আমাদের এখানেও বাবার পরিচয় মুছে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক  © সংগৃহীত

দাম্পত্যজীবনের যত অনুষঙ্গ তার প্রত্যেকটির বিকল্প দিয়েছে আধুনিক সমাজ। নারী এবং পুরুষ উভয়কে। বিশেষ করে নারীদেরকে।

সেক্স: দাম্পত্য সম্পর্কের মাধ্যমে আমরা পাই সেক্স করার সুবিধা। আধুনিক জীবনযাপন প্রণালীতে এর বিকল্প হলো রিলেশন। এফেয়ার। সিচুয়েশনশীপ। ডেইটিং। ক্যাজুয়েল সেক্স। ওয়ান নাইট স্ট্যান্ড। মেইক-আউট। মাস্টারবেশন। সেক্স টয়। হোমোসেক্স। গ্রুপসেক্স। সেক্স/বডি পজিটিভিটি। আল্লাহ মালুম, পারভার্শানের হতে পারে আরো যত প্যাটার্ন!

বাচ্চাকাচ্চা বনাম প্যাট-কিডস: বিয়ে করে আমরা বাচ্চার বাবা-মা হই। আধুনিক জীবনে বাচ্চার বাবা-মা হওয়ার জন্য বিয়ে করা লাগে না। নারী স্বাধীনতার মডেল হিসেবে আমরা যাদেরকে অনুসরণ করছি, সেই পাশ্চাত্যে অর্ধেকেরও বেশি বাচ্চার বাবার পরিচয় নেই। পিতৃপরিচয়হীন এসব বাচ্চারা সিঙ্গেল মাদারের তত্ত্বাবধানে বড় হয়।

আমাদের এখানেও বাবার পরিচয়কে মুছে ফেলার চেষ্টা শুরু হয়েছে। সব জায়গায় বাবার নামের সাথে মায়ের নাম সংযোজন টেস্ট কেস। প্রাথমিক পদক্ষেপ। আমি মরার আগেই হয়তো এই আধুনিকায়ন সম্পন্ন হয়ে যাবে। অপেক্ষা করুন। দেখবেন (আল্লাহ মাফ করুন)।

বাচ্চা না থাকলে কিংবা দু’একটা হওয়ার পরে প্রডাকশান বন্ধ করে দিলেও সমস্যা নাই। বাচ্চার বিকল্প হিসেবে ঘরে ঘরে তারা বিড়াল পালতেছে। ক্ষেত্রবিশেষে পাখি। এসব অবলা প্রাণীদের নিয়ে তারা রীতিমতো অবসেসড। ইসলামিক শরীয়াহের কঠোর রেস্ট্রিকশানের জন্য এখানে শয়ন কক্ষে কুকুরের বিছানা এখনো দেখা যাচ্ছে না। নট ইম্পিসিবল ইন দ্যা ফিউচার।

বাচ্চাদের ডে কেয়ারের মতো কুকুর-বিড়ালের জন্য ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটে আছে হোস্টেল তথা ফস্টার হোমের ব্যবস্থা। গলির মোড়ের মুদি দোকানগুলোতে না আসলেও সুপারস্টোরগুলোতে অলরেডি এসে গেছে ক্যাট ফুডের দামী প্যাকেট।

আমি গতবছর রাজশাহী শহরেও দেখেছি সুপারস্টোরে ক্যাটফুডের প্যাকেট সাজানো। একটা বিড়ালের জন্য যা খরচ হয় তা দিয়ে নিম্নমধ্যবিত্ত পর্যায়ের দু’জন মানুষের খাওয়াপরা খুব ভালভাবে চলতে পারে। এবার বোঝেন।

ডিভোর্স বনাম ব্রেকআপ: দাম্পত্যজীবনে আসে সংকট। হতে পারে ডিভোর্স। আধুনিক জীবনে এর বিকল্প হলো ব্রেকআপ। তারা মনে করেন, বিয়ে জীবনে একবারই হবে। দেখে শুনে ‘যাচাই করে’ তবে বিয়ের পিড়িতে বসবে। বিয়েকে মহান বানিয়ে শিঁকেয় তুলে রেখে বিয়ের বিকল্প হিসেবে তারা করছে অবাধ সম্পর্কচর্চা। 

এসব সম্পর্ক স্বতঃস্ফূর্তভাবে গড়ে উঠে। তুচ্ছ কারণে ভেঙ্গে যায়। পাঁচবার ব্রেকআপেও লজ্জার কিছু নাই। জাস্ট মুভ অন। ডিভোর্সে যত আপত্তি। বিয়ের পরে ডিভোর্স যদি হয়, কারণ যা-ই হোক না কেন, এজন্য আলটিমেইটলি পুরুষটাই দায়ী।

সিলেক্টিভ কগনিটিভ বিজনেস: সোশ্যাল ওয়ার্কের অংশ হিসেবে আমি বহু নারীর সাথে এসব বিষয়ে কথা বলেছি। তাদের সবার মধ্যে আমি দেখেছি সিলেকটিভ কগনিটিভ ব্লাইন্ডনেস। আসলে আমি অন্য শব্দ/টার্ম ব্যবহার করতে চেয়েছি। নারীবাদবিরোধী হওয়া সত্বেও অনেক নারী আমার লেখা পড়েন। তাদের ভয়ে এই সেল্ফ-রেস্ট্রিকশান।

নারীদের সিলেকটিভ কগনিটিভ ব্লাইন্ডনেসের উদাহরণ হিসেবে বলছি- মেয়েদের সব সমস্যার জন্য শেষ পর্যন্ত পুরুষরাই দায়ী। নারীরা চায় সংসার করতে। সংসার টিকিয়ে রাখতে। অথচ, তিন-চতুর্থাংশ ডিভোর্স তারাই দেয়। এতে নারীদের কোনো দায় নেই।

পারিবারিক সমস্যাগুলোকে প্রপার ওয়েতে ম্যানেইজ করতে না পারার জন্য পুরুষটাই দায়ী। সমাজ ও সংস্কৃতি দায়ী। নারীদের সমস্যার জন্য সংশ্লিষ্ট নারীর সাথে সম্পর্কিত অন্যরাই দায়ী। নারীরা কেবলি ভিকটিম।
পেশাগতভাবে একজন তত্ত্ববিদ হিসেবে জীবনে বহু জটিল তত্ত্ব পড়েছি, বুঝেছি। কিন্তু আধুনিক নারীদের এহেন দাবীর হাকিকত আজ পর্যন্ত আমি বুঝতে পারিনি। সো স্যাড!

অর্থনৈতিক নিরাপত্তা: বিয়ের মাধ্যমে একজন নারী অর্থনৈতিক নিরাপত্তা লাভ করে। আধুনিকতার অবয়বে নারীদেরকে নাগরিক জীবনে পূর্ণ অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের সুযোগ দেয়া হয়েছে। যেসব নারী-পুরুষের সমযোগ্যতার টেকনিকেল জবগুলো করতে পারে না তাদেরকেও অফিস-কোম্পানীর পে-রোলে অন্তর্ভূক্ত হওয়ার সুযোগ করে দেয়া হয়েছে।

তারা ঘরে যা করতো সেগুলোই তারা অফিসে করে পয়সার বিনিময়ে। কাজ যাইহোক, গৃহিণী হওয়াটা অগৌরবের। চাকরি করাটা ডিগনিফায়েড।

ইমোশনাল বন্ডিং: বিয়ের মাধ্যমে একজন নারী মেইল ইমোশনাল সাপোর্ট পেয়ে থাকে। ইমোশনাল এফেয়ারের মাধ্যমে, ব্যাক বার্নার হিসেবে ভাই-বন্ধু পরিচয়ে কাউকে রেখে সে ইমোশনাল সাপোর্টের এই চাহিদা সহজেই মেটাতে পারে।

এ ধরনের ইমোশনাল বন্ডিং সে একইসাথে বেশ কয়েকজনের সাথেও করতে পারে। প্রমিসকিউয়াস রিলেশন, হোয়াটএভার দ্যা ফরমেট, ইজ নট আ প্রবলেম।

আত্মীয়তা বনাম বন্ধুত্বের সম্পর্ক: বিয়ের মাধ্যমে আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে উঠে। আধুনিক জীবনে ফ্রেন্ডসার্কেলের মধ্যে রিলেশন এন্ড ইন্টিমেসি আত্মীয়তার সম্পর্ক থেকেও অধিকতর আকর্ষণীয় ও শক্তিশালী। ফেন্ডদের মধ্যে নিয়মিত পার্টি হবে। মৌজ-মাস্তি হবে। নো হার্ম প্রিন্সিপাল মানা সাপেক্ষে কোনো চি-লে কারো বাগড়া দেয়ার সুযোগ নাই।

ফ্যামিলি টুর এন্ড ট্রাভেল: সনাতনী জীবনপদ্ধতিতে নারীরা বিয়ের আগে ঘুরতে যায় বাবা, চাচা, মামা কিংবা ভাইদের সাথে। বিয়ের পরে জামাইয়ের সাথে। এসব ফ্যামিলি মেম্বারদের সাথে ঘুরতে যাওয়াটা আধুনিক নারীদের কাছে বরিং। এর বিকল্প হিসেবে তাদের আছে স্টাডি ট্যুর, অফিস ট্যুর, সোলো ট্রিপ, হাইকিং এক্সপিডিশান ইত্যাদি।

আধুনিক উচ্চশিক্ষিত নারীরা পারিবারিক জীবনের বন্ধন হতে মুক্ত। অথচ তারা চায় বিয়ে করতে। একজন আদর্শ বর পেতে। আদর্শ সব ইন লজ, আত্মীয়স্বজন আর ফেমেলি পেতে। মুক্তি এবং বন্ধন, এই দুইটা যে আলাদা জিনিস, মিউচুয়েলি এক্সক্লুসিভ, এইটা তাদেরকে বোঝাবে কে?

মানব ইতিহাসে এহেন নারী স্বাধীনতা আনপ্রিসিডেন্টেড ঘটনা। যারা মানবসভ্যতার ধারাবাহিক উন্নয়ন তথা হিউম্যান হিস্ট্রিতে বিশ্বাসী, তারা আধুনিক নারী স্বাধীনতাকে দেখবে অস্বাভাবিক বিকৃতি হিসেবে। এই ধাঁচের অস্বাভাবিক বিকৃতি নানা মাত্রায় সব সমাজে সব সময়েই ছিল। ছিল না শুধু অস্বাভাবিকতা ও বিকৃতির সামাজিকীকরণ। যা এখন হচ্ছে। সমস্যা ঠিক এই জায়গাতে।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

 

সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence