সালতামামি-২০২২

চাকরির বাজার নিয়ে তারুণ্যের হতাশার সঙ্গে ছিল ক্ষোভও

২০২২ সালে চাকরির বাজারে ছিল চড়াই উতরাই
২০২২ সালে চাকরির বাজারে ছিল চড়াই উতরাই  © টিডিসি ফটো

বছরজুড়ে বহু ঘটনার সাক্ষী হয়ে বিদায়ের পথে ২০২২ সাল। এ বছরও সংকুচিত ছিল দেশের চাকরির বাজার। ২০২০ সালে দেশে করোনা সংক্রমণের পর থেকে এই ৩ বছরেই সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়স হারিয়েছেন কয়েক লাখ চাকরিপ্রত্যাশী। তাই এ বছরও সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়ানোর দাবি ছিল ভুক্তভোগীদের। এ নিয়ে বছরের নানান সময়ে রাজপথে ছিলেন চাকরিপ্রত্যাশী। সেপ্টেম্বরে শেষের দিকে এসে সরকারি সব চাকরির ক্ষেত্রে নিয়োগে (বিসিএস ছাড়া) প্রার্থীদের সর্বোচ্চ বয়সসীমায় ৩৯ মাস ছাড় (ব্যাকডেট) দেয় সরকার। 

তবুও থেমে থাকেনি চাকরিপ্রত্যাশীদের আন্দোলন। চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা স্থায়ী বৃদ্ধি ও বৈষম্যমূলক ব্যাকডেট পদ্ধতির প্রতিবাদ জানায় তারা। শুধু তাই নয়, পিএসসির নন-ক্যাডার আন্দোলন, প্রাথমিকের কোটা বৈষম্য, এনটিআরসিএ’র শিক্ষক নিয়োগে ধীরগতি প্রভৃতি ইস্যুতে দেশের শিক্ষিত তরুণদের হতাশার সঙ্গে ছিল ক্ষোভও। এমন সব হিসেবের জালে দেশের তরুণদের জন্য ২০২২ সাল কেটেছে অনিশ্চয়তা আর অপ্রাপ্তিতে।

নন-ক্যাডার আন্দোলন
৪০তম বিসিএস উত্তীর্ণ নন-ক্যাডারে চাকরিপ্রার্থীদের বিপুল সংখ্যক প্রার্থীদের সমাগমে পিএসসির সামনে অবস্থান ও মহাসমাবেশ ছিল বছরের অন্যতম আলোচিত বিষয়। টানা ১৫তম দিনের মতো অবস্থান করার পর আন্দোলনকারীরা একটি বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছিল, প্রার্থীদের যৌক্তিক দাবির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পিএসসিকে কিছুটা সময় দেয়ার জন্য আপাতত অবস্থান কর্মসূচির বিরতির সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা। তবে প্রার্থীদের ন্যায্য দাবির প্রেক্ষিতে পিএসসি যদি বেকার বিরুদ্ধে কোনো সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে সামনে কঠোর কর্মসূচি দেয়া হবে। 

চাকরিপ্রার্থীরা এর আগে গত ৩০ অক্টোবর থেকে শুরু করে ২০ নভেম্বর পিএসসির সামনে লাগাতার অবস্থান ও ০৪ নভেম্বর শহীদ মিনারে সাংস্কৃতিক প্রতিবাদসহ টানা ১৫তম দিনের কর্মসূচি পালন করেছেন। এসব কর্মসূচি শেষেও পিএসসি থেকে কোন ধরনের ইতিবাচক সাড়া না পাওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেছেন তারা।

চাকরিপ্রার্থীরা দাবি ছিল, ৪৪তম বিসিএস পর্যন্ত আগের নিয়মে নন-ক্যাডার নিয়োগের পদ্ধতি বহাল চান তারা। আগের বছরগুলোয় নন-ক্যাডার নিয়োগে পিএসসি যে নিয়ম অনুসরণ করেছে, তাতে পিএসসি বেকার বান্ধব প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু সেই নিয়ম থেকে সরে এসে পিএসসি তরুণদের বেকারত্ব বাড়ানোর মতো কাজ করছে বলে অভিযোগ করেন চাকরিপ্রার্থীরা।

