ছাত্র রাজনীতি নয়, অপরাধী সংগঠন নিষিদ্ধ করুন

  © টিডিসি ফটো

বর্তমানে ছাত্র রাজনীতির গৌরবোজ্জ্বল অতীত মুখরোচক গল্পে পরিণত হয়েছে। বুয়েটে শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে নৃশংসভাবে হত্যা করার পর কলুষিত ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করা, না করা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। যদিও বুয়েটে ইতোমধ্যে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করা কোন দূরদর্শী সিদ্ধান্ত হতে পারে না।

কেননা যেসব কারণে ছাত্র রাজনীতি বিতর্কিত ও সমালোচনার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হচ্ছে সেসব বিষয় মূলোৎপাটনে ভূমিকা নেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। দুচারজন বড় ভাই, সহমত ভাই আর বখে যাওয়া নেতা কর্মীর কারণে গোটা ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করা সমীচীন হবে না।

মনে রাখতে হবে ছাত্র রাজনীতি হচ্ছে জাতির ওয়াচডগ। জাতির দুর্দিনে ছাত্ররা হয়েছে জাতির কাণ্ডারি। আজ ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করলে কার লাভ? প্রথমত ক্ষমতাসীনদের জন্য পোয়াবারো। কেননা ছাত্র সমাজ যেকোনো সরকারের অপকর্মের জবাবে বেশি সোচ্চার থাকে এবং এমনই হবার কথা। সেক্ষেত্রে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করতে পারলে তাদের ক্ষমতা আরো পাকাপোক্ত ও স্থায়ী হবে।

এছাড়া লেজুড়বৃত্তির কারণ ক্ষমতাসীন সরকারের ছাত্র সংগঠন তাদের সোপান হিসেবে তো ব্যবহৃত হয়েই থাকে। কিন্তু ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করলে ক্ষমতাসীনরাই বেশি লাভবান হবে এই সুযোগে তারা আরো বেশি অপ্রতিরোধ্য ও স্বৈরাচারী হবার সুযোগ পাবে। তাদের বিরুদ্ধে রাজপথে কোনো ছাত্র সংগঠন থাকবে না, ফলে তাদের জন্য খালি মাঠে গোল দেওয়া ও জনস্বার্থ বিরোধী সিদ্ধান্ত গ্রহণ সহজতর হবে।

সামরিক শাসকেরা ছাত্র রাজনীতিকে প্রতিপক্ষ ভেবে তা নিষিদ্ধের পদক্ষেপ নেয়। কেননা তাদের ভয়ের বিষয় শিক্ষার্থীদের বাধ ভাঙা প্রতিরোধ ও প্রতিবাদ। দ্বিতীয়ত: বর্তমানের ছাত্র রাজনীতি থেকে গড়ে উঠে ভবিষ্যতের দেশের নেতৃত্ব। নেতৃত্ব তৈরীর এ পাইপ লাইন বন্ধ হলে জাতীয় রাজনীতিতে নেতৃত্বের শূন্যতা তৈরি হবে।

তৃতীয়ত: ছাত্র রাজনীতি বন্ধ হলে প্রতিক্রিয়াশীল, জঙ্গী, মৌলবাদীরা তাদের গোপন তৎপরতা চালাবে বলে অনেকের অভিমত। যদিও ছাত্র রাজনীতি বন্ধ হলে এমন সুযোগ তৈরি হবার সম্ভাবনা ক্ষীণ। আজকে একটা বিষয় মাথায় কিছুতেই ঢুকছে না। সমস্যা অসৎ দুরাচার ও সন্ত্রাসী ছাত্র নেতৃত্ব।

সুতরাং তাদের জন্য ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ হবে কেন? হাতে গোনা এসব গুন্ডা কথিত ছাত্র নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে পরিশীলিত রাজনীতি চর্চার সুযোগ করে দিতে পারেন। ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ মানে মাথা ব্যথার জন্য দেহ থেকে মাথা কেটে, মাথার আলাদা চিকিৎসা করার মতো ঘটনা। যা কোনো ফলদায়ক কিছু বহন করে না। মাথা যেমন দেহের সঙ্গে রেখেই চিকিৎসা করতে হয়। তেমনি ছাত্র রাজনীতি পরিশুদ্ধ করে তা টিকে রাখতে হবে।

দুচারজনের বিতর্কিত ও সন্ত্রাসী কার্যকলাপে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ হবে বাজে ও অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত।স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘাত সংঘর্ষে এ পর্যন্ত খুন হয়েছে ১৫১ জন শিক্ষার্থী।অথচ একটি খুনের বিচারও আলোর মুখ দেখেনি। এখন আমরা আবরার হত্যার বিচার চাচ্ছি। বিচার চাইতেই পারি কিন্তু ন্যায় বিচার পাওয়ার অধিকার আমাদের নেই।

যদি একটি খুনের বিচার কার্যক্রমে অপরাধীকে শাস্তি দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারতো তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এতোগুলো তরতাজা প্রাণ অকালে ঝরে যেত না।বাবা মার বুক খালি হতো না। ছাত্র রাজনীতি এতোটা কলুষিত হতো না। আজ ছাত্র রাজনীতি বন্ধের কেউ হুংকার দিতো পারতো না।

