্য উন্নয়নে বিশেষ কার্যক্রম গ্রহণ, শিশুদের সঙ্গে মতবিনিময়, উঠান বৈঠকের মাধ্যমে অভিভাবক ও সমাজের মুরুব্বিদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি, প্রশিক্ষণ কর্মশালা আয়োজন, শিশুদের বিষণ্নতা, হতাশা কাটানোর জন্য বিনোদনমূলক পরিবেশ তৈরি এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কাউন্সেলিং করার উদ্যোগ নেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।

এ ছাড়া মতবিনিময় সভায় সরকারি নানা উদ্যোগের পাশাপাশি অভিভাবকদের করণীয় নিয়েও সবিস্তারে করণীয় তুলে ধরা হয়।

মতবিনিময় সভায় মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এম এ মোহিত কামাল বলেন, শিশুদের জন্য সবকিছু নরমভাবে ব্যবহার করতে হবে। তাদের কোনো কিছু করতে জোর করা যাবে না। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের মনের যত্ন নেওয়ার আহ্বান জানান তিনি। সে জন্য মনের স্বাস্থ্য বা মানসিক স্বাস্থ্য নিশ্চিতের ওপরও জোর দেন তিনি। 

অধ্যাপক ড. এম এ মোহিত কামাল বলেন, সাম্প্রতিক এ আন্দোলনের ফলে শিশুদের ওপর প্রভাব পড়েছে। ক্ষমতা কাঠামো শিশুদের আবেগ বা মানসিক অবস্থাকে বুঝতে পারেনি বা চায়নি। ফলে শিক্ষার্থীরা নিজেরা নিজেরা সংগঠিত হয়েছে। সে জন্য শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে সবাইকে সচেতন থাকার পরামর্শ দেন তিনি।

মতবিনিময় সভায় সভাপতিত্ব করেন গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে. চৌধুরী। সমাপনী বক্তব্যে তিনি বলেন, শিশুদের শিক্ষা নিশ্চিতের জন্য তাদের মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে হবে। সে জন্য আমরা মতবিনিময় সভা থেকে প্রাপ্ত প্রস্তাবগুলো সরকারের কাছে তুলে ধরবো, যাতে সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারে।

সভায় বক্তব্য দেন গণস্বাক্ষরতা অভিযানের উপপরিচালক তপন কুমার দাশ, সংস্থাটির কার্যক্রম ব্যবস্থাপক আব্দুর রউফ। সভায় অতিথি বক্তা হিসেবে মতামত দেন বাংলাদেশ প্রাইমারি স্কুল অ্যাসিস্ট্যান্ট টিচার সোসাইটির সভাপতি শাহিনুর আল-আমিন, টিচার ডেভেলপমেন্ট ইন্সটিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক এম. নাজমুল হক, ব্র্যাক ইন্সটিটিউট অব এডুকেশনাল ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক ড. ইরাম মরিয়াম, প্রাইমারি এডুকেশন কনসাল্টেশন কমিটির সদস্য চৌধুরী মুফাদ আহমেদ।


সর্বশেষ সংবাদ