ছোটবেলার ঈদ উদযাপনে ন্যাচারাল ফ্লেভারের বিপরীতে এখন যান্ত্রিকতার ছোঁয়া লেগেছে

প্রত্যেক মানুষের শৈশব-কৈশরের ঈদের দিনগুলোর স্মৃতি সারা জীবন নাড়া দেয়। সেই ঈদের দিনগুলো এখনকার সময়ের মতো না হলেও এখনো মনে জেগে ওঠে। শৈশব-কৈশরের ঈদ স্মৃতি ও ঈদ উল ফিতরের শিক্ষা ও তাৎপর্য নিয়ে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের সঙ্গে কথা বলছেন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি জাহিদুল ইসলাম। সাক্ষাৎকারের চম্বুক অংশ তুলে ধরেছেন তানভীর নিশান-
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: ছোটবেলার ঈদ কেমন কাটত?
জাহিদুল ইসলাম: স্বাভাবিকভাবে বাংলাদেশের যে সংস্কৃতি, মুসলিম ভাবধারার মধ্য দিয়ে যে ঈদ উদযাপন সেটাই আমরা করতাম। পাশাপাশি আমার মনে আছে, ছোটবেলায় যখন প্রথম আমি যেদিন রোজা রেখেছিলাম, ঈদের ঠিক আগের দিন অর্থাৎ শেষ রোজা ছিল। সালটা ঠিক মনে নেই। সেই রোজা রাখার পরে ঈদের মধ্যে ব্যাপক একটা পার্থক্য খুঁজে পেয়েছিলাম।
সারামাস রোজা রাখার পর আল্লাহ তা’আলা রোজাদারদের জন্য ঈদের দিনটাকে বিশেষ আনন্দের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। সে বিষয়ের মধ্য দিয়ে ছোটবেলায় ঈদ কাটত। বিশেষ করে ছোটবেলায় যেটি ব্যতিক্রম ছিল, নতুন জামা, নতুন উপকরণ কেনার প্রতি একটা আগ্রহ থাকতো। এরপরে বন্ধুদের সাথে ঈদগাহে যাওয়া, বিভিন্ন খেলনা সামগ্রী কেনা, দুষ্টামি করা। আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া, ঈদের সালালি নেওয়া, মূলত এই সংস্কৃতির মধ্য দিয়েই ঈদগুলো কাটত।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: বড়বেলার ঈদের মধ্যে কী ধরনের পরিবর্তন অনুভব করেন?
জাহিদুল ইসলাম: আবেগ-উদ্দীপনার একটা জায়গা ছিল। স্বাভাবিকভাবে মানুষের বয়স বাড়ার সাথে সাথে এটা পরিবর্তন হয়। মনস্তাত্ত্বিকতার একটা পরিবর্তন ঘটে। শিশু থেকে কিশোর, কিশোর থেকে যুবক এটা একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে যে পরিবর্তন সেটা হয়েছে। আরও বড় পরিবর্তন যেটি মনে হয়, ছোটবেলায় একটা ন্যাচারাল ফ্লেভার ছিল সবকিছুর মধ্যে। বড় হয়ে কিছুটা যান্ত্রিকতা অনুভূব হয় এখন অনেক ক্ষেত্রে, সেটা পারস্পারিক সম্পর্কের দিক থেকে, সামাজিক বন্ধনের দিক থেকে। সকল দিক থেকে ন্যাচারাল ফ্লেভারের বিপরীতে একটা যান্ত্রিকতার ছোঁয়া যুক্ত হয়েছে।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: বড়বেলায় ঈদের কোন বিষয়গুলো মিস করেন?
জাহিদুল ইসলাম: সবকিছুর একটা আপেক্ষিকতা আছে। ছোটবেলার ঈদটা সে প্রেক্ষাপটে বেস্ট ছিল মনে হয়। যখন বড় হয়েছি এখনকার প্রেক্ষাপটে এটাই মনে হয় সবচেয়ে ভালো বা বেস্ট মনে হয়। আবার যখন বয়স হয়ে যাবে, আল্লাহ যদি হায়াত রাখেন, বুড়ো হয়ে যাব তখনকার প্রেক্ষাপটে সেটাই পারফেক্ট এমনটাই আমার কাছে মনে হয়।
স্বাভাবিকভাবেই সবার ক্ষেত্রে, সবার জীবনে যত বেশি অগ্রসর হচ্ছে মনে হচ্ছে পেছনের দিনগুলো অনেক বেশি ভালো কেটেছিল, অনেক বেশি আনন্দময় ছিল। শিশু বা কিশোর বয়সে একটা উদ্যেম কাজ করে এবং সেটার মধ্যে একটা নির্মোহ প্রাকৃতিক ফ্লেভার কাজ করে।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: শৈশবে ঈদের স্মরণীয় ঘটনা?
