ভালো বাংলা বলতে না পারায় হারান টিউশনি, আর্থিক টানাপোড়েন—সঞ্জুর চুপচাপ চলে যাওয়ার গল্প

সঞ্জয় বাড়াইক
সঞ্জয় বাড়াইক  © সংগৃহীত

ভালো বাংলা বলতে পারতেন না চা শ্রমিক পরিবারের মেধাবী ছেলে সঞ্জয় বড়াইক। এজন্য ক্যাম্পাস তো বটেই, মূল্য চুকাতে হয়েছে ব্যক্তিজীবনেও। চলে গিয়েছিল টিউশনি। শুধু কি তাই? নাহ! আর্থিক সমস্যাও ছিলও সঞ্জুর। প্রচণ্ড অর্থকষ্টে থাকলেও বুঝতে দিতেন না কাউকেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী সাঞ্জু। বাড়ি হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলার আহম্মদাবাদ ইউনিয়নের আমু চা বাগানের সাওতার লাইন এলাকায়। 

সঞ্জুর সংগ্রামী জীবন নিয়ে লিখেছেন তারই শিক্ষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জোবাইদা নাসরীন। তার ভাষ্য, ‘একদিন জানাল, তার টিউশনি চলে গেছে। কারণ, সে ভালো বাংলা বলতে পারে না। তার মাতৃভাষা তো বাংলা নয়। কেন আমরা তার কাছ থেকে বাংলা ভাষার শুদ্ধতা আশা করব? এক ভিন্ন ভাষাভাষী অঞ্চল থেকে সে এসেছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে।’ 

একবার মাঠ পর্যায়ের যাওয়ার আগে অনেকেই আর্থিক সমস্যা কথা জানালেও বলেননি সঞ্জু। সেই কথাও লিখেছেন ড. জোবাইদা। তার ভাষায়, ‘ওদের ব্যাচের কোর্স কো-অর্ডিনেটর ছিলাম। যেসব শিক্ষার্থী আর্থিক সমস্যার কথা জানিয়েছিল, তাদের তালিকায় সঞ্জু ছিল না। পরে সিআর জানাল, ওদের মধ্যে সবচেয়ে সংকটে আছে সঞ্জু। কিন্তু সঞ্জু সেটা প্রকাশ করতে চায়নি।’

তিনি আরও লিখেন, ‘ক্লাসে দেখা হলে শুধু মৃদু হাসি। যখন বলতাম, ‘সব প্রশ্নের উত্তর লেখ না কেন, সঞ্জু?’ তখনো হাসত—‘ওটুকুতেই হবে, ম্যাডাম।’ হয়তো সেই ‘ওটুকু’তেই সে খুশি থাকতে চেয়েছিল। কিন্তু শেষমেশ সেই ‘ওটুকু’ই তার হাত ফসকে পড়ে গিয়েছিল। আর সে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনি জীবনের তাগাদায়। শুধু আফসