শৈশবের স্মৃতি

ঈদের পর বরিশালে ফেরার দিনটি ঘনিয়ে এলে ভীষণ মন খারাপ হতো

মো. মাহাজাবিল আল নাঈম খাঁন
মো. মাহাজাবিল আল নাঈম খাঁন  © টিডিসি ফটো

রোজার মাসজুড়ে আমাদের পরিবারের সদস্যদের মধ্যে রোজা রাখার প্রতিযোগিতা ছিল। কে কার চেয়ে অধিক রোজা রাখতে পেরেছে, এ নিয়ে তর্কবিতর্ক হতো। রোজায় সবারই স্কুল/মাদ্রাসা বন্ধ থাকায় মাসজুড়ে আনন্দ-ফুর্তিতে সময়গুলো কেটেছিল। সমুদ্রতীরবর্তী বিস্তীর্ণ বালুতে ফুটবল, দিনে ও চাঁদনি রাতে জমিতে সীমানা এঁকে স্থানীয় পলো খেলা, ঘুড়ি ওড়ানো থেকে নানা খেলায় দিন-রাত কাটিয়ে দিতাম।

মনে পড়ে, সেহরির সময় বাড়ির ঘাটার দুয়ারে কেরোসিনের হ্যারিকেন হাতে-দেড় বাজা, দো বাজা, তিন বাজা বলে চিৎকার করে রোজাদারদের ঘুম থেকে জাগাতে আসত কিছু লোক। সেহরির খাবার খেয়ে কেউ সহজে ঘুমাতে যেতে চাইতাম না। আড্ডা, খুনসুটিতে মেতে পড়তাম। অভিভাবকদের নির্দেশে নিরুপায়ে এক-এক করে ঘুমাতে যেতাম।

যত রাতেই ঘুমানো হোক; সকালে ঘুম থেকে ওঠার চর্চা ছিল সবার। আমাদের নিঃসন্তান দাদা-দাদি, যাদের আমরা সোনার দাদা ও সোনার দাদি বলে আমৃত্যু ডেকেছি। আমাদের গুদাম (মাটির দোতলা) ঘরের লম্বা বারান্দায় খুব সকালে আশপাশের বাড়ির প্রচুর কিশোরী-যুবতী সোনার দাদির কাছে আরবি পড়তে আসত। 

তাদের আরবি পাঠের শব্দে ঘুম ভেঙে যেত। রান্নাঘরের ঢেঁকিতে চাল গুঁড়া করার ক্যাচ-ক্যাচ, মচ-মচ, থাম-থাম শব্দও একই সময়ে হতো। লম্বা টানা ঘুমের উপায় ছিল না। আমাদের বাড়ির নিকটবর্তী বঙ্গোপসাগর। সাগরতীরের সংলগ্ন জেলেপল্লী। সকালে জেলে বাড়ি থেকে ছোট টুকরিতে করে জেলেনিরা মাছ নিয়ে ঘরে-ঘরে-‘ওবা মাছ লইবা নি মাছ!’ বলে হাঁক-ডাক দিত।

লইট্টা মাছ, লইট্টা ইচা, হোন্দারা মাছ, রিসা মাছ, ফাইস্সা মাছসহ নানা পদের সামুদ্রিক তাজা মাছ বাড়ি বাড়ি বিক্রি করতে আসত। বাড়িতে বসে মাছ কেনার চলটি এখনো আছে। তবে পরিমাণে কমেছে। রান্নাঘরে খেজুরের রসের হাঁড়ি থেকে রস ঢেলে উনুনে জাল দিয়ে পাতলা গুড় তৈরি হতো। স্থানীয় ভাষায় রসে তৈরি পাতলা গুড়কে রাব বলা হয়।

বেলা ১১টার দিকে হরিহর ডাক্তার এসে রোগীর খোঁজ করতেন। বাক্স হাতে উঠানে উঁচু পিঁড়িতে বসে রোগী দেখতেন। আমরা ভাই-বোনরা তাকে জ্যাঠা বলে সম্বোধন করতাম। ভাটিয়ারীতে তার নিবাস। সেখান থেকে সকালে গ্রামের পথ ধরে বাড়ি বাড়ি এসে চিকিৎসাসেবা দিতেন। নিজের তৈরি নানা রোগের নানা পদের বড়ি থাকত তার বাক্সে। বনাজি ওষুধ ছিল সেই বড়ি। আমার একবার জ্বর হয়েছিল। মুখ হাঁ করে নিজ হাতে বড়ি গলধঃকরণ করিয়ে দিয়েছিলেন।

মাত্র কয়েকটি বড়িতে দুই দিনেই আরোগ্য লাভ করেছিলাম। ধব ধবে সফেদ পাঞ্জাবি, পাজামা পরিহিত কাঁধে শাল জড়িয়ে হরিহর ডাক্তার স্থানীয় সবার নিকট আত্মীয়তুল্য ছিলেন। রোগী দেখা এবং ওষুধ বাবদ তাকে খুচরা প্রদান করলেও কখনো অর্থের দাবি কিংবা দেওয়া পয়সা দেখতেন না। না দেখেই পকেটস্থ করতেন। কি নির্মল আন্তরিকতা ছিল তার কথা-আচরণে। বহু বছর আগে তিনি গত হয়েছেন। কিন্তু আমার ব্যক্তিগত স্মৃতিতে এখনো তিনি আছেন। থাকবেনও হয়তো আমৃত্যু।

ইফতার আয়োজন আজকের মতো মোটেও ছিল না। আমার এখনো স্মরণে আছে, ত্রিশ রোজায় প্রায় ত্রিশ পদের পিঠায় ইফতার করেছিলাম। শীতের রোজায় পিঠা এবং গ্রীষ্মে চিঁড়া ভিজিয়ে কলা দিয়ে ইফতারের রেওয়াজ ছিল সর্বাধিক। সে যুগ এখন গত হয়েছে। তখন আমাদের গ্রামে বিদ্যুৎ, গ্যাস আসেনি। ব্যাটারিতে রেডিও শোনার বিকল্প কিছু ছিল না।

আমাদের গ্রামটি বরিশাল-ঝালকাঠীর উ‌ত্তরে। পূর্বদিকে শিল্পাঞ্চল। শিল্পাঞ্চলের কারণে অবকাঠামোগত উন্নতির ছোঁয়া তখনো গ্রামে পৌঁছায়নি। ১৯৬৯ সালে গাছের গুঁড়ির বিদ্যুৎ খামে বিদ্যুৎ সরবরাহ গ্রামে শুরু হয়েছিল। ইফতার খাওয়া নিয়ে হরেক মজার ঘটনা ঘটত। আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসা এক আত্মীয় অনেকগুলো ধুপি পিঠা (ভাপা পিঠা) খাচ্ছে আর আমরা কৌতূহলে তার খাবার পর্যবেক্ষণ করছি। একপর্যায়ে পেট ফেঁপে তার বেহাল দশায় সবাইকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিল। প্রচুর খেয়েছিল বেচারা সেদিন। মাত্রাতিরিক্ত খেয়ে অক্কা পাওয়ার দশা। ঘটনাটা আমাদের হাস্য-কৌতুকের উপলক্ষ হয়েছিল।

বাজার-সদাইয়ের জন্য সপ্তাহে দুদিন ফৌজদার হাট এবং পাকিস্তান টোব্যাকো কারখানার মূল সড়কের পশ্চিম দিকের ছোট পরিসরের বানুর বাজার। বিকেলের সেই হাটবাজার নির্ভর ছিল সবারই। বিকেলের আগে হাটবাজার তখন ভাবা পর্যন্ত যেত না। আমাদের গ্রামে সর্বসাকল্যে তখন দুটি মসজিদ ছিল। দুটিই মাটির গুদাম। একটির নাম দুল্লভের মসজিদ। অন্যটি চালাদারদের মসজিদ।

আমাদের বাড়ির পেছনের খেতের আল ধরে আমরা দল বেঁধে টচ হাতে নিকটবর্তী চালাদারদের মসজিদে তারাবি নামাজ পড়তে যেতাম। হ্যারিকেনের আলোতে নামাজ হতো। শীতের রাতে গুদাম ঘরের সেই মসজিদে বেশ গরম অনুভব করতাম। বাড়িতে আমাদের দাদারা ছিলেন। কিন্তু পুরো পরিবারের কর্তা ব্যক্তিটি ছিলেন আমার জ্যাঠাবাবা মাস্টার আবুল কাশেম। যার ইশারা-ইঙ্গিতে, আদেশ-নির্দেশে কেবল পরিবার নয়, স্থানীয় সমাজও পরিচালিত হতো।

কলকাতার পাঠ চুকিয়ে যিনি কাস্টমস এবং রেলওয়ের কর্মকর্তার চাকরি পরিত্যাগ করেছিলেন সৎ-সাত্ত্বিক, নির্লোভ-নির্মোহ জীবনযাপনের অভিপ্রায়ে। হাইস্কুলে শিক্ষকতার পেশায় যুক্ত ছিলেন। বিনয়কাঠী ও নবগ্ৰাম একটি ইউনিয়নে অন্তর্ভুক্ত ছিল। তিনি ছিলেন সেই ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত ভাইস প্রেসিডেন্ট। শিক্ষকতা-সমাজ সংস্কারক এবং ইতিহাসভিত্তিক নাটকের নাট্যনির্দেশক জ্যাঠাবাবার সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের বিস্তৃতি ছিল ঝালকাঠি জুড়ে।

দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধকরণে ইতিহাস জ্ঞানের গুরুত্ব অপরিসীম। এটা তার উপলব্ধিতে অধিকমাত্রায় ছিল। আধুনিক, সংস্কৃতিবান, সমাজ সংস্কারক ও মুক্তবুদ্ধির কাশেম মাস্টার বড় দাদার কারণে আমাদের বাড়ির আদি নাম খান বাড়ির পরিবর্তে কাশেম মাস্টারের বাড়ি নামে খ্যাতি লাভ করেছে। স্থানীয় সমাজে তিনি ছিলেন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং সম্মানিত ব্যক্তিত্ব।

স্থানীয় জনসাধারণের সাংস্কৃতিক মানোন্নয়নে-বিকাশে এবং আমাদের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন-সংগ্রামে, মুক্তিযুদ্ধে তিনি অসামান্য ভূমিকা রেখেছিলেন। বড় দাদা ইফতারের আগে আমাদের সব ভাই-বোনকে একত্র করে কাছারি ঘরে দরুদ শরিফ জোরে-জোরে পাঠ করাতেন। সমবেতভাবে আমরা দরুদ শরিফ পড়তাম। কোরাসে পঠিত সেই দরুদ শরিফ আজও আমার মুখস্থ রয়েছে।

ঈদের দিন তিনেক আগে বাড়িতে নাপিত এসে ঘাটার দুয়ারে পিঁড়িতে বসিয়ে একে-একে সবার চুল কাটছে। আমাকেও অন্যদের মতো পিঁড়িতে বসে চুল কাটতে হবে! শোনামাত্র ছুটে মায়ের কাছে গিয়ে পিঁড়িতে বসে চুল না কাটার বায়নায় কান্না জুড়ে দিই। অনেক চেষ্টার পরও কেউ আমাকে মানাতে না পারায় অগত্যা মনিচাচা সাইকেলের সামনে বসিয়ে ফৌজদার হাট রেলওয়ে স্টেশনের পার্শ্ববর্তী ডিপোর মুখ নামক স্থানের সেলুন থেকে চুল কাটিয়ে এনেছিলেন। রোজার মাঝামাঝিতে মনিচাচা আমাকে সঙ্গে নিয়ে রিয়াজুদ্দিন বাজার থেকে জামা-হাফ প্যান্টও কিনে দিয়েছিলেন। আজ তিনি নেই। কিন্তু আমাদের প্রতি তার অপরিসীম স্নেহ-ভালোবাসার স্মৃতি ভোলা যাবে না।

ঈদের চাঁদ দেখতে দল বেঁধে সমুদ্র তীরে ভিড় করতাম। গ্রামের পুরুষ মাত্রই সমুদ্র পারে চাঁদ দেখার অপেক্ষা করত। চাঁদ দেখামাত্র আনন্দে আত্মহারায় হল্লা-চিৎকার করে-করে বাড়ি ফিরতাম। রাত ৮টায় রিকশায় ব্যাটারিচালিত মাইকে ঈদগাহের নামাজের সময়সূচি ঘোষণায় বাড়ি-বাড়ি আসতেন ঈদগাহ সংশ্লিষ্ট একজন। তার সঙ্গে থাকতেন আমার দাদা বড় ছেলে জনাব এম.এ কুদ্দুস খাঁন।

তিনি রিকশা থেকে নেমে প্রতিটি বাড়ির ঘাটার দুয়ারে মাইক হাতে গাইতেন, ‘রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’ গানসহ ঈদকেন্দ্রিক অনেক গান। আমরা দল বেঁধে রিকশার পিছু পিছু ছুটতাম। গ্রামজুড়ে আগত ঈদের আনন্দের বার্তা পৌঁছে দিয়ে অনেক রাতে একত্রে বাড়িতে ফিরতাম। বাড়ি ফিরে দেখতাম মেয়েরা মেহেদি দিয়ে হাত রাঙাতে ব্যস্ত। গভীর রাত অবধি তারা একে-অপরকে মেহেদি লাগিয়ে দিত।

ঈদের দিন খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে কনকনে শীতে পুকুরে সবাই মিলে গোসল করে নতুন জামা গায়ে চাপিয়ে কাছারি ঘরে যেতাম। দাদা তুলায় আতর মাখিয়ে আমাদের সবার জামায় লাগিয়ে দিতেন। নতুন জামায় আতরের সুগন্ধি নাকে শুঁকতাম। জ্যাঠাবাবা আমাদের সবাইকে নিয়ে ঈদগা অভিমুখে রওনা হতেন। পথে স্থানীয় প্রচুর মানুষ দাদা অপেক্ষায় থাকতেন। দাদা সবাইকে নিয়ে বিরাট কাফেলাসমেত ঈদগার দিকে জোর কদমে এগিয়ে যেতেন। 

আল্লাহু আকবর-আল্লাহু আকবর তীব্র ধ্বনিতে আমাদের কাফেলা ঈদগাতে পৌঁছাত। উন্মুক্ত ঈদগায় সূর্যের তাপে বেশ আরাম অনুভূত হতো। ঈদগাহতে ইমামতি করতেন স্থানীয় হাফেজ মাওলানা মিজানুর রহমান। তার মুখটি আজও আমার স্মৃতিতে রয়েছে। খুতবা শেষে আমার দাদা সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিতেন। ঈদের নামাজ শেষে গণহারে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে-করে পিঠ ব্যথা হয়ে যেত। 

সমবয়সীদের সঙ্গে অবশ্য কোলাকুলি করতাম। ঈদগাহ থেকে বাড়িতে পৌঁছাতে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হতো কেবল গুরুজনদের সালাম করার কারণে। বাড়িতে এসে খাওয়া-দাওয়ার পর একত্রে সমবয়সীরা মিলে আত্মীয়-প্রতিবেশীদের বাড়িতে গিয়ে সালাম করতাম। সবাই খাবার খেতে তোড়জোর করতেন। যেখানে এড়ানো সম্ভব হতো না-সেখানে যৎসামান্য হলেও খাবার মুখে দিতে হতো। ঈদে নানা রকমারি খাবার-খেলনার পসরা সাজিয়ে ফেরিওয়ালারা গ্রামজুড়ে বিচরণ করত। পুরো গ্রাম ঘুরে ক্লান্ত-অবসন্ন হয়ে বাড়ি ফিরতাম।

বাড়ি ফিরেও নিস্তার নেই। দল বেঁধে ছুটতে হতো রিকশাযোগে দূরে বসবাসরত আত্মীয়-পরিজনদের বাড়িতে। মাদাম বিবির হাট থেকে কর্নেল হাট অবধি আত্মীয়দের সালাম করতে ছুটতাম। খাবারের জন্য সবাই জোর করত বটে কিন্তু আমাদের লক্ষ্য থাকত সেলামি প্রাপ্তিতে। সবার পকেটে কাঁচা পয়সা ঝন্-ঝন্ করত। বাড়িতে ফিরতে রাত হয়ে যেত। ঈদের এই সামাজিকতা এখনো ঝালকাঠিতে রয়েছে। ঈদে একে-অপরের বাড়িতে যাওয়া অপরিহার্য সামাজিকতা কেবল নয়, কর্তব্য-দায়িত্বপূর্ণ এবং বাধ্যবাধকতাও।

কেউ কোনো কারণে আত্মীয় বাড়িতে ঈদে সালাম করতে না গেলে তার নিস্তার নেই। তীব্র ভৎসনা শুনতে হবেই। আমার এক ফুফুর বাড়িতে এক জ্যাঠাতো ভাই ঈদের দিন না যাওয়ার কারণে পরদিন ফুফু এসে তাকে ইচ্ছেমতো ধোলাই দিয়েছিলেন। সব ফুফু ঈদের পরদিন দাদা-দাদিদের সালাম করতে আসতেন। এই যে সামষ্টিক ঈদের সামাজিকতা, এটা দেশের শহরগুলোয় খুঁজে পাওয়া যাবে না। একমাত্র ঝালকাঠিতে আজও রয়েছে। এ উৎসব-আনন্দের সমষ্টিগত সামাজিকতার ছবিটা আগের মতো এখন নেই সত্য; তবে গুরুজনদের ঈদকেন্দ্রিক সালাম করতে যাওয়ার রীতিটি সামান্য হের-ফেরে ঝালকাঠি ও বরিশালে রয়েছে।

ঈদ শেষে বরিশালে ফিরে আসার দিনটি ঘনিয়ে এলে ভীষণ মন খারাপ হয়ে যেত। বরিশালে খাঁচাবন্দি জীবনের সীমা ছাড়িয়ে উন্মুক্ত গ্রামে মাসের অধিককালমুক্ত বিহঙ্গের মতো কাটানো-কিশোর বয়সের অসামান্য প্রাপ্তিরূপেই গণ্য। গ্রাম, প্রকৃতি, সমুদ্র, খোলা মাঠ প্রাণবন্ত করে তুলত। ঢাকায় ফিরে আসার আগের রাতে নির্ঘুম গল্প করতাম, গলা জড়িয়ে কান্নাকাটিও করতাম। সকালে বাড়ি থেকে বের হওয়ার প্রাক্কালে বাড়িজুড়ে কান্নার রোল পড়ে যেত। অনেকে আমাদের বটতলী স্টেশনে একত্রে এসে বিদায় জানাত।

বাঁশি বাজিয়ে গাড়ি ছাড়ার মুহূর্তে আমরা কান্নায় ভেঙে পড়তাম। আমাদের দশা দেখে গাড়ির যাত্রীরা সমবেদনা পর্যন্ত জানাত। বরিশাল পর্যন্ত আমাদের কান্নার রেশ থাকত। বরিশালে ফিরে সঙ্গীদের চিঠি লিখতাম। ফিরতি ডাক পেতাম। প্রতি বছরান্তে ঝালকাঠি গ্রামের বাড়িতে যেতাম এবং ফেরার সময় একইভাবে সবাইকে কাঁদিয়ে-নিজেরা কেঁদে কেঁদে ফিরতাম। আমাদের সেই সামষ্টিক জীবনাচার এখন লুপ্তপ্রায়। যতটুকু রয়েছে স্মৃতিতে। বাস্তবে এখন আর তেমনটি নেই। না থাকাটা কারো দোষের নয়। দোষ ব্যবস্থার। যে ব্যবস্থা জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসেছে যেমন রাষ্ট্রে তেমনি সমাজে।

ব্যক্তিগত বা ব্যক্তিকেন্দ্রিক সংস্কৃতির প্রভাবে সমাজ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্নতা সর্বাধিক দৃশ্যমান। এই বিচ্ছিন্নতার মূলে অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং বিদ্যমান ব্যবস্থা। ব্যবস্থার পরিবর্তনেই বিচ্ছিন্নতার অবসান সম্ভব। নয়তো বিচ্ছিন্নতা আরো প্রকট ও ভয়াবহ রূপে আমরা অধিক মাত্রায় প্রত্যক্ষ করব। আমাদের ধারাবাহিক সমাজ কাঠামোর সব আন্তসম্পর্ক ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা। নীরব ঘাতকের মতো নিঃশব্দে পুঁজিবাদের বিস্তৃতি ও প্রসার ঘটেছে। সমাজ ও রাষ্ট্রের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে পুঁজিবাদ তার আগ্রাসী অপতৎপরতা নিশ্চিত করে ফেলেছে। ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার সর্বনাশী অপতৎপরতা সমাজে ভয়ানক মাত্রায় ছড়িয়ে পড়েছে, যা পুঁজিবাদেরই সৃষ্টি। সজাগ ও সচেতন না হলে পরিণতি আরো ভয়াবহ যে হবে সে বিষয়ে তো সন্দেহের অবকাশ নেই।

আমাদের সামাজিক ও পারিবারিক পরিম-লে পারস্পরিক সম্পর্ক, আসা-যাওয়া, দেখা-সাক্ষাৎ, খোঁজখবর নেওয়ার সংস্কৃতি ছিল। সেটা এখন লুপ্ত প্রায়। আত্মীয়-পরিজনদের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার প্রচলন ছিল সর্বাধিক। প্রত্যেকে-প্রত্যেকের সুখে-দুঃখে, ভালো-মন্দে পাশে থাকাও ছিল অতি আবশ্যিক। এখন তো কেবল সামাজিক অনুষ্ঠানে এবং কারো মৃত্যুকে উপলক্ষ করেই পারস্পরিক দেখা-সাক্ষাতের বিষয়টি আমরা প্রত্যক্ষ করে থাকি। আত্মীয় পরিজনদের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার রেওয়াজ এখন আর তেমন নেই।

এমনকি ধর্মীয় উৎসব-পার্বণে পর্যন্ত কেউ আর আগের মতো আত্মীয় বাড়িতে যায় না। সেই অনিবার্য সামাজিকতাও এখন নেই। মুঠোফোনে এসএমএস পাঠিয়ে কিংবা বড়জোর ফোনালাপে শুভেচ্ছা জ্ঞাপনে সামাজিক দায়িত্ব পালনের অদ্ভুত সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছে নিকট আত্মীয়-পরিজনের সান্নিধ্য-নৈকট্যের তাগিদ কেউ অনুভব করে না।

যতটুকু রয়েছে তা দায় মেটানোর সীমাবদ্ধতায়। অনাবিল আন্তরিকতা, ভালোবাসা, সৌহার্দ্য, সম্প্রীতির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। আমাদের চারপাশের প্রায় প্রত্যেকেই নিজেদের বিদ্যমান ব্যবস্থার উপযোগী করে তুলেছে। ব্যক্তিগত উন্নতি-প্রতিষ্ঠার পিছু অহর্নিশ ছুটে চলা। অন্যদিকে তাকানোর সময় পর্যন্ত কারো নেই। এই ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার অপর নামই বিচ্ছিন্নতা, যা আমাদের সমাজ-জীবনে স্থায়ী আসন পেতে বসেছে।

লেখক: শিক্ষার্থী, সরকারি ব্রজমোহন কলেজ, বরিশাল।


সর্বশেষ সংবাদ