জাহিদুল ইসলাম: আমার দাদা তিনি আমাকে খুব আদর করতেন। আমার অন্য কাজিনদের থেকে আমাকে বেশি আদর করতেন। এটা আমি অনুভূব করতাম। মূলত ঈদের দিন আমার দাদা মারা গিয়েছিলেন, ঈদ উল ফিতরের দিন। তখন আমি ছোট ছিলাম, সম্ভবত ক্লাস টু কিংবা থ্রিতে পড়ি। মনে আছে এখনও সেই স্মৃতিটা। ঈদের নামাজ পড়ে এসে আমরা বেড়াতে যাব কোন একটা জায়গায় ঠিক সেই মুহুর্তে দাদা ইন্তেকাল করেন। সবাই কান্নাকাটি করছিলেন। সেই স্মৃতিটা বিশেষভাবে মনে রাখার মতো ঈদের দিনে।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: ঈদ নিয়ে সমাজকে কি বার্তা দেবেন?
জাহিদুল ইসলাম: আমরা ছোটবেলায় একটা বিষয় দেখতাম যে, সামাজিক সম্প্রীতির জায়গাটা অনেক বেশি শক্তিশালী ছিল। আমরা দেখেছি, আমাদের একই গ্রামে কেউ হয়ত আওয়ামী লীগের সাপোর্টার ছিল, কেউ বিএনপির ছিল, কেউ জামায়াতে ইসলামীর ছিল অথবা অন্যকোনো দলের সাপোর্টার ছিল। কিন্তু সামাজিক ইস্যুগুলোতে সবার একটা সম্প্রীতি কাজ করত। ঈদের দিন অনরকম একটা পরিবেশ কাজ করত। বিগত সময় আসলে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ যে পলিটিক্যাল কালচারটাকে নষ্ট করে দিয়েছে। সেজন্য সম্প্রীতিটা অনেকটাই বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে।
আমরা যেহেতু জুলাই-আগস্টের বিপ্লবের পর নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছি, আমি রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধর্ম, বর্ণ ও আদর্শের সকলকে আহবান করব, আমাদের সামাজিক বন্ধনগুলো যেন ফিরে আসে। ঈদকে কেন্দ্র করে সামাজিক ঐক্য গড়ে তোলা, দেশপ্রেমকে জাগ্রত করা, ইসলামী মূল্যবোধকে জাগ্রত করা এটি আমি রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে সকলের প্রতি অনুরোধ জানাবো।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: তরুণদের উদ্দেশ্যে কি বলবেন?
জাহিদুল ইসলাম: আল্লাহর রসুল (সা.) যখন মদিনায় হিজরত করলেন, দ্বিতীয় হিজরীতে, ৬২৪ খ্রিস্টাব্দে তখন মদিনায় জাহেলিয়াতের কিছু কালচার ছিল, তারা বিভিন্ন উৎসব পালন করত। সেসময় নওরোজ এবং মেহেরজান নামে দুটো উৎসব ছিল। আল্লাহর রসুল (সা.) তখন সাহাবীদের জিজ্ঞেস করলেন এটা কী হচ্ছে? সে সময় তারা বিভিন্ন নর্তকী, গায়িকাকে দিয়ে নাচ-গান কিছু অশ্লীল অঙ্গ-ভঙ্গি এগুলো দিয়ে তারা মূলত উদযাপন করত।
আল্লাহর রসুল (সা.) তখন বললেন, তোমাদের জন্য আমি দুটি আনন্দের উৎসব আমি ঘোষণা দিচ্ছি, একটা হলো ঈদ উল ফিতর ও আরেকটি হলো ঈদ উল আযহা। এই যে ঈদ উল ফিতর ও ঈদ উল আযহার যে ইতিহাসটা এটা মনে হয়, আমাদের সকল মুসলিমদের জানা উচিৎ, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের জানা উচিৎ।
এখন আমরা যদি সেই জাহেলিয়াতের কালচারগুলো ফলো করি। যেটা আমাদের সমাজে অনেকটা প্রতিষ্ঠিত যে ঈদ মানেই হলো যে চলচিত্র অঙ্গনে একটা মহা ধুম পরে যাওয়া, অশ্লীল অনেক কিছুই ঘটে থাকে যেটা সামাজিক মূল্যবোধের সাথে যায় না, ইসলামী মূল্যবোধের সাথে যায় না। আমি আশা করি, তরুণ প্রজন্ম সবাই অবগত আছেন, সচেতন আছেন।
ইতিহাস সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং আমাদের আত্মপরিচয় এবং আত্মসম্মানের জায়গাটাতে যদি আমরা সচেতন হতে পারি তাহলে নিজস্ব সংস্কৃতির মধ্যদিয়ে ঈদকে অনেক আনন্দবহ ও অর্থপূর্ণ করতে পারি। যেটা প্রচলিত কিছু চাপিয়ে দেয়ার সংস্কৃতি অথবা কিছুটা সাংস্কৃতিক গোলামীর জিঞ্জিরে আবদ্ধ হয়ে উদযাপন করা, সেখান থেকে বের হয়ে এসে আমরা নিজস্ব স্বকীয়তার মধ্য দিয়ে উদযাপন করব। এটিই আমি বার্তা দিতে চাই সকলকে।