নারী ক্ষমতায়নের প্রধান বাধা আজ নারী নিরাপত্তা
- রেজিনা সুলতানা
- প্রকাশ: ১০ মার্চ ২০২৫, ০৩:২৫ PM , আপডেট: ১০ মার্চ ২০২৫, ০৩:৩৪ PM

২০২৫ সালের নারী দিবসের থিম হলো ‘অ্যাকশন ত্বরান্বিত করুন’। এই এ্যকশন হলো সমতার পথে নারীদের আরও এক ধাপ এগিয়ে যাওয়া। কিন্তু আমাদের দেশে আমরা নারীরা কি আসলেই গতিশীল আজ? নারীর গতি কি মাঝেমধ্যেই ব্রেক করে থামিয়ে দেওয়া হচ্ছে না?
প্রতি বছর ৮ই মার্চ, সারাবিশ্বে পালন করা হয় আন্তর্জাতিক নারী দিবস। এই দিনটি নারীদের অধিকার, সাফল্য এবং সমাজে তাদের অসামান্য অবদানকে স্মরণ করার একটি বিশেষ উপলক্ষ। ২০২৫ সালেও এর ব্যতিক্রম হবে না। বরং, সময়ের সাথে সাথে নারী দিবসের তাৎপর্য আরও গভীর এবং বিস্তৃত হবে।
নারী দিবসকে আমরা কখনোই শুধু একটি আনুষ্ঠানিক উদযাপনের মধ্যে দিয়ে শেষ করে দিতে চাই না।নারীদের প্রতি সমাজের দায়বদ্ধতা বাড়িয়ে সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি থেকে শুরু করে প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীরা যেনো আরো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে সেটি নিশ্চিত করতে হবে।
আমরা নারীর সমান অধিকার নিয়ে কথা বলি। কিন্তু আমরা নিজেরা কি সম্পূর্ণ জ্ঞাত এই ব্যাপারটি নিয়ে? বাংলাদেশে এখনো আমরা নারী অধিকার একটা খোলসের মধ্যেই রাখতে বেশী পছন্দ করি। আনিসা হক, আইডিয়াল কলেজের অর্থনীতি একজন ছাত্রী। আনিসা বলেন, "নারীরা যে নারী অধিকারের লক্ষ্যে সচেষ্ট তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অন্যেরটা শুনে শুনে। খুব কম নারীই বিষয়টা সম্পর্কে সম্পূর্ণ এবং সঠিকভাবে জানে।" আবার মাইশা আলম, একটি প্রাইভেট ব্যাংকে কর্মরত একজন সফল ব্যাংকার বলেন," আমরা নারী অধিকার এবং সম-অধিকার নিয়ে এখনো তালগোল পাকিয়ে ফেলি। যেখানে অনেক নারীই এখন নিজেদের অধিকার নিয়ে যুদ্ধ করে চলছে, সেখানে সম-অধিকার তো পরের ধাপে"। আসলেই কি আমরা আমাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন এই মুহূর্তে?
নারী ছাড়া কোনো দেশেই উন্নত সমাজ গঠন করা সম্ভব নয়। কিন্তু দুঃখজনকভাবে এটা মেনে নিতে হয় যে নারীরা এখনও বিশ্বে অনেক দেশেই চরমভাবে বৈষম্যের শিকার। এখানে ধর্ম- ভিত্তিক, লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা, সমান মজুরির অভাব, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবায় সীমাবদ্ধতা—এসব চ্যালেঞ্জ এখনও রয়ে গেছে। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম নয়।দক্ষিণ এশিয়েতে যদিও বাংলাদেশের নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়টি যথেষ্ট প্রাধান্য পেয়েছে কিন্তু আমরা বাংলাদেশে আজ আবারো "নারী" কে নারীর অবয়বেই ঢেকে রাখতে চাই।
২০২৫ সালের নারী দিবস এমন এক সময়ে উপস্থিত, যখন বিশ্বজুড়ে লিঙ্গ সমতার জন্য প্রচেষ্টা আরও জোরদার হচ্ছে। প্রযুক্তি, বিজ্ঞান, রাজনীতি, শিল্পকলা, ক্রীড়া – প্রতিটি ক্ষেত্রেই নারীদের অগ্রযাত্রা এখন দৃশ্যমান। তবে, আমাদের বাংলাদেশে এখনও অনেক পথ চলা বাকি। লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য, সহিংসতা, কর্মক্ষেত্রে অসম সুযোগ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের অভাব – এসব সমস্যা এখনও আমাদের জীবনকে কঠিন করে তুলছে। আজ এই যুগে এসে বাংলাদেশে আমরা চরমভাবে নারীর সুরক্ষা নিয়ে চিন্তিত। এখানে নারী একজন মানুষ নয়। নারী নারীই। তাই ধর্ম এবং সমাজের দোহাই দিয়ে তাকে নানাভাবে বঞ্চনার স্বীকার হতে হচ্ছে। ধর্ষণ এখন সমাজের সবচেয়ে বড় বিষ। শুধুমাত্র গতমাস- ফেব্রুয়ারিতে ২০০ র বেশী নারী ধর্ষণের স্বীকার। প্রতিদিন কোনো না কোনোভাবে নারী এখন লাঞ্ছিত। ব্র্যকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) বললেন-" এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের রাস্তায় একা হাঁটতেও ভয় হয়।বাংলাদেশের নারীরা কোথায় নিরাপদ? ঘরে-বাইরে, পরিবারে, লোকালয়ে, সমাজে, কর্মক্ষেত্রে নারীর নিরাপত্তা এখন বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখীন। এই নিরাপত্তাহীনতার অবসান কীভাবে ঘটবে, এ প্রশ্নের জবাব কি কেউ জানে এদেশে?"
বাংলাদেশের সমাজে পুরুষরাও বিভিন্ন কারণে নির্যাতিত হয়, আবার খুন বা অন্য কোনোভাবে অপহরণের স্বীকার হয়। অনেক নিয়ন্ত্রণই তাদের জীবনকেও নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু নারীর ওপর বাড়তি নিয়ন্ত্রণ হিসেবে চেপে বসে এই পুরুষের নিয়ন্ত্রণ বা কর্তৃত্বপরায়ণতা।এই ২০২৫ শে এসেও রাজনৈতিক বা সামাজিক স্লোগানে বাংলাদেশের নারীর জীবন অনেকাংশে নিশ্চিত হলেও বাস্তব চিত্রটি পুরোপুরি আলাদা।নারীদের নিরাপত্তার বিষয়টি সমাজের বিভিন্ন পরিমণ্ডলে বিভিন্নভাবে আলোচিত হয়। পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও নারীর নিরাপত্তার ব্যপার্টি সমাজে বহুল আলোচিত। কিন্তু অন্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের অবস্থান তুলনা করে বর্তমানে তার্কিকরা তর্কে হয়তো জিততে যাবেন, কিন্তু সমস্যার সমাধান কি করতে পারছেন?
দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে প্রতিনিয়ত নারীর প্রতি সহিংসতার সংখ্যা বাড়ছে।আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য সংরক্ষণ ইউনিটের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪ সালে সারা দেশে ধর্ষণ ও দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে মোট ৪০১ জন নারী। এর মধ্যে ধর্ষণ‑পরবর্তী হত্যার শিকার হয়েছেন ৩৪ জন এবং ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন ৭ জন। ধর্ষণের চেষ্টার শিকার হয়েছে ১০৯ জন।
আবার বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত সাম্প্রতিক জরিপ অনুযায়ী, দেশের ৭৫.৯ শতাংশ নারী জীবনে একবার হলেও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। গ্রামে এই হার ৭৬ শতাংশ এবং শহরে ৭৫.৬ শতাংশ। বিভাগওয়ারী পরিসংখ্যানে বরিশালে নারী নির্যাতনের হার সর্বোচ্চ ৮১.৫ শতাংশ, যেখানে সবচেয়ে কম সিলেটে ৭২.১ শতাংশ।গত ১২ মাসে জাতীয় পর্যায়ে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৯.৪ শতাংশ নারী। বরিশালে এই হার সবচেয়ে বেশি, ১৩.২ শতাংশ। এরপর রয়েছে চট্টগ্রাম, যেখানে গত এক বছরে ১১.২ শতাংশ নারী যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ঢাকায় এই হার ৮.৭ শতাংশ, খুলনায় ৯.১, রাজশাহীতে ৭.৮, ময়মনসিংহে ৭.৬, রংপুরে ৯.১ এবং সিলেটে ১০.৭ শতাংশ। শহরে গত এক বছরে যৌন নির্যাতনের হার ১০.৫ শতাংশ এবং গ্রামে ৮.৯ শতাংশ।
তাই ২০২৫ সালের বাংলাদেশে নারী দিবসের প্রথম প্রত্যাশায় রয়ে যায় নারী জন্য নিরাপত্তা আর সম্মান। আর নারীর অগ্রায়নের জন্য প্রয়োজন-
* প্রযুক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি: ডিজিটাল যুগে প্রযুক্তির গুরুত্ব অপরিসীম। ২০২৫ প্রযুক্তি খাতে নারীদের অংশগ্রহণ আর বাড়ানোর প্রত্যাশা। কোডিং, ডেটা সায়েন্স, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের মতো ক্ষেত্রে পুরুষের পাশাপাশি নারীর নেতৃত্বরও সম-অধিকার থাকবে।
* কর্মক্ষেত্রে সমতা: বেতন বৈষম্য দূরীকরণ বিশেষ প্রয়োজন। কর্মক্ষেত্রে নারীদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ তৈরি, মাতৃত্বকালীন ছুটি এবং অন্যান্য সুবিধা নিশ্চিত করা।
* শিক্ষায় নারীর অগ্রগতি: প্রতিটি নারীর জন্য মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। ২০২৫ সালে আমরা আশা করতে পারি, নারী শিক্ষার হার আরও বাড়বে এবং বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও গণিত (STEM) বিষয়ে নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পাবে।
* রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন: রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়লে নীতি নির্ধারণে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হবে। ২০২৫ সালে সংসদে এবং অন্যান্য রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে নারীদের প্রতিনিধিত্ব আরও বাড়বে।
* নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা: নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা ভীষণ জরুরি। ২০২৫ সালে নারী দিবসে আমরা আশা করতে পারি, নারী নির্যাতন প্রতিরোধে সামাজিক সচেতনতা আরও বাড়বে এবং আইনি পদক্ষেপ আরও জোরদার হবে।
* স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণ: প্রতিটি নারীর জন্য মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। ২০২৫ সালে আমরা আশা করতে পারি, নারীদের জন্য প্রজনন স্বাস্থ্য, মানসিক স্বাস্থ্য এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা আরও সহজলভ্য হবে।
সামাজিক পরিবর্তন:
নারী দিবসের লক্ষ্য শুধু একদিনের উদযাপন নয়, বরং সারা বছর ধরে লিঙ্গ সমতার জন্য কাজ করা। ২০২৫ সালে আমরা এমন একটি সমাজ আশা করি, যেখানে নারীরা তাদের পূর্ণ সম্ভাবনা বিকাশের সুযোগ পাবে। যেখানে তারা নির্ভয়ে, সম্মানের সাথে জীবনযাপন করতে পারবে।
২০২৫ সালের নারী দিবস প্রতিটি নারীর জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে উঠুক। এই দিনটি আমাদের মনে করিয়ে দিক, নারীদের অধিকার রক্ষা করা এবং তাদের সাফল্য উদযাপন করা আমাদের সবার দায়িত্ব। একজন নারী যেনো তার নিরাপত্তা এবং অধিকার বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে পথে বের হতে পারে। আমাদের কোনো নারী যেনো বলতে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগে নিজের অধিকারের কথা ভুলে না যায়।
লেখক: বিভাগীয় প্রধান, কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