তবে সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি) নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এখন থেকে নতুন বিসিএসের বিজ্ঞপ্তিতে ক্যাডার পদের পাশাপাশি নন-ক্যাডার পদের সংখ্যাও উল্লেখ থাকবে। তবে চলমান ৪০, ৪১, ৪৩ ও ৪৪তম বিসিএসের ক্ষেত্রে কোন বিসিএসের সময় কোন শূন্য পদের চাহিদা এসেছে, তা পর্যালোচনা করে মেধার ভিত্তিতে নন-ক্যাডার পদে নিয়োগের সুপারিশ করা হবে।

আর আন্দোলনকারী চাকরিপ্রার্থীদের দাবি আইনগত ভাবে মেনে নেওয়া সম্ভব নয় বলে জানিয়েছে সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)। কর্মকর্তারা বলেছেন, পূর্বে যেভাবে নন-ক্যাডারে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে সেটি আইনগতভাবে সঠিক হয়নি। কেননা প্রতিটি বিসিএসের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে ক্যাডার এবং নন-ক্যাডারের পদসংখ্যা উল্লেখ করে দিতে বলে গেজেটে বলা হয়েছে। এতদিন সেই আইন অমান্য করা হয়েছে। তারা এই ভুলের পুনরাবৃত্তি করতে চান না।

প্রাথমিকের কোটায় বৈষম্য
প্রাথমিক নিয়োগ বিধি-২০১৯ এর ৮ ধারায় মনগড়া নিয়মে ৬০ শতাংশ নারী, ২০ শতাংশ পোষ্য বা পারিবারিক, ২০ শতাংশ পুরুষ ও সামগ্রিকভাবে ২০ শতাংশ বিজ্ঞান কোটায় নিয়োগের নীতিকে বৈষম্যমূলক আখ্যা দিয়ে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক নিয়োগে কোটা বাতিলসহ ৫ দফা দাবি জানায় আবেদনকারী প্রার্থীরা। তারা দাবি জানায়, বৈষম্যমূলক ফলাফল বাতিল করে এক ও অভিন্ন কাট মার্কে পুনরায় ফলাফল ঘোষণা করা; কোটা বাতিলের সরকারি পরিপত্র মেনে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা।

এছাড়াও শিক্ষক নিয়োগে বিদ্যমান নিয়োগ মেধার ভিত্তিতে দ্রুত সম্পন্ন করে নতুন কোটামুক্ত পরবর্তী নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দ্রুত প্রকাশ; প্রতিবন্ধীদের জন্য কোটা সংরক্ষণ করে পোষ্য কোটাসহ সব কোটার সম্পূর্ণ বিলোপ এবং নিয়োগ পরীক্ষার মেরিট লিস্টের পাশাপাশি প্রাপ্ত নাম্বার প্রকাশ করার দাবিও তাদের।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নিয়োগের সর্বশেষ প্রকাশিত নিয়ে চাকরিপ্রার্থীরা অভিযোগ করেন, ঘোষিত ফলাফলে সমাজের অনগ্রসর শ্রেণিকে বঞ্চিত করে চাকরিজীবীর সন্তানদের বৈষম্যমূলক কোটা সুবিধা দিয়ে পুনরায় চাকরির সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে প্রাথমিক নিয়োগ বিধি-২০১৯ এর ৮ ধারায় ৬০ শতাংশ নারী, ২০ শতাংশ পোষ্য বা পারিবারিক, ২০ শতাংশ পুরুষ ও সামগ্রিকভাবে ২০ শতাংশ বিজ্ঞান কোটার অগ্রাধিকার দেয়া হয়। 

তারা জানান, এটি সমাজের অনগ্রসর শ্রেণিকে এগিয়ে নেওয়ার সাংবিধানিক নির্দেশনার অবজ্ঞা করার সামিল। সরকারের এই অন্যায় নীতির ফলে, কৃষক, দিনমজুর, গার্মেন্টস শ্রমিক, পরিবহন শ্রমিক ও খেটে খাওয়া মানুষের সন্তানদের বঞ্চিত করেছে বলেও অভিযোগ ছিল তাদের। মূলত, চাকরি প্রার্থীরা সারাবছর নিয়োগের জন্য অপেক্ষায় থাকলেও নিয়োগের ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার অনেকটাই আশাহত হয় তারা। তাদের দাবি, এ রকম বৈষম্যমূলক একটি নিয়মের বেড়াজালে তরুণদের হতাশ করেছে এবং এতে উদ্যমী ও মেধাবীরা আগ্রহ হারাবে। 

আরো পড়ুন: র‍্যাংকিং-ট্রাস্ট-রাজনীতি-সেমিস্টার ইস্যুতে সরগরম ছিল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়

এনটিআরসিএ’র প্রথম-প্রথম
দেশের শিক্ষক নিয়োগের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ)। গত ২১ ডিসেম্বর প্রকাশিত ওই গণবিজ্ঞপ্তিতে দেশের বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ৬৮ হাজার ৩৯০ পদে শিক্ষক নিয়োগের কথা জানায় প্রতিষ্ঠানটি। এ বিষয়টিও ছিল বছরের অন্যতম আলোচিত বিষয়। তবে ২০২৩ সালের শুরুর দিকে এ নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে পারে বলে এনটিআরসিএ সূত্র থেকে জানানো হয়েছে। এ গনবিজ্ঞপ্তিসহ মোট চারটি গনবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ)। 

আরও একটি বিষয় এবারই প্রথম করেছে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ); তাদের প্রথমবারের মতো শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের সুপারিশপ্রাপ্তদের পুলিশ ভেরিফিকেশন করা হয়েছে এবছর। এর আগে কখনো শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে দেশে পুলিশ ভেরিফিকেশন করা হয়নি।

মূলত, ২০২০ সালের জুনে নিয়োগের সুপারিশপ্রাপ্তদের পুলিশ ভেরিফিকেশন করে সুপারিশ পাঠায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তারা সুপারিশপ্রাপ্তদের পুলিশ ভেরিফিকেশন শেষে ফলাফল পাঠায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টদের। এরফলে, দেশে প্রথমবারের মতো শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রেও পুলিশ ভেরিফিকেশন করার মতো ঘটনা ঘটলো বিদায়ী বছর।

এছাড়াও, এনটিআরসিএয়ের হয়ে প্রথমবারের মতো আরও একটি কাজ হয়েছে এ বছর; শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রথমবারের মতো ইনডেক্সধারীদের আবেদনের সুযোগ বাতিল করে। যা নিয়েও চরম অসেন্তাষ ছিল নিয়োগপ্রত্যাশী শিক্ষকদের মাঝে। শিক্ষকদের দাবি, তারা পূর্ববর্তী (১২,১৩,১৪,১৫ তম) নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ সনদে এমপিভুক্তি ও ইনডেক্স নম্বর পেলেও সর্বশেষ ১৬ তম নিবন্ধন পরীক্ষায় মানোন্নয়নের মাধ্যমে তাদের মার্ক অনেক বেড়েছে এবং মেরিট পজিশনেও তারা অনেক এগিয়ে রয়েছেন।

তারা জানান, ১৬তম নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ (মানোন্নয়নকারী) অনূর্ধ্ব পঁয়ত্রিশ (৩৫) ইনডেক্সধারী শিক্ষকগণ মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে যে কোন শর্ত সাপেক্ষে ১৬তম নিবন্ধন সনদ দিয়ে অন্তত একবার আসন্ন চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তিতে আবেদনের সুযোগ চাই। মূলত, ১৬ তম নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ (মানোন্নয়নকারী) ইনডেক্সধারী শিক্ষকরা শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালার ৭.০নং অনুচ্ছেদের কার্যকারিতা সাময়িকভাবে স্থগিত করলে বাধার মুখে পড়েন। এরফলেই তাদের নানা আন্দোলন ও কর্মসূচির কারণে আলোচনায় আসে বিষয়টি। ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের এমন দাবিসহ নানা আলোচনার পরও বিষয়টি নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তেই অনড় অবস্থানে থাকে এনটিআরসিএ।

প্রসঙ্গত, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের জারিকৃত শিক্ষক নিয়োগ সংক্রান্ত পরিপত্রের ০৭ নং অনুচ্ছেদের কার্যকারিতা সাময়িকভাবে স্থগিত করায় কর্মরত শিক্ষকদের (এমপিওভুক্ত) আবেদন করার সুযোগ নেই বলে জানানো হয়েছিল এনটিআরসিএ’র বিজ্ঞপ্তিতে। তাতে বলা হয়েছে, স্কুল পর্যায়ে যদি কোন নিবন্ধন সনদধারী (এমপিওভুক্ত) প্রাপ্ত প্রার্থীর কলেজ পর্যায়ের শিক্ষক নিবন্ধন সনদ থাকে এবং তিনি যদি কলেজ পর্যায়ে এমপিওভুক্ত না হন।

তবে তার শিক্ষক নিবন্ধন সনদে উল্লিখিত কলেজ পর্যায়ের পদে ও প্রতিষ্ঠানে আবেদন করতে পারবেন। বিপরীতক্রমে কলেজ পর্যায়ে নিবন্ধন সনদ ধারী এমপিওভুক্ত প্রার্থীর যদি স্কুল পর্যায়ের শিক্ষক নিবন্ধন সনদ থাকে এবং তিনি যদি স্কুল পর্যায়ে এমপিওভুক্ত না হন তবে তার নিবন্ধন সনদে উল্লিখিত স্কুল পর্যায়ের পদে ও প্রতিষ্ঠানে আবেদন করতে পারবেন।

নিয়োগের ব্যাকডেট
চলতি বছরের আলোচিত বিষয়গুলোর মধ্যে আরও একটি অন্যতম বিষয় ছিল নিয়োগের ব্যাকডেট (বয়সে ছাড়)। চাকরিপ্রার্থীরা সরকারি চাকরিতে আবেদনের ক্ষেত্রে বয়সে ছাড় পান ৩৯ মাস। তবে এতে রাখা হয়নি বিসিএসএর আবেদনের বিষয়টি। গত সেপ্টেম্বরে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত নির্দেশনায় জানানো হয়েছিল, যেসব মন্ত্রণালয়/বিভাগ ও এর অধীন অধিদপ্তর/পরিদপ্তর/দপ্তর এবং সংবিধিবদ্ধ/স্বায়ত্তশাসিত/জাতীয়কৃত প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন ক্যাটাগরির সরকারি চাকরিতে (বিসিএস ছাড়া) সরাসরি নিয়োগের লক্ষ্যে কোভিড-১৯ পরিস্থিতির কারণে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করতে পারেনি, সেসব দপ্তর/প্রতিষ্ঠানের ২০২৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত প্রকাশিতব্য বিজ্ঞপ্তিতে উল্লিখিত পদে আবেদনের ক্ষেত্রে প্রার্থীদের বয়স ২০২০ সালের ২৫ মার্চ সর্বোচ্চ বয়সসীমার মধ্যে থাকলে ওই প্রার্থীরা আবেদন করার সুযোগ পাবেন।

এর আগে করোনাভাইরাসের কারণে সরকারি চাকরিপ্রার্থীদের জন্য দুই দফায় বয়স ছাড় করে আদেশ জারি করেছিল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। সে সময় মোট ২১ মাস বয়সের ছাড় দেওয়া হয়। তবে বয়সের এই ছাড় বিসিএসের জন্য প্রযোজ্য হয়নি। ফলে আটকে থাকা সকল নিয়োগে বয়সের ছাড় পায় চাকরিপ্রার্থীরা।

যদিও চাকরিপ্রার্থীদের দাবি ছিল চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার; তবে সরকার তা না করে চাকরিপ্রার্থীদের ব্যাকডেট (বয়সে ছাড়) দেয়। তারা সরকারের এমন সিদ্ধান্তকে বৈষম্যমূলক বলে অভিহিত করেছেন। চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা ৩৫ বছরে উন্নীতকরণ ও তাকে বৈষম্যমূলক আখ্যা দিয়ে ব্যাকডেট পদ্ধতির প্রতিবাদে জনসমাবেশও করে বছরজুড়েই আলোচনায় ছিল চাকরিপ্রার্থীরা। 