আমাদের অবস্থা হয়েছে শেয়ালের লেজ কাটার কাহিনীর মতো। একটি শিয়াল ধৃত হয়ে লেজ কর্তনের শিকার হয়। সেই লেজ হারানো শেয়াল মিটিং করে সব শেয়ালের লেজ কাটার বয়ান দেয়। শুধু তাই নয় সঙ্গে লেজ রাখার কুফলও তাদের শুনিয়ে দেয়। লেজ যে কত ঝামেলার তা বুঝিয়ে দেয়। আমাদের ছাত্র রাজনীতির অবস্থাটা হয়েছে এমন।

বর্তমানে একদিনে ছাত্র রাজনীতি এতোটা নোংরা ও কদর্য হয়নি। এজন্য রাজনৈতিক দলগুলো কম দায়ী নয়। ছাত্র রাজনীতিকে পেশিশক্তি ও ক্ষমতা আরোহণের সিঁড়ি ও ক্ষমতায় টিকে থাকার খুঁটি হিসেবে ব্যবহার করেছে বিভিন্ন সরকার। বর্তমান ছাত্র রাজনীতির এ বীভৎস চেহারার জন্য এটি একমাত্র অন্যতম কারণ।

আজ যেখানে ছিদ্র বা ফোঁটা সেখানে বন্ধ না করে আমরা অন্যত্র ছিদ্র বন্ধ করা নিয়ে খুব বেশি পেরেশান।ছাত্রদের স্বাধীনভাবে ছাত্র রাজনীতি করার সুযোগ দিতে হবে। কোনো রাজনৈতিক দলের এজেন্ডা বাস্তবায়নের শক্তি নয় বরং ছাত্র রাজনীতি হবে "সাধারণ শিক্ষার্থী ও দেশের স্বার্থে সর্বদা সোচ্চার।

কিন্তু তা হচ্ছে কোথায়? ১৯৬৮-১৯৭১ সময়কাল ছাত্র রাজনীতির ছিল সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও গৌরবোজ্জ্বল যুগ। এরপর ঘটলো ১৯৬৬ সালে ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাসের যুগান্তকারী ঘটনা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর ৬ দফা কর্মসূচি এবং পরবর্তীকালে তাঁর বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের হলে ছয়দফা সমর্থন ও শেখ মুজিবের মুক্তির দাবিতে ছাত্রদের মধ্যে এক নজিরহীন ঐক্য গড়ে ওঠে।

এ লক্ষ্যে ১৯৬৯ সালে সকল ছাত্রসংগঠন সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে এবং ১১-দফা দাবি উপস্থাপন করে। ১৯৬৯ সালের শুরুর দিকে যে গণঅভ্যুত্থান আইয়ুব খানকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও শেখ মুজিবকে মুক্তিদানে বাধ্য করে, তা ছিল সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আন্দোলনর ফসল। শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তিলাভের পর এক জনসমাবেশে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ প্রদত্ত বঙ্গবন্ধু উপাধি গ্রহণের মাধ্যমে ছাত্রদের তৎকালীন প্রভাবকে স্বীকৃতি দেন।

১৯৭১ সালের ১ মার্চের পরে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও বাংলাদেশ জাতিসত্তার ধারণাগুলো বাস্তবায়নের লক্ষ্যে অগ্রসর হয়। ১৯৭১ সালের ২ মার্চ ঢাবিতে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে। পরেরদিন ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে এক জনসভায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও শেখ মুজিবকে জাতির পিতা ঘোষণা করে। সেই সভায় আমার সোনার বাংলা জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গৃহীত হয়। তারপরই শুরু হয় ছাত্র সমাজের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে জনগণকে সংগঠিত করার এক উদ্যোগ।যে ছাত্র সমাজের নেতৃত্বে একটি দেশের স্বাধীনতা অর্জন হলো সেই ছাত্র রাজনীতি আজ নিষিদ্ধ ঘোষণার কথা শুনতে হচ্ছে।

ছাত্ররাজনীতির সেই সোনালী অধ্যায় এখন শুধুই ইতিহাসের অংশ। ৯০ এর দশক থেকে মূলত ছাত্ররাজনীতির পচন ধরতে শুরু করেছে এবং সে পচন এখন ক্যান্সারের রূপ ধারণ করেছে। যে ছাত্ররা ’৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ’৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ এবং ’৯০ এর স্বৈরশাসককে গদিচ্যুত করতে অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করেছিল সেই ছাত্রদের উত্তরসূরীরা আজ চাপাতি হকিস্টিক, রামদা আধুনিক অস্ত্র নিয়ে একদল আরেক দলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। জখম খুন পর্যন্ত করছে। বড়ই লজ্জার বিষয়।

আজ ছাত্রলীগের অপকর্মের জন্য ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করার আওয়াজ যৌক্তিক কোনো দাবি হতে পারে না। বরং যে সংগঠন সন্ত্রাসী কার্যকলাপ করবে সেই সংগঠন নিষিদ্ধ করতে হবে, হোক না সেটি ছাত্রলীগ, ছাত্রদল বা অন্যান্য সংগঠন। ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ কেউ মেনে নেবে না। এখনো সময় আছে শুদ্ধি অভিযান চালিয়ে ছাত্র রাজনীতির পুরনো সেই গৌরব ও ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার।

লেখক: শিক্ষক ও গবেষক


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence