ডা. জাফরুল্লাহ’র মৃত্যুর ১০ দিনের মাথায় দখল গণস্বাস্থ্যের মেডিক্যাল কলেজ

দালালের মাধ্যমে অর্থ লেনদেনের চিত্র
দালালের মাধ্যমে অর্থ লেনদেনের চিত্র  © টিডিসি ফটো

অবৈধ দখলদারিত্ব, অর্থ লোপাট এবং স্বেচ্ছাচারিতার শিকার প্রয়াত ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত সাভারের গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিক্যাল কলেজ। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল এবং স্থানীয় এমপি সাইফুল ইসলামের প্রভাব খাটিয়ে খেয়ালখুশি মতো নিয়োগ, মাদকের আড্ডাসহ বিরোধী মনোভাবের ডাক্তার, নার্স এবং শিক্ষার্থীদের হুমকি ও নির্যাতন চালাত একটি সিন্ডিকেট। 

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মৃত্যুর মাত্র ১০ দিন পরেই মেডিক্যাল কলেজটি দখলে নেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র ট্রাস্টি বোর্ডের বর্তমান চেয়ারম্যান ডা. নাজিমুদ্দিন আহমেদ। এমনকি জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মৃত্যুর পর মেডিক্যালের প্রাপ্ত আয় ব্যাংক অ্যাকাউন্টে না রেখে সকল অর্থ মেডিক্যালের ভল্টে রেখে সেখান থেকে খেয়ালখুশি মত সেটা নিজেরা খরচ করত সিন্ডিকেটটি। 

সিন্ডিকেটের সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন মেডিক্যাল কলেজটির উপাধ্যক্ষ ডা. কবির উদ্দিন শিকদার, ১৮তম ব্যাচের ডা. সোহেল, পরিচালক ডা. সোহাগ, সিইও ডা. শাজাহান এবং চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত রলিফসহ বেশ কয়েকজন। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী সরকারের প্রভাবশালী নেতাদের সঙ্গে রেখেই এতদিন সকল অপকর্ম সামাল দিত সিন্ডিকেটটি। তবে সরকার পতনের পর সিন্ডিকেটটি স্থানীয় বিএনপি এবং যুবদলের নেতাকর্মীদের সহায়তা নতুন করে মেডিক্যাল কলেজটির দখল নেয়ার চেষ্টা করছেন বলে জানা যায়।

আরও পড়ুন: গণস্বাস্থের কিট নিতে যায়নি সরকারের কেউ

সর্বশেষ বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসা দিতে বাধা প্রদান করেন সংশ্লিষ্টরা। অভিযুক্তরা বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে শুরু থেকে বাধা প্রদান ও শিক্ষার্থীদের হামলা ও গুমের হুমকি দিয়েছিলেন। গত ৪ আগস্ট জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়, গণ বিশ্ববিদ্যালয়সহ আশপাশের আন্দোলনকারীরা পুলিশের গুলিতে আহত হয়ে চিকিৎসা নিতে গেলে তাদের বের করে দেয় সিন্ডিকেটটি। কর্তব্যরত ডাক্তাররা চিকিৎসা সেবা দিতে চাইলে তাদেরকে শাসান বর্তমান উপাধ্যক্ষ ডা. কবির উদ্দিন শিকদার, ডা. সোহেলসহ আরও কয়েকজন। 

গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিক্যাল কলেজ

মেডিক্যাল কলেজের বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী এবং ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তারা জানান—আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালীন এই চক্রটি নানাভাবে নিজেদের অপকর্ম চালিয়ে আসলেও ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর এই পুনরায় তারা নিজেদের দখলদারিত্ব বজায় রাখতে স্থানীয় বিএনপি এবং যুবদলের বেশকিছু নেতাকর্মীর সহায়তায় পুনর্গঠিত হতে থাকে। ফলে দখলদারিত্ব ঠেকাতে বর্তমানে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন। 

অভিযোগের বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির ২০তম ব্যাচের চিকিৎসক ডা. ইউছুফ ইসলাম চৌধুরী জানান, ‘আমি আন্দোলনের সময় সাভার থেকে একাধিক ফোন পেয়েছি ডা. সোহেল ও রলিফ তার সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে বাধা দিয়েছে। আহতদের চিকিৎসা দিতে চাইলে আমাদেরকে বাধা প্রদান করেছে। এখনও তারা আগামী শনিবারের আন্দোলনে হামলার জন্য দেশীয় অস্ত্র নিয়ে তৈরি হচ্ছে। তাদের সাহায্য করছে পাথালিয়া ইউনিয়নের যুবদলের কর্মী রাসেল।’

‘আসলে ব্যাংকে না রেখে মেডিক্যালের ভোল্টে এভাবে টাকা রাখাটা অবৈধ। ব্যাংক পলিসিতেও এটা এভাবে রাখা যায় না- গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিক্যাল কলেজের ডিরেক্টর ডা. মাহবুব জোবায়ের সোহাগ

এছাড়াও ৪ আগস্ট মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থীরা বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে সংহতি জানাতে গেলে তাদের উপর স্থানীয় সন্ত্রাসীদের নিয়ে হামলা করেন চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত মানবসম্পদ বিভাগের কর্মকর্তা রলিফ। আন্দোলনে যেতে শিক্ষার্থীদের বাধা প্রদান করেন উপাধ্যক্ষ ডা. কবির উদ্দিন শিকদার।  

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মানবসম্পদ বিভাগের কর্মকর্তা রলিফ জানান, ‘আমি গতকালকে (বৃহস্পতিবার) চাকরি থেকে অব্যাহতি দিয়েছি। আর আমার বিষয়ে যে-সব অভিযোগ আসছে সেগুলো সঠিক নয়। বরং আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের আমি সাধ্যমতো সহযোগিতা করেছি।’ তবে আকস্মিকভাবে চাকরি ছাড়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি জানান, ‘আমার মায়ের দেখভালের সমস্যা হচ্ছে। আর ব্যক্তিগতভাবে আমি টায়ার্ড, তাই নিজেকে কিছুটা সময় দিতে চাই।’ 

‘একটা সিন্ডিকেট আছে। এরমধ্যে নাজিম উদ্দিন আহমেদ নামের একজন ট্রাস্টি আছেন, তারা জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মৃত্যুর ১০ দিনের মাথায় প্রতিষ্ঠানের দখল নেয়। মেডিক্যালের আয় ব্যাংকে রাখার কথা থাকলেও এই সিন্ডিকেট সমস্ত টাকা নিজেদের কাছে রাখে—প্রয়াত ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর স্ত্রী শিরীন হক

এদিকে নিজের সম্পৃক্ততার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন মেডিক্যাল কলেজের উপাধ্যক্ষ কবির উদ্দিন শিকদার। সামগ্রিক বিশৃঙ্খলার জন্য তিনি ট্রাস্টিদের দায়ী করেছেন। তিনি জানান, ‘আন্দোলনের সময় আমি বিভাগীয় প্রধান হিসেবে নিয়োজিত ছিলাম। উপাধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ পেয়েছি গত বৃহস্পতিবার (১৫ আগস্ট)। কাজেই তখনকার অনেক বিষয় আছে, কিন্তু সেগুলো নিয়ে আমি তেমন কিছু বলতে পারছি না। মেডিক্যালের ডিরেক্টর ডা. মাহবুব জোবায়ের সোহাগ ভালো জানবেন। তবে ট্রাস্টি বোর্ডে যারা আছেন তারা বসে সমস্যাগুলো সমাধান করতে পারবেন। ট্রাস্টিরা না বসে সবাই নিজের মত করে মেডিক্যালের দখল নিতে আগ্রহী।’

এদিকে মেডিক্যালের ডিরেক্টর ডা. মাহবুব জোবায়ের সোহাগের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথমে বিষয়গুলো অস্বীকার করেন। তবে প্রমাণ থাকার কথা জানানো হলে নিজের সম্পৃক্ততা নেই দাবি করে তিনি বলেন, ‘আন্দোলনের সময় শিক্ষার্থীদের বাধা দেয়া হতে পারে। তবে এটাতে আমার কোন ভূমিকা ছিল না। উপাধ্যক্ষের সম্পৃক্ততা থাকলেও এখানে একটা বিভক্তি আছে। তবে এখানে আরও অনেকে জড়িত। ট্রাস্টিদের মধ্যে যে বিভক্তি আছে সেটাও একটা কারণ।’

মেডিক্যালের ভল্টে টাকা রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করে ডিরেক্টর ডা. মাহবুব জানান, ‘আসলে ব্যাংকে না রেখে মেডিক্যালের ভোল্টে এভাবে টাকা রাখাটা অবৈধ। ব্যাংক পলিসিতেও এটা এভাবে রাখা যায় না।’ তবে এসব ঘটনায় প্রিন্সিপাল ডা ইকবাল হোসেনের সাথে একাধিকবার মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। এছাড়া ট্রাস্টি বোর্ডের বর্তমান চেয়ারম্যান ডা. নাজিমুদ্দিন আহমেদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তার কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। 

আরও পড়ুন: বাজেট অনুমোদনের আগে প্রকাশ করা উচিত: ডা. জাফরুল্লাহ

অর্থ লোপাট এবং মেডিক্যাল দখলের বিষয়টির নিশ্চিত করেছেন প্রয়াত ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর স্ত্রী শিরীন হক। তিনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানান, ‘একটা সিন্ডিকেট আছে। এরমধ্যে নাজিম উদ্দিন আহমেদ নামের একজন যিনি নিজেকে ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে পরিচয় দেন। মূলত তিনি চেয়ারম্যান নয়। অধ্যাপক আলতাফুন্নেসা ২০১৬ সাল থেকে চেয়ারম্যান হিসেবে আছেন। তারা জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মৃত্যুর ১০ দিনের মাথায় প্রতিষ্ঠানের দখল নেয়। মেডিক্যালের যে আয় আসে সেটা ব্যাংকে রাখার কথা থাকলেও এই সিন্ডিকেট সমস্ত টাকা নিজেদের কাছে রাখে। নাজিমুদ্দিনের সহযোগী হিসেবে ডা. সোহেল নামে একজন আছে। তারা অনেককে অনৈতিকভাবে চাকরি দিয়েছেন। এছাড়া শাহজাহান, রলিফ, রনিসহ বেশ কয়েকজন এই সিন্ডিকেটের সাথে জড়িত।’

তিনি আরও যোগ করেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে এই সিন্ডিকেট থেকে আমরা মেডিকেলকে উদ্ধার করতে চাইলেও সম্ভব হয়নি। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল এবং স্থানীয় এমপি সাইফুল ইসলামদের সহযোগিতায় যে নামগুলোর কথা বলেছি তারা দখল ধরে রেখে খেয়ালখুশি মত সমস্ত অন্যায় করে গেছে। আমরা আইনের পথে এগুচ্ছি, এছাড়া আমাদের আর কোন উপায় নেই। কিন্তু আমরা পেরে উঠতে পারছি না এদের সাথে।’ 


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence