বই-খাতা নিয়ে দৌড়ানোর বয়সে শিশুদের হাতে মাছ ধরার জাল

জেলেপল্লির সন্তানদের পড়ালেখা করানোর আগ্রহ নেই তাদের বাবা-মায়েরও
জেলেপল্লির সন্তানদের পড়ালেখা করানোর আগ্রহ নেই তাদের বাবা-মায়েরও  © টিডিসি ফটো

ভোলার মেঘনা নদীর বুকে জেগে উঠা ভোলারচর, মাঝেরচর, মদনপুর চর, চটকিমারা চর, রামদাসপুর এবং মেঘনার কুলের বিভিন্ন বেরি বাঁধ এলাকার জেলেপাড়া। সেখানে হাজার হাজার জেলেদের বসবাস। নদী ভাঙ্গনে দিশেহারা ওই জনপদের বসতি ছাড়া আর কিছু নেই। নদীতে মাছ শিকার ও কৃষি কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করা ছাড়া তাদের আর কোনো উপায় নেই। পৈত্রিক পেশাকে ধরে জীবিকা নির্বাহ করছে হাজার হাজার পরিবার।

এসব অঞ্চলে প্রাথমিক বা কিছু জায়গায় মাধ্যমিকের আলো পৌঁছালেও যেন শিক্ষা গ্রহণ না করেই জেলে বা কৃষক হিসেবে গড়ে উঠছে তাদের শিশুরা। দারিদ্র্যের সংসারে একটু আয়ের আশায় এখানকার শিশুরা খুব কম বয়সেই বেছে নিতে বাধ্য হয় জেলে অথবা কৃষি জীবন। যেখানে তাদের এই বয়সে হাসি-খুশি ও আনন্দ-উল্লাসে বেড়ে ওঠার কথা, সেখানে শুধুই দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত।

যে বয়সে শিশুটির হাতে থাকার কথা ছিল বই-খাতা, সেই শিশুটির হাতে আজ মাছ ধরার জাল। দিন কাটে তার নদীর বুকে। সন্তানদের পড়ালেখা করানোর প্রতি আগ্রহ নেই তাদের বাবা-মায়েরও। আধুনিক সভ্যতা থেকে পিছিয়ে পড়া এই জনপদের অভিভাবকদের অসচেতনতা ও নদী ভাঙ্গনের কারণে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারছে না এখানকার শিশুরা। চরাঞ্চল ও জেলে পল্লির অধিকাংশ শিশুদের জীবনের গল্প এমন।

সরেজমিনে দেখা যায়, জেলে নৌকায় কাজ করা অধিকাংশের বয়স ৮-১৫ বছর। জীবনের প্রয়োজনে তারা এই বয়সে হয়ে ওঠে দক্ষ মাঝি বা জেলে। এই শিশুদের কেউ বাবার সঙ্গে জাল টানে, কেউ নৌকার বৈঠা ধরে, কেউবা জাল থেকে মাছ ছাড়িয়ে ঝুড়িতে তোলে। আকৃতি অনুযায়ী মাছ বাছাই করার কাজও তারা করে। এভাবেই নিচ্ছে তারা দক্ষ জেলেতে পরিণত হওয়ার শিক্ষা। মাঝে মাঝে বাবার কাজের দায়ভারও তাদের বইতে হয়। ধরা মাছ নিয়ে বাবা হাটে গেলে বাবার অনুপস্থিতিতে উত্তাল নদীতে নৌকা নিয়ে চলে যায় শিশুটি। জোয়ার ভাটা ওদের মুখস্থ। দিন শেষে এই মাছ বিক্রি করে যা পায় তা দিয়ে কিছুটা হলেও উপকৃত হয় তাদের পরিবারের মানুষগুলো।

ভোলার খাল, ইলিশা বেরিবাঁধ, মাঝেরচর, মদনপুরসহ এসব অঞ্চলের জেলে পরিবারগুলোতে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে প্রতিনিয়ত অনিশ্চয়তায় বিবর্ণ হয়ে ওঠে জেলে পল্লির হাজারো শিশুর শৈশব। শিশুশ্রমের বেড়াজালে বন্দিজীবন আর বাবার কষ্টের সঙ্গী হতে ষষ্ঠ শ্রেণিতে আর পড়া হয় না অধিকাংশ শিশুর। ফলে কোমলমতি সব শিশুর কাঁধে ওঠে সংসারের বোঝা। বাবা-মা ছোট ভাইবোন নিয়ে বেঁচে থাকাই তখন তাদের জীবনের মূলমন্ত্র। চর অঞ্চলের অনেক শিশুর স্কুলে যাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও সম্ভব হয়ে ওঠে না যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না হওয়ায়।

ইলিশা তেমাথা ঘাটের কাছেই বাবার মাছ ধরার সঙ্গী হিসেবে ছিলেন ১০ বছরের শিশু হাসিব। হাসিবের ভাষ্য, ‘স্কুলে যাইতে তো ইচ্ছা করে তয় কামের লাইগ্যা যাইতে পারি না। জোয়ার আওয়ার আগেই জাল পাতি, আর ভাটায় পানি টানলে মাছ লইয়া আইতে আইতে স্কুল ছুটি হইয়া যায়।

এ ঘাটেই কথা হয় আরো কিছু জেলে শিশুর সঙ্গে। মনির, আব্বাস ও রুবেল নামের এই শিশুরাও বলছে, বাবার কাজের সঙ্গী হতে হয় বলেই তারা স্কুলে যেতে পারে না। মদনপুরের কয়েকজন জেলের সাথে কথা বললে তারা জানান, মাছ ধরা আমাদের পৈত্রিক পেশা। এই পেশাকে ধরে রেখেছি এখনো। আমাদের সন্তানরা সেই পেশা ধরে রাখবে। ইচ্ছা থাকলেও ছেলে মেয়েদের পড়াশোনা করানোর খরচ নেই। তাই মাছ ধরার কাজ শিখাচ্ছি।

ছেলেবেলা থেকে কাজ শিখলে বড় হয়ে একজন দক্ষ মাঝি হিসেবে নিজেদের গড়তে পারবে ওরা। রাজাপুরের জেলে ইউসুফ (৪৫) বলেন, সব পরিবারই এখন বোঝে যে, তাদের পোলাপাইনগুলারে পড়ানো উচিত। কিন্তু পেটের তাগিদে সবাই তো পড়াইতে পারে না।

ভোলার খালের মাছ ব্যবসায়ী আরিফ জানান, নৌকায় একজন জেলের পক্ষে জাল টেনে মাছ ধরা কষ্টকর। মাছ ধরতে হলে আরো লোকের দরকার হয়। দরিদ্র জেলেরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে তার পরিবারের মানুষগুলোকে সহকারী হিসেবে ব্যবহার করে। মূলত এই কারণে শিশুগুলোকে স্কুল ছাড়তে হয়।

ভোলার স্থানীয় দৈনিক পত্রিকা ভোলার বাণীর সম্পাদক মাকসুদ রহমান বলেন, জেলে পল্লির শিশুদের শিক্ষিত করতে হবে এমন প্রবণতা কম। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে, দরিদ্র ও অভাবী মানুষের বিচরণ বেশি। শিশুদের শিক্ষিত করার প্রবণতা তখন বৃদ্ধি পাবে যখন সমাজ থেকে অভাব দূর করা যাবে। প্রতিটি শিশুর জীবনের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সম্পর্কে পরিবারকে সচেতন করতে পারলে কমে আসবে শিক্ষাবঞ্চিত শিশুর সংখ্যা।

 

সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence