কিশোর জুবায়েদ

‌গুলি ঢোকে ডান চোখে, বেরিয়ে যায় মাথার পেছন দিয়ে

নিহত জুবায়েদ
নিহত জুবায়েদ

কিছু না খেয়েই সেদিন বেলা ১১টায় বের হয়ে যায় জুবায়েদ। দুপুরে বাসায় ফিরে খাবার খাবে তাই দুপুরের খাবার রান্না করে ছেলের অপেক্ষা বসে রয়েছেন মা। ছেলে ফিরলে দুজনে একসঙ্গে খাবার খাবেন। কিন্তু দুপুর গড়িয়ে বিকেল পার হলেও ছেলে আর ফিরেনি। শেষে তাকে পাওয়া গেলো ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে। জুবায়েদ আর কখনো মায়ের সঙ্গে বসে খাবার খাবে না—হারিয়ে গেছে চিরতরে।

কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলা আগানগর ইউনিয়নের গোকুলনগর গ্রামের নাজির হোসেন ও হোসনে আরা বেগম দম্পতির বড় ছেলে কিশোর জুবায়েদ (১৬)। কাজ করে একটি ফার্নিচার দোকানে। গত ৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রীর দেশ ছেড়ে পালানোর পর দুপুরে যাত্রাবাড়ি এলাকায় মিছিলে গিয়ে পুলিশের গুলিতে নিহত হয় জুবায়েদ।

দেশ যখন স্বৈরাচার মুক্তির আনন্দে ভাসছে জুবায়েদের পরিবার তখন ভাসছে চোখের জলে। জুবায়েদের ডান চোখে একটি গুলি লেগে মাথার পেছন দিক দিয়ে বের হয়ে গেছে। এছাড়াও শরীরে রয়েছে অসংখ্য গুলির ক্ষত।

জানা গেছে, ৭ মাস আগে ভালো আয় রোজগারের আসায় বাবা-মা ও ছোট ভাইকে সাথে নিয়ে ঢাকার শনির আখড়ায় ভাড়া বাসায় ওঠে কিশোর জুবায়েদ। শনির আখড়ার ৫ নং গলিতে একটি ফার্নিচারের দোকানে মিস্ত্রির কাজ করতো সে। একই এলাকায় ছোট ভাই জুনায়েদ (১৪) কে একটি টেইলার্সে দর্জির কাজে দিয়েছিল। বাবা নাজির হোসেন মাঝে মধ্যে রিকশা চালাতেন। এভাবেই চলছিল তাদের সংসার।

জুন মাসে শুরু হয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। মাঝে মধ্যে সেই আন্দোলনের মিছিলেও যুক্ত হতেন কিশোর জুবায়েদ। গত ৫ আগস্ট সকাল সাড়ে ১০টার দিকে কাজ করার উদ্দেশে ফার্নিচারের দোকানে যায় জুবায়েদ। দুপুর ১টার দিকে জোহরের আজান হলে মালিক বলেন বাসায় চলে যেতে। কিন্তু জুবায়েদ বাসায় না গিয়ে চলে যায় বিজয় মিছিলে।

শনির আখড়া থেকে যাত্রাবাড়ি এলাকায় গিয়ে মিছিলে যোগ দিয়ে পুলিশের গুলিতে গুরুতর আহত হয় কিশোর জুবায়েদ। তাকে স্থানীয়রা উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের নিয়ে গেলে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক।

আরও পড়ুন: ‘আমি তো সব হারিয়েছি, আর কিছুই দেওয়ার নেই’

দুপুর গড়িয়ে বিকেল। এর মধ্যে অনেকবার ফোন করেও মোবাইলে বন্ধ পায় জুবায়েদের। বিকেলের দিকে আর অপেক্ষা না করে তার খোঁজ নিতে বেরিয়ে পড়েন পরিবারের সবাই। আশপাশের হাসপাতাল ও ক্লিনিকে গিয়ে জুবায়েদ ছবি দেখান তারা। কিন্তু কোথাও নেই জুবায়েদ। অনেকেই পরামর্শ দেয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল যাওয়ার জন্য। রাতে সেখানে গিয়ে রিসিপশনের ছবি ও নাম দিয়ে খোঁজা হয় তাকে কিছু পাওয়া যায়নি। 

পরে একজন ছবি দেখে বলেন মর্গে গিয়ে দেখেতে পারেন এমন একটি লাশ মর্গে দেখে এসেছি। পরে রাত সাড়ে ১১টার দিকে মর্গে গিয়ে এক কোণে জুবায়েদের মরদেহ শনাক্ত করেন পরিবারের লোকজন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে রাতেই বাড়িতে আনা হয় জুবায়েদের মরদেহ। পরেরদিন পারিবারিক তাকে কবরস্থানে দাফন করা হয়।

আশপাশের হাসপাতাল ও ক্লিনিকে গিয়ে জুবায়েদ ছবি দেখান তারা। কিন্তু কোথাও নেই জুবায়েদ। অনেকেই পরামর্শ দেয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল যাওয়ার জন্য। রাতে সেখানে গিয়ে রিসিপশনের ছবি ও নাম দিয়ে খোঁজা হয় তাকে কিছু পাওয়া যায়নি।

জুবায়েদের ডান চোখে একটি গুলি লেগে মাথার পেছন দিক দিয়ে বের হয়ে গেছে। এছাড়াও শরীরে রয়েছে অসংখ্য গুলির ক্ষত। দেশ যখন স্বৈরাচার মুক্তির আনন্দে ভাসছে জুবায়েদের পরিবার তখন ভাসছে চোখের জলে।

ছেলের মৃত্যুর পর জুবায়েদের মা হোসনে আরা বেগম বলেন, সকাল সাড়ে ১০টার দিকে গোসল করে সকালের খাবার না খেয়েই কাজের উদ্দেশ্যে দোকানে যায় জুবায়েদ। সকালে খেয়ে যায়নি তাই দুপুরের খাবার রান্না করে খাবার নিয়ে বসে ছিলাম জুবায়েদের জন্য।

দুপুরে গড়িয়ে বিকেলেও সে না এলে ৪টার দিকে জুবায়েদকে খুঁজতে বাইর হই। এরমধ্যে তার মোবাইলেও অনেক বার ফোন করা হলেও মোবাইল নাম্বার বন্ধ পাওয়া যায়। আশপাশের অনেক হাসপাতাল ও ক্লিনিকে তাকে খোঁজা হয় কিন্তু পাওয়া যায়নি। পরে ঢাকা মেডিকেল মর্গে গিয়ে মরদেহ পাওয়া যায়।

তিনি বলেন, আমি আমার ছেলে হত্যার বিচার চাই। এছাড়াও আরও যারা এই আন্দোলনে শহিদ হয়েছে তাদের পাশে যেনো বর্তমান সরকার দাঁড়ায় সেই দাবিও জানাই।

জুবায়েদের ছোট ভাই জুনায়েদ বলেন, ভাইয়া আমাকে অনেক আদর করতেন। পরিবারের অভাবের জন্য ভাইয়া ক্লাস সেভেন পর্যন্ত ও আমি পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লেখা পড়া করি। ৫ আগস্ট দুইটার দিকে যখন শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায় এই খবর শুয়ে শুয়ে মোবাইলে খবর দেখছিলাম। পরে আম্মার চাপাচাপিতে বিকেলে ৪টার দিকে ভাইয়ে খোঁজে বাহির হই। 

জুনায়েদ আর বলেন, ভাইয়ার ডান চোখে একটি গুলি লেগে মাথার পিছন দিক দিয়ে বেরিয়ে গেছে। এছাড়াও শরীরে অসংখ্য গুলির ক্ষত ছিল। জানাজা নামাজের গোসলের সময় রক্তে খাটিয়া ভিজে গেছে। আমার ভাইকে যারা গুলি করে হত্যা করেছে আমি তাদের বিচার চাই।

জুবায়েদের নানা বাচ্চু মিয়া (৬২) বলেন, আমার মেয়ে দুই সন্তান নিয়ে আমার বাড়িতেই থাকতো। সাত মাস আগে জুবায়েদ মা, বাবা ও ছোট ভাইকে নিয়ে ঢাকার শনির আখরায় যায় কাজের জন্য। সেখানে একটি ফার্নিচারের দোকানে কাজ নেয় জুবায়েদ। অভাবের সংসারের বেশি লেখাপড়া করতে পারেনি জুবায়েদ। কাজ করেই পরিবার নিয়ে চলতো।

জোবায়েদ নিহত হওয়ার কয়েকদিন আগেও ফোন করে আমাকে বলেছিল সে মিছিলে গেছে। আমি ফেনে তাকে মানা করেছিলাম যে আমরা গরীব মানুষ কাজ করে খেতে হয় মিছিল মিটিংয়ে গিয়ে আমাদের কি হবে। জুবায়েদের মৃত্যুর পর তার পরিবারের সবাই বাড়িতে চলে এসেছে। জুবায়েদকে হারিয়ে তারা দিশেহারা। সরকার যদি জুবায়েদের ছোট ভাই জুনায়েদকে একটি চাকরির ব্যবস্থা করে দিতো তাহলে তাদের জন্য ভালো হতো। জুবায়েদের মৃত্যুর পর জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ ২ লাখ ও বিএনপির পক্ষ থেকে ১ লাখ টাকা অনুদান দিয়েছে।

শনি আখড়ার রাসেল ফার্নিচারের স্বত্বাধিকারী রাসেল মিয়ার সাথে মুঠোফোনে কথা হলে তিনি জানান, জুবায়েদ ছয় মাস আগে আমার ফার্নিচারের দোকানে কাজে নেয়। সে আনেক নম্র-ভদ্র ছেলে ছিল। ৫ আগস্ট জোহরের আজান হলে আমি নামাজে চলে যাই। তখন জুবায়েদকে বলি বাসায় যাওয়ার জন্য কিন্তু সে বাসায় না গিয়ে যাত্রাবাড়ি এলাকায় মিছিলে চলে যায়। তার মৃত্যুতে আমি অনেক কষ্ট পেয়েছি। জুবায়েদ হত্যার বিচার দাবি করেন তিনি।


সর্বশেষ সংবাদ