মিয়ানমারের নির্বাচনে রোহিঙ্গা বিদ্বেষের রাজনীতি

আগামী ৮ নভেম্বর মিয়ানমারের পার্লামেন্ট নির্বাচন। করোনার মধ্যে এ নির্বাচন আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। কিন্তু বিতর্কের চেয়েও বড় উদ্বেগের ক্ষেত্র হচ্ছে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর জাতি-বিদ্বেষের রাজনীতি। যেন নির্বাচনকে সামনে রেখে মিয়ানমার সরকার, সামরিক বাহিনী ও অন্যান্য দলগুলো একত্রিত হয়েছে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়াতে।
আগামী ৮ নভেম্বর মিয়ানমারের পার্লামেন্ট নির্বাচন। করোনার মধ্যে এ নির্বাচন আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। কিন্তু বিতর্কের চেয়েও বড় উদ্বেগের ক্ষেত্র হচ্ছে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর জাতি-বিদ্বেষের রাজনীতি। যেন নির্বাচনকে সামনে রেখে মিয়ানমার সরকার, সামরিক বাহিনী ও অন্যান্য দলগুলো একত্রিত হয়েছে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়াতে।   © টিডিসি ফটো

আগামী ৮ নভেম্বর মিয়ানমারের পার্লামেন্ট নির্বাচন। করোনার মধ্যে এ নির্বাচন আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। কিন্তু বিতর্কের চেয়েও বড় উদ্বেগের ক্ষেত্র হচ্ছে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর জাতি-বিদ্বেষের রাজনীতি। যেন নির্বাচনকে সামনে রেখে মিয়ানমার সরকার, সামরিক বাহিনী ও অন্যান্য দলগুলো একত্রিত হয়েছে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়াতে।

নির্বাচনী সভা-সেমিনার ও বক্তৃতায় এমনকি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ছড়ানো হচ্ছে ঘৃণাত্মক বক্তব্য। যা জাতি-বিদ্বেষ ও নিপীড়নকে উস্কে দিচ্ছে। নির্বাচনকে সামনে রেখে একটি গবেষণা প্রতিবেদনে এ ধরনের উদ্বেগজনক তথ্য উঠে এসেছে।

গবেষণাটি অক্টোবরের মাঝামাঝিতে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ক্লিনিক (আইএইচআরসি) ও মিয়ানমারের ১৮টি নাগরিক সমাজ সংস্থা (সিএসও) এবং হার্ভার্ড ল স্কুল এর সমন্বয়ে পরিচালিত হয়। ‘Hate Speech Ignited: Understanding Hate Speech in Myanmar’ শিরোনামে ১০০ পৃষ্ঠার গবেষণা প্রতিবেদনটি সম্প্রতি প্রকাশিত হয়। এতে বিদ্বেষমূলক বক্তব্য, ভুল তথ্য প্রচার এবং উগ্র জাতীয়তাবাদ কিভাবে নির্বাচনের পূর্বে জাতি-বিদ্বেষ, নিপীড়ন ও মানবাধিকার লঙ্ঘন পুনরুত্থানে সহায়ক ভ‚মিকা পালন করছে তা বিশ্লেষণ করা হয়।

ঘৃণার প্রবণতা এবং নিদর্শন বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, মিয়ানমারে বছরের পর বছর ধরে বিদ্বেষমূলক বক্তব্য (অনলাইনে এবং অফলাইনে) প্রচার করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। দেশটিতে সংখ্যালঘুদের জীবনযাত্রা বিপন্ন করে বৌদ্ধ-বর্মণ আধিপত্যকে এগিয়ে নিতে কয়েক ধরনের পারস্পারিক প্রক্রিয়া চিহ্নিত হয়েছে। প্রক্রিয়াটি এখনো বহমান রয়েছে।

মিয়ানমারে জাতি-বিদ্বেষমূলক বক্তব্য কেবল ব্যক্তিগত ধর্মান্ধতা এবং অসহিষ্ণুতার পরিণাম নয় বরং এটি ক্ষমতসীনরা পদ্ধতিগতভাবে প্রচার করে আসছে এবং তা শক্তিশালী স্বার্থ দ্বারা পরিচালিত হয়। স্বার্থগোষ্ঠীসমূহ প্রচারকৃত বিদ্বেষমূলক গল্প দ্বারা লাভবান হচ্ছে।

অন্যদিকে সমাজে বিভাজন ও দ্বন্দ তৈরি হয় সমান্তরালে। পর্যায়ক্রমে তা জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানবাধিকার লঙ্ঘনকে উৎসাহিত করছে এবং রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রে এটি সহিংসতামূলক নৃশংস গণহত্যায় রূপ পায়। ঘৃণাজনক বক্তব্যকে দীর্ঘায়িত করার অনুমতি দেওয়ার বিপরীতে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কন্ঠ্যস্বরকে রুদ্ধ করা হয়।

সরকারের তির্যক লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয় প্রতিবাদকারীরা। সম্প্রতি, রাখাইন রাজ্যে ক্রমবর্ধমান সশস্ত্র সংঘাত এবং চলমান ইন্টারনেট শাটডাউনের প্রতিবাদ করায় ৩০ জন শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে নিবর্তমূলক মামলার শিকার হয়। যা আন্তর্জাতিক মানদন্ডের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।

এছাড়াও শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ও বিক্ষোভকে সীমাবদ্ধ করার লক্ষ্যে কর্তৃপক্ষগুলি নিবর্তনমূলক আইন প্রয়োগ করেছে। এমনকি সংখ্যালঘুদের অধিকার নিয়ে কথা বলায় নারী, মানবাধিকারকর্মী ও রক্ষক এবং সাংবাদিকরা বিদ্বেষের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হচ্ছে। এক্ষেত্রে অনেকেই যৌন সহিংসতা ও অপরাধের শিকার হলেও তাদের পুরুষ সহকর্মীরা কিছু করার সামর্থ্য রাখেন না।

প্রতিবেদনে বলা হয় গত বছরে নিউইয়র্ক টাইমস, রয়টার্সের তদন্ত এবং আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালত ও আন্তর্জাতিক আদালত বিচারক মামলায় মিয়ানমারে জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বিস্তৃত অধিকার লঙ্ঘনের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলেও মূল কারণে খুব কম মনোযোগ দেওয়া হয়।

মিয়ানমারকে নির্বাচনের আগে সমস্যাটি মোকাবিলার এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের মান এবং নাগরিক সমাজের দৃষ্টি ও অন্তর্ভুক্তিমূলক অংশগ্রহণের সাথে সামঞ্জস্য রেখে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়। মিয়ানমারের সরকারের প্রতি নিপীড়নমূলক আইন সংস্কার, শান্তির পরিবেশ সুরক্ষা, দায়মুক্তি বন্ধ করা, প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করা এবং আন্তর্জাতিক জবাবদিহিতার বিষয়েও দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়।

হার্ভার্ড আইন স্কুলের আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ক্লিনিকের ক্লিনিকাল প্রশিক্ষক এবং আইন সম্পর্কিত প্রভাষক ইয়ে হান্ট বলেন, ‘দুর্ভাগ্যক্রমে, সরকার সংখ্যালঘুদের প্রতি এ ধরনের জাতি-বিদ্বেষ বন্ধ করতে ব্যর্থ হয়। এমনকি বিদ্বেষ ও ঘৃণ্য বক্তৃতা প্রচারকারীদের বিরুদ্ধে একটি ঘরোয়া মামলাও করেনি কর্তৃপক্ষ।’ প্রগ্রেসিভ ভয়েস এবং বার্মা মনিটর সহ স্থানীয় অংশীদারদের সাথে গবেষণাটির নেতৃত্বে থাকা ইয়ে হুন্ট আরো বলেন, ‘যদিও রাষ্ট্রীয় ও অরাষ্ট্রীয় ক্রীড়াণকরা ঘৃণ্য বক্তব্য ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে, তবুও মানবাধিকার কর্মীদের অবশ্যই লড়াই অব্যাহত রাখতে হবে।’

মিয়ানমার পৃথীবির সেকেলে ধরনের এমন একটি রাষ্ট্র যেখানে সাংবিধানিকভাবে গোষ্ঠীতন্ত্রকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। যা বর্তমান রোহিঙ্গা সংকটের অন্যতম উপাদান। মিয়ানমারের নির্বাচনী আইনের ১০ নম্বর ধারা অনুযায়ী দুটি গোষ্ঠীর মধ্যে জন্মগ্রহণ না হলে জনপ্রতিনিধিত্বের যোগ্যতা থাকবেনা। অর্থাৎ পূর্ণ নাগরিকত্ব পাবেনা। এতদসত্তেও রোহিঙ্গাদের ২০১০ ও ২০১২ সালের নির্বাচনে বিশেষ বিবেচনায় অংশ নিতে দেওয়া হয়েছিলো। কিন্তু ২০১৫ সালে তৎকালীন সামরিক সরকারের নাগরিকত্ব সংশোধন আইন দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম সংকটের সূত্রপাত করেছিলো। সেই সংকটের সমাধানে রূপরেখা কিংবা সদিচ্ছা কোনটিই দেখাতে পারেনি বার্মা কর্তৃপক্ষ।

এমতাবস্থায় নিপীড়িত জনগোষ্ঠী হিসেবে রোহিঙ্গাদের সকল আশা-আকাঙ্খা ও স্বপ্নের ফানুস রুপে হাজির হয়েছে আসন্ন পার্লামেন্ট নির্বাচন। কিন্তু সেটাও ধ্বংসের মুখে। মিয়ানমারের সরকার, সামরিক বাহিনী, রাজনৈতিক দলসমূহ এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের ধর্মান্ধ জনতার জাতি বিদ্বেষী অবস্থানের কারণে। যারা জাতীয় নির্বাচনে রাজনীতি করার প্রধান উপাদান হিসেবে বেছে নিয়েছে জাতি (রোহিঙ্গা) বিদ্বেষ। বিশ্লেষকদের দাবি ঘৃণার রাজনীতি বন্ধ করতে না পারলে মিয়ানমারের আশু পরিণতি নিশ্চয় শুভ হবেনা। তা যতোই গণতান্ত্রিক ও উন্নত হোক না কেন? দিনশেষে লাভবান হবে দক্ষীণ এশীয় সংশ্লিষ্ট কায়েমী স্বার্থগোষ্ঠীদের।

লেখক: শিক্ষার্থী, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়


সর্বশেষ সংবাদ