জাতীয় কবি নজরুলের ৪৮তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম  © সংগৃহীত

বিদ্রোহী -প্রেম, সাম্য-মানবতার কবি ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৪৮তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ১৯৭৬ সালের এ দিনে তৎকালীন পিজি হাসপাতালে তিনি ইন্তেকাল করেন। কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়। নজরুল ছিলেন চির প্রেমের কবি। মূলত তিনি বিদ্রোহী, কিন্তু তার প্রেমিক রূপটিও প্রবাদপ্রতিম। তাই মানুষটি অনায়াসেই বলতে পারেন, আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন খুঁজি তারে আমি আপনায়।

কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা ও গান মানুষকে যুগে যুগে শোষণ ও বঞ্চনা থেকে মুক্তির পথ দেখিয়ে চলেছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর গান ও কবিতা ছিল প্রেরণার উৎস। কাজী নজরুল ইসলাম নিজ গ্রামে মসজিদ ও স্কুলে অধ্যয়ন করেন। ছোটবেলায়ই কবিতা ও গান লেখা শুরু করেন। নিজে বিভিন্ন আসরে গান পরিবেশন করেন। দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত হয়েও কবি কখনো আপস করেননি। 

বাংলা ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ বর্ধমান জেলার আসানসোলের জামুরিয়া থানার চুরুলিয়া গ্রামে তিনি জন্মেছিলেন। তাঁর অনেক নাম দুখু মিয়া। বাবার নাম কাজী ফকির আহমেদ ও মা জাহেদা খাতুন। স্বাধীনতার পরপরই কবিকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বাংলাদেশে তাঁর বসবাসের ব্যবস্থা করেন এবং ধানমণ্ডিতে কবির জন্য একটি বাড়ি প্রদান করেন। 

কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যে বিদ্রোহী কবি হিসেবে সমধিক পরিচিত হলেও তিনি ছিলেন একাধারে কবি, সংগীতজ্ঞ, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক, চলচ্চিত্রকার, গায়ক ও অভিনেতা। তিনি বৈচিত্র্যময় অসংখ্য রাগ-রাগিনী সৃষ্টি করে বাংলা সঙ্গীত জগতকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন।

দুঃখের দহনে পোড়া ‘দুখু মিয়া’র জীবন আগের মতো দুঃখেরই থেকে গেছে। জীবিকার প্রয়োজনে এমনকি রুটির দোকানে কাজ করেন। তরুণ বয়সে সেনা সদস্য হিসেবে যোগ দিয়েছেন যুদ্ধেও। সাংবাদিকতা পেশার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। করেছেন রাজনীতিও। সাহিত্য চর্চার শুরুটাও বালক বয়সে। নজরুলের জীবন তাঁর সাহিত্যের মতোই চমক লাগানো। 

১৯০৮ সালে কাজী নজরুল ইসলামের পিতা ফকির আহমদ মৃত্যুবরণ করলে তাদের পরিবার আর্থিক অনটন ও কষ্টের মধ্যে পড়ে যায়। গ্রামের স্থানীয় মক্তবে তার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। পরিবারের প্রয়োজনে নজরুল নিজের মক্তবে শিক্ষকতা ও মসজিদে মুয়াজ্জিনের কাজ করেন। আল কুরআন, ধর্ম ও দর্শন, ইসলামী জ্ঞান অর্জনে মনোনিবেশের সুযোগ পান তিনি বাল্যকালেই।

আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন শোষিত-বঞ্চিত মানুষের মুক্তির জন্য। মানবতার মুক্তির পাশাপাশি সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার, কূপম ূকতার বিরুদ্ধে ছিলেন সোচ্চার। মুক্তবুদ্ধি ও চিন্তার পক্ষে কলম ধরেছেন নির্ভীক চিত্তে। ছোটগল্প, উপন্যাস, গান, নাটক লিখলেও মূলত কবি হিসেবেই তিনি বেশি পরিচিত আজীবন বিদ্রোহী দৃষ্টিভঙ্গি আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার উচ্চকণ্ঠের কারণে তিনি ভূষিত হন ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে। 

১৯২২ সালে প্রকাশিত হয় তার সাড়া জাগানো কবিতা সঙ্কলন ‘অগ্নিবীণা।’ কাব্যগ্রন্থটি বাংলা কাব্যের ভুবনে পালাবদল ঘটাতে সক্ষম হয়। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে এর প্রথম সংস্করণ নিঃশেষ হয়ে যায়। পরে খুব দ্রুত আরও কয়েকটি নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হয়। ‘বিদ্রোহী’, ‘কামাল পাশা’ ছাড়াও এই কাব্যগ্রন্থের ‘প্রলয়োল্লাাস’, ‘আগমনী’, ‘খেয়াপারের তরণী’, ‘শাত-ইল্-আরব’ কবিতাগুলো তুমুল হৈচৈ ফেলে দেয় সর্বত্র। নজরুল গদ্য রচনার বেলায়ও ছিলেন স্বতন্ত্র চিন্তার। তার প্রথম গদ্য ‘বাউন্ডেলের আত্মকাহিনী’ ১৯১৯ সালে সওগাত পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। 

তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে অগ্নিবীণা, সঞ্চিতা, চক্রবাক, প্রলয় শিখা, মরু ভাস্কর, দোলনচাঁপা, বিষের বাঁশি, ভাঙ্গার গান, সাম্যবাদী, পুবের হাওয়া, ব্যথার দান, রিক্তের বেদন, বাঁধনহারা, মৃত্যুক্ষুধা, কুহেলিকা ইত্যাদি। এ ছাড়া প্রায় ৩ হাজার গান রচনা করেন কাজী নজরুল। তাঁর গানের বাণী হয়ে ওঠে মানবতাবাদ ও সাম্যবাদের পক্ষে শক্তিশালী হাতিয়ার।

নজরুলের সাহিত্যিক জীবনের অবসান ঘটে মাত্র ৪১ বছর বয়সে। এর পর তিনি নির্বাক হয়ে যান। জার্মান দার্শনিক নিৎসে লিখেছিলেন, বীর ও মহাপুরুষেরা যখন সাধারণের চাইতে অনেক ওপরে ওঠেন, তখন তাঁরা এমন কিছু দর্শন করেন, যাকে আর বর্ণনা করা যায় না। তখন তাঁরা বোবা হয়ে যান। কাজী নজরুলের ট্র্যাজিক নীরবতা হয়তো সে রকম কোনো সত্যদর্শনেরই অভিঘাত বা আঘাত। ফুলের জলসায় কবি নীরব, কিন্তু বাংলা কবিতা ও গানে তিনি এখনও কথা বলে চলেছেন। 


সর্বশেষ সংবাদ