তখন হলুদ খামেই অনুভূতি বিনিময় হতো ডাকবাক্সের চিঠিতে

সরকারি তিতুমীর কলেজের ডাকবাক্স
সরকারি তিতুমীর কলেজের ডাকবাক্স  © টিডিসি ফটো

আজ বিশ্ব চিঠি দিবস। প্রতি বছর ১ সেপ্টেম্বর বিশ্বব্যাপী ‘আন্তর্জাতিক চিঠি দিবস’ পালিত হয়। চিঠি একটি আবেগের নাম। কালের বিবর্তনের সাথে সাথে চিঠি লেখার মাধ্যমও পরিবর্তিত হয়েছে। একসময় বাড়ির সামনে সাইকেল নিয়ে টুংটাং শব্দ করতো ডাকপিয়নরা। চিঠি, চিঠি আছে! বলে তাদের ডাকাডাকি হতো। কেউ তার প্রিয়তমাকে সুদূর প্রবাস থেকে চিঠি লিখতো। তখন হলুদ খামে ভরা কাগজে মোড়ানো চিঠিতে বাক্য ও অনুভূতি বিনিময় হতো। আবার কেউ ডাকবাক্সের মাধ্যমে চিঠি দিতো। প্রতিদিন একবার করে ডাকবাক্স চেকও করতো যে নতুন কোনো চিঠি আসছে কিনা। 

যেখানে আদান-প্রদান হতো সকলের আবেগ, অনুভূতি বা গুরুত্বপূর্ণ কোনো বার্তা। তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে এমন আবেগ আর আগের মতো অনুভব করা যায় না। ডাকবাক্সের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে গিয়ে চিঠির জায়গা এখন মোবাইল ফোনের দখলে।

তেমনি একটি ডাকবাক্স রয়েছে সরকারি তিতুমীর কলেজে। যেটি অকেজো প্রায়! তিতুমীর কলেজের বাঁধনের সামনে এই ডাকবাক্স রয়েছে; সেখানে একজন বই বিক্রি করেন। তিনি জানান, নব্বই দশক থেকে তিতুমীর কলেজে আছেন। তিনি আসার আগে থেকেই এই ডাকবাক্স ছিল। তখন প্রতিদিনই অনেক চিঠি আসতো ডাকবাক্সে। 

তিতুমীর কলেজের তৃতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থী বলেন, আগের ডাক ব্যবস্থা ছিল যেখানে আমাদের মনের ভাব অন্তর থেকে প্রতিটি কথা লেখা হতো। যেগুলো কখনো কখনো স্মৃতি হিসেবে সংরক্ষণ করা হতো। কিন্তু এখন অনলাইন সিস্টেম হওয়ার ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হলেও আগের মতো স্মৃতি চারণ হয় না। তিনি আরও বলেন, এখন অনলাইন সিস্টেমে অনেক নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে হয়, হয়রানির শিকার হতে হয়। তার মতে, তখনকার ডাক ব্যবস্থা ভালো ছিল।

তিতুমীর কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের অর্থনীতি বিভাগের এক শিক্ষার্থী বলেন, তার কাছে চিঠি দিবস মনে হচ্ছে না। যেদিন তার প্রিয় মানুষ তাকে চিঠি পাঠাবে, সেদিন তিনি চিঠি দিবস উদযাপন করবেন। তিনি আরও বলেন, আগের দিনের ডাকবাক্সের মাধ্যমে চিঠি আদান-প্রদান ভালো ছিল; মধুর কথা বার্তা আদান-প্রদান করা যেত। তিনি চান তার প্রিয় মানুষও তাকেও খামের ভিতরে করে মনের কথা প্রেরণ করুক।

তিতুমীর কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী বলেন, চিঠি হচ্ছে এক প্রকার অনুভূতি। ডাকবাক্স হচ্ছে সেই অনুভূতির ঘর। সেখানে সবার অনুভূতিগুলো জমা হতো। বর্তমান প্রজন্ম সবাই ফোন ব্যবহার করে, ফলে অনুভূতিগুলো আমরা বুঝবো না

তিতুমীর কলেজের ইংরেজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, আমরা চিঠি ছোটবেলা থেকেই লিখি। যেটা এখনকার জেনারেশনের মধ্যে নেই। 

তিনি বলেন, আমরা যখন জেলা স্কুল থেকে পড়াশোনা করে ঢাকায় এসে কলেজে ভর্তি হই, তখন আমাদের বন্ধুদের সাথে প্রতিদিনই চিঠি আদান-প্রদান হতো। আমরা প্রতিদিন একবার করে গিয়ে ডাকবাক্স চেক করতাম। যখন আমরা চিঠি প্রেরণ করে সেটার প্রতিউত্তর না পেতাম, তখন আবার চিঠি লিখে জিজ্ঞেস করতাম, কিরে, চিঠি পেছিস কিনা? তখন ২-১ দিনে উত্তর পেতাম। 

যখন আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি, তখন এক এক করে সবার ফোন আসতে শুরু করে। তখনও আমাদের চিঠি আদান-প্রদান হতো প্রতিদিন। যখন আমরা চাকরিতে যুক্ত হই, তখন প্রায় সবার কাছে ফোন চলে আসে; তখন থেকে চিঠির প্রচলন কমে যায়।

তিতুমীর কলেজের ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক শামীমা নাসরিন নাহিদ বলেন, আমরা চিঠি লিখি প্রিয় মানুষের কাছে। প্রিয় মানুষ বলতে বাবা-মা, ভাই-বোন, বন্ধু-বান্ধবদের বলছি। তিনি বলেন, চিঠি এক প্রকার সাহিত্যের মতো। চিঠি লিখতে গিয়েই অনেক শব্দ জানা হয় এবং জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধি পায়।

তিতুমীর কলেজের উপাধ্যক্ষ অধ্যাপক মো. মহিউদ্দিন বলেন, চিঠি মূলত একজনের বার্তা অপর জনের কাছে পৌঁছানো। তিনি বলেন, আমরা এখন সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে বার্তা আদান-প্রদান করি; এগুলো চিঠির আধুনিক রূপ। আমরাও চিঠি লিখতাম আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, সহকর্মীদের কাছে। তিনি বলেন, এখনকার চিঠি লেখার মধ্যে চিঠির আসল বৈশিষ্ট্য হারিয়ে গেছে। আগে চিঠি লিখতে অনেক শব্দচয়ন করতে হতো, অনেক শব্দভান্ডার জানা লাগতো। আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়া পাওয়ার পর হাতে লেখা চিঠির প্রচলন কমে গেলেও ইলেকট্রনিক চিঠির প্রচলন বৃদ্ধি পেয়েছে। 

তিনি আরও বলেন, আধুনিকতার ছোঁয়া পেয়েছে বলে হাতে লেখা চিঠির প্রচলন শেষ হয়ে গেছে, এমন নয়; এখনও কিছু কিছু জায়গায় হাতে লেখা চিঠি আমরা পেয়ে থাকি।

বর্তমানে চিঠির মাধ্যম ডাকবাক্সের পরিবর্তে ই-মেইলের ব্যবহার রয়েছে বেশি। তবুও সকলের কাছে আধুনিক এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা কষ্টকর হয়ে পড়ে। তাই ডাকবাক্সের ঐতিহ্য ধরে রাখতে ডাকঘরকে ডিজিটাল ও সহজলভ্য করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। 


সর্বশেষ সংবাদ