চাকরির বয়সসীমা ৩৫ করার দাবি
সরকারি চাকরির আবেদনের ক্ষেত্রে বয়সসীমা ৩০ থেকে বাড়িয়ে ৩৫ করার দাবিও ছিল এ বছরের আলোচিত বিষয়। এ নিয়ে চাকরিপ্রত্যাশীদের সড়ক অবরোধ, মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচিতে আলোচনায় ছিল বিষয়টি। চাকরিপ্রত্যাশীদের দাবি, আওয়ামী লীগ গত জাতীয় নির্বাচনের আগে তাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তারা চাকরিপ্রার্থীদের দাবি পূরণ করবে। কিন্তু একটি নির্বাচন পার হয়ে আরও একটি নির্বাচন আসলেও তাদের দাবি পূরণ করেনি সরকার। তাদের আরও দাবি ছিল, যখন দেশের মানুষের গড় আয়ু ছিল ৫০ বছর, তখন আমাদের চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ছিল ৩০ বছর। এখন যখন গড় আয়ু ৭১, সুতরাং বয়সসীমাও বাড়ানো উচিৎ।

চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা স্থায়ীভাবে ৩২ করার দাবি
করোনাকালে ক্ষতিগ্রস্ততার কারণে স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি ও মুজিববর্ষের উপহার হিসেবে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা স্থায়ীভাবে ৩২ করার দাবি জানিয়েছে চাকরি প্রত্যাশীরা। গত ২৭ জুন  শাহবাগ জাতীয় জাদুঘরের সামনে ‘সরকারি চাকরিতে প্রবেশর বয়সসীমা ৩২ চাই’ ব্যানারে আয়োজিত মানববন্ধন করে তারা এ দাবি জানান।

আরো পড়ুন: ইচ্ছামতো গ্রেড দিচ্ছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো

এর আগে এক জুনের শুরুতে এক সংবাদ সম্মেলনে তাঁরা একই দাবি জানান। তাঁরা দাবি করেন, করোনাকালে ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষার্থীরা তাঁদের জীবন থেকে দুই বছর হারাতে বসেছেন। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, করোনাকালে চাকরির বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পরিমাণ ৮৭ থেকে ১৩ শতাংশে নেমে এসেছে। এ করোনাকালে প্রায় দেড় লাখ পরীক্ষার্থী চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা হারিয়েছেন।

করোনার শুরুতে যাঁদের বয়স ২৮ ছিল, তাঁরা এখন ৩০–এর কাছাকাছি। তাঁরা সরকারি চাকরিতে আবেদনের যোগ্যতা হারাতে চলেছেন শুধু বয়সসীমা অতিক্রম হওয়ার কারণে। যাঁরা স্নাতক ও স্নাতোকোত্তর পর্যায়ের চূড়ান্ত বর্ষে ছিলেন, তাঁরা শিক্ষাজীবন শেষ করতে পারেননি। তাই সব কিছু বিবেচনা করে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা সবার জন্য স্থায়ীভাবে ৩২ বছর করতে হবে।

প্রতিবেদনজুড়ে আলোচনা
১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণদের শ্রমবাজারে প্রবেশের কঠিন শর্ত, প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় দক্ষতায় পিছিয়ে থাকা, কভিড-১৯ মহামারীর কারণে সংকুচিত শ্রমবাজার, চাহিদা অনুযায়ী দক্ষতা অর্জন করতে না পারা, চাহিদার তুলনায় প্রয়োজনীয় বা সমান সংখ্যক বাজার চাহিদা সৃষ্টি না হওয়াসহ ইত্যাদি কারণে পিছিয়ে যায় দেশের তরুণসমাজ। যার সামগ্রিক ফলাফল হিসেবে দেখা যাচ্ছে তারুণ্য জয় করতে পারছে না কাঙ্ক্ষিত সাফল্যকে।

‘বিশ্বজুড়ে তরুণদের কর্মসংস্থানের প্রবণতা ২০২২’ (দ্য গ্লোবাল এমপ্লয়মেন্ট ট্রেন্ডস ফর ইয়ুথ) শিরোনামের এক প্রতিবেদনে আইএলও বলছে, মহামারিকালে দেশে উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে তরুণ বেকারের সংখ্যা। তাদের তথ্য বলছে, দেশে তরুণদের মাঝে বেকারত্বের হার ১০ দশমিক ৬ শতাংশ এবং বাংলাদেশে জাতীয় পর্যায়ে এ হার ৪ দশমিক ২ শতাংশ বলেও জানিয়েছে সংস্থাটি।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রথম ডিজিটাল জনশুমারি ও গৃহগণনার প্রতিবেদনের প্রাথমিক তথ্যবিশ্লেষণ বলছে, দেশের মোট জনসংখ্যার ১৯ দশমিক ১১ শতাংশ তরুণ সংখ্যার হিসেবে যা ৩ কোটি ১৫ লাখ ৬১ হাজার ৮১১। তাদের সকলের বয়স ১৫ থেকে ২৪ বছর বলেও জানানো হয়েছে ওই প্রতিবেদনে। এসব প্রতিবেদনও আলোচনায় আসে বছরজুড়েই।

আর আইএলওর তথ্য বলছে, এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ২০২২ সালে এই বয়সী তরুণ বেকারের সংখ্যা ৭ কোটি ৩০ লাখে পৌঁছাতে পারে। যা ২০২১ সালের তুলনায় কিছুটা কমে ৭ কোটি ৫০ লাখ। যদিও ২০১৯ সালে মহামারিপূর্ব সময়ের চেয়ে তরুণ বেকারের সংখ্যা এখনো ৬০ লাখ বেশি বলেও জানায় তারা। পাশাপাশি তারা তরুণদের দক্ষ করে গড়ে তুলে কর্মসংস্থান সৃষ্টিই বড় চ্যালেঞ্জ বলে উল্লেখ্য করে।

বৈশ্বিক মহামারী, মন্দা, যুদ্ধসহ নানা কারণে বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে প্রতিনিয়ত তরুণদের লড়াই করে নিজেকে প্রমাণ করতে হয়। যার কারণে হতাশা বাড়ছে তরুণদের মধ্যে। তথ্য বলছে, প্রচলিত ব্যবস্থায় বর্তমানে দেশে উচ্চশিক্ষিত বেকার তরুণের সংখ্যা ২৭ লাখ। বিবিএস-এর  জরিপ বলছে, দেশের বেকার তরুণদের মধ্যে সবাইই কর্মক্ষম বেকার। যদিও আইএলওর প্রতিবেদনে বলছে, দেশে মোট বেকারের সংখ্যা ৩ কোটি। 

অন্যদিকে, এ্যাকশন-এইড বাংলাদেশ ও সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) তথ্য বলছে, বাংলাদেশে যুবগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ আর্থসামাজিক ঝুঁকির মধ্যে আছে। বৈষম্য আর গুণগত শিক্ষার অভাবে ৭৮ শতাংশ তরুণ মনে করেন, পড়াশোনা করে তাঁরা চাকরি পাবেন না, গরিব শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে এ হার ৯০ শতাংশ। চাকরি, পড়াশোনা বা প্রশিক্ষণে নেই ২৯ দশমিক ৮ শতাংশ তরুণ। তবে, তরুণদের দক্ষ করে গড়ে তুলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করাকেই বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেছেন সংশ্লিষ্টরা। যা তরুণদের হতাশা বাড়াচ্ছে বলেও মনে করেন তারা।

পাঁচ দশকের একটি পরিণত বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার দ্বারপ্রান্তে। আর এ সময়ে আমাদের জনমিতিতে যে পরিবর্তন, তার সুফল পেতে আমাদের বর্তমান তরুণদের জন্য জন্য আশা বাঁচিয়ে রাখতে হবে। পাশাপাশি বৃদ্ধি করতে হবে তাদের প্রচলিত দক্ষতারও। কেননা, ২০২৯ সালে দেশের ৭ শতাংশ মানুষ বয়োবৃদ্ধ বা প্রবীণ হয়ে যাবে এবং ২০৪৭ সালে এই হার গিয়ে দাঁড়াবে মোট জনসংখ্যার ১৪ শতাংশে। তাই, তরুণদের হতাশার বৃত্ত ভাঙ্গতে তাদের চাহিদার সামঞ্জস্য করার তাগিদ বিশ্লেষকদের।

পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে শিক্ষায় প্রাথমিক স্তর পার হতে পারেনি- এমন মানুষের মধ্যে বেকারত্বের হার সবচেয়ে কম (১ দশমিক ৮ শতাংশ)। আর প্রাথমিক স্তরের পড়াশোনা শেষ করেছেন এমন মানুষদের মধ্যে বেকারত্বের হার ৩ দশমিক ৫ শতাংশ। মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষিতদের মধ্যে বেকার সাড়ে ৮ শতাংশ। উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকার ১০ দশমিক ৭ শতাংশ; যা দেশের হয়ে সর্বোচ্চ বলছে সংস্থাটি।

২০০০ সালে বাংলাদেশে সার্বিক বেকারত্বের হার ছিল ৩ দশমিক ৩ শতাংশ। এক শতাংশ বেড়ে ২০১০ সালে এ হার দাড়ায় ৩ দশমিক ৪ শতাংশে। পরবর্তীতে সর্বশেষ ২০২২ সালে প্রাক-মহামারি সময়ের তুলনায় বেকারত্বের হার দাঁড়াতে পারে ১৪ দশমিক ৯ শতাংশ বলে আশঙ্কা করছে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)। সংস্থাটি বলছে, বাংলাদেশের তরুণদের বড় অংশ আবার নিষ্ক্রিয় এবং তারা কোনো ধরনের শিক্ষায় যুক্ত নন, প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন না, আবার কাজও খুঁজছেন না। দেশে এমন তরুণের হার ২৭ দশমিক ৪ শতাংশ। পাশাপাশি মেয়েদের ক্ষেত্রে এই হার ৪৫ শতাংশের কাছাকাছি রয়েছে।

প্রতিবছর বাংলাদেশে নতুন করে শ্রমবাজারে যুক্ত হতে পারে ১০ লাখ তরুণ। আর দেশের বাইরে সুযোগ হয় ছয় লাখের মতো তরুণের। যদিও দেশের শ্রমবাজারের চাহিদা আরও বেশি। যেখানে কর্মসংস্থানের মাত্র ৫ শতাংশ সরকারি খাতে আর ৯৫ শতাংশই বেসরকারি উৎসে। কিন্তু প্রয়োজনীয় দক্ষতা ও চাহিদাভিত্তিক সক্ষমতা না থাকায় তরুণরা তাদের পছন্দ ও যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ পান না। ফলে বাকিরা বেকার থেকে যান, আর যোগ্য ও দক্ষ কর্মীর অভাবে খালিই থাকে প্রতিষ্ঠানের চেয়ার। কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি না হওয়া এবং দক্ষতার অভাবকেই বেকারত্বের বড় কারণ বলে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা।

দেশীয় ও আন্তর্জাতিক শ্রম বাজারের চাহিদা অনুযায়ী তরুণদের দক্ষ  করা, কর্মমুখী শিক্ষায় শিক্ষিত ও কারিগরিভাবে দক্ষতা বৃদ্ধি, সবার জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা নিশ্চিত করা, তরুণদের জন্য স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদে পরিকল্পিত কর্মসংস্থান সৃষ্টি, তরুণ উদ্যোক্তা তৈরি ও গড়তে সহায়তা, মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে সমান প্রতিযোগিতার সুযোগ এবং দুর্নীতিমুক্ত নিয়োগ প্রক্রিয়া হতে পারে আপাত সমস্যার সমাধান। ফলে বছর জুড়ে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির নানা হিসেবে আলোচনায় ছিল তারুণ্য; সাথে আলোচনায় ছিল তারুণ্যের ক্ষোভও।


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence