‘বিদ্যা-বুদ্ধি চাইনা দেবী, বিদ্যা বালান দিও’
- খাঁন মুহাম্মদ মামুন
- প্রকাশ: ২৬ জানুয়ারি ২০২৩, ০৮:০৫ PM , আপডেট: ৩১ জানুয়ারি ২০২৩, ০৯:০১ PM
বাংলায় একটি শব্দ আছে তৎপর। যার সন্ধি বিচ্ছেদ হয় তদ্+পর; যার অর্থ দাঁড়ায় তাহার পরে কী। এখন ‘তাহার পরে কি’ সে জিজ্ঞাসায় বলতে হলে একটু পেছনে ফিরতে হবে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভালো করার পর এক শিক্ষক তার শিক্ষার্থীকে খোঁজ করছিলেন জিলা স্কুলে ভর্তির জন্য আলাদা করে পড়াবেন বলে; তিনি তাকে খুঁজে পাননি। ওই শিক্ষার্থী জিলা স্কুলে ভর্তির সুযোগ পাওয়ার পর তার শিক্ষকের সে অনুসন্ধানের বিশেষ কারণ জানতে পারে সেই শিক্ষার্থী। তারপর মাধ্যমিক, উচ্চ-মাধ্যমিক পার করে উচ্চশিক্ষা শেষ করা একজন বাংলাদেশি সদ্য তরুণের কাছে আপামর সাধারণ প্রশ্ন ‘তাহার পরে কি?’
জবাব, একটি চাকরি, ভালো চাকরি। চাকরির পরে কি? ভালো একটি সংসার, ছেলে-মেয়েদের ভালো স্কুলে ভর্তি করানো, তাদের মানুষ করা, বিদেশে একটি বাড়ি করা ইত্যাদি, ইত্যাদি। যদি আরও প্রশ্ন হয় তারপর? তারপর? তারপর?... এটি অনন্ত চালিয়ে নেয়া যাবে। এরনার্দো কাস্তেলে তার কবিতায় বলেছেন, ‘‘আমরা তারকা হইতে আসিয়াছি এবং তারকা-লোকেই ফিরিয়া যাইবো।’’ এখন তারকালোকে ফিরে যেতে হলে আমাদের প্রশ্ন করা যেতে এখানে পড়াশোনা করা বা না করার ‘পরম মান’ কত? বর্তমানে আমাদের এখানে যদি আপনি উচ্চশিক্ষার পরও কিছু করতে না পারেন, তাহলে আপনার পড়াশোনার পরম মান অঙ্ক-বিজ্ঞানের ভাষায় ‘জিরো’। এখানে আরও একটি কথা আসতে পারে, আপনি যদি কিছু করতে না পারেন বা কোনো কাজে নিজেকে নিযুক্ত করে অর্থ কামাতে না পারেন, তাহলে আপনি ‘বোকা’। এখন সমাজের অধিকাংশ মানুষই যদি বোকামি’তে নিমজ্জিত থাকে তাহলে বুঝতে বাকী থাকে না যে, সমাজের তল রসাতল হচ্ছে।
মিছা-মিছির (মিথ্যা কথার) হিসেবে দেশে উচ্চশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা প্রায় ৩২ লাখের মতো। জাতীয় পর্যায়ে দেশে তা তিন কোটির মতো। মিথ্যার তিন প্রকারের মধ্যে এটি একটি নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান। তাহলে এখানে হয় শিক্ষার্থীদের ভালো করে না শিখিয়ে ছেড়ে দিয়ে তাদের শিক্ষার মান ‘জিরো’ করা হয়েছে অথবা এখন করা হচ্ছে। তার যোগ্যতা নেই বলে আপনি তাকে চাকরি না দিলে যেমন তার পড়াশোনাকে অস্বীকার করা হচ্ছে। তেমনি তাকে আবার অযোগ্য বলে গালি দিলে বা সে আপনার নিয়ম ভাঙ্গতে না পারলেও তার পরম মান সে কথিত জিরোই থাকছে।
তাহলে, যাই করেন শিক্ষা-মাধ্যমে যদি টাকা না আসে তাহলে সবকিছুর পরম মান যদি শূন্যই হয় তাহলে আবারও পুরনো প্রশ্ন ‘তাহার পরে কি? এই গোলক ধাঁধার জবাব কাজী মোতাহের হোসেনের ভাষায় ‘শিক্ষার লক্ষ্য হচ্ছে মানুষকে মনুষ্যত্ব লোকের সাথে পরিচিত করা।’কিন্তু আমাদের এখানে সুকৌশলে ‘মানুষ’ বানানোর ধান্ধা করা হয়েছে ফলে এমন সমস্যা অর্থাৎ চাকরি-বাকরি পাওয়ার চাহিদা প্রধান চাওয়ায় পরিণত হয়েছে। এখন তার সমাধান হচ্ছে, পুরনো একই প্রশ্ন ‘তাহার পরে কি? তাহার পরের জবাব হচ্ছে, ‘আমরা তারকা লোকে ফিরিয়া যাইতে চাই।’
এখন আমি মানুষ বানালাম ‘তাহার পরে কি? তাহার পরে একটি উন্নত সমৃদ্ধ জাতি বানান; ‘তাহার পরে কি? তাহার আমাদের সাম্য, মানবিক মর্যাদা আর সামাজিক সুবিচার ফিরিয়ে দিন। ‘তাহার পরে কি? তাহার পরে, ‘এই দেশ আমাদের, ছোটদের-বড়দের, ধনীদের-গরীবের’- তাদের ফিরিয়ে দিন। তা-না হলে ‘আমাদের চামড়া নয় হাড়কে মুক্ত করে দিন; তাতে যদি আমরা তারকালোকে ফিরিয়া যাইতে পারি।
আমরা উন্নতি করছি এমন অর্ধসত্যের মাঝে দাঁড়িয়ে তিন নয়ন খুলিয়া দেখলে আমরা দেখতে পারবো-চীন, কিউবা কিংবা মালয়েশিয়া আমাদের চেয়ে এগিয়ে গেছে শিক্ষায়। আমাদের জাতীয়তাবাদের উত্থান ছিল ভাষা আন্দোলন; আমরা উর্দুতে শিখবো না বলেই বাংলার কথা বলেছিলাম। কিন্তু, এখন আমাদের আজব পদ্ধতিতে ইংরেজি শেখানো হচ্ছে। ১২ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করার পরও এখানে আমরা আমাদের শিক্ষার্থীদের ইংরেজি শেখাতে পারি না। এখন আমরা তা নিয়ে প্রশ্নও করতে পারি না, বলা হয়-‘ইংরেজি না পড়লে আমাদের ছেলেরা পিছিয়ে যাবে’। তাহলে, জিজ্ঞাসা হচ্ছে, চীন, মালয়েশিয়া, কোরিয়া, জাপান কিভাবে এগিয়ে যাচ্ছে? সে প্রশ্ন করলে আমাদের নানা ভাবে থামিয়ে দেয়া হয়। অপ্রয়োজনীয় একটি সত্য তথ্য হচ্ছে, ফিনল্যান্ডের একটি প্রাথমিকের স্কুল-পড়ুয়া শিক্ষার্থী বিদেশে যায় আঞ্চলিক ইংরেজি শিখতে।
হিসাব-নিকাশের জটিল ধাঁধায় আলো এক সেকেন্ডে এক লাখ ৮৬ হাজার মাইল যায়, তাহলে এক মিনিটে কতদূর, এক ঘণ্টায় কতদূর, একদিনে, এক মাসে, এক বছরে… হিসেব করতে করতে সাত হাজার কোটি আলোক বর্ষ দূরে ঊর্ধ্বলোকে গেলে আপনি এরনার্দো কাস্তেলের সেই ‘তাহার পরে=তারকালোকে’ খুঁজিয়া পাইবেন।
এখন উচ্চ-শিক্ষিত হয়ে যদি আপনি না জানেন পদ্মা সেতুর দৈর্ঘ্য কত? হানিফ ফ্লাইওভারের পিলার কয়টি বা বাঘের প্রস্রাবের পিএইচ কত? তখন আপনার পরম-মানও জিরো। কারণ, আপনি যতোই উচ্চশিক্ষিত হন না কেন, যতো বড়ো ডিগ্রিই আপনার থাকুক না কেন-চাকরি না পেলে এ সমাজ আপনাকে গ্রহণ করিবে না। তাহলে বিদ্যার দেবী সরস্বতীর কাছে আপনার চাওয়া কি-এমন জবাবে একজন তরুণ বলেছেন, ‘‘দেবী বিদ্যা-বুদ্ধি চাইনা, তুমি বরং বিদ্যা বালান দিও।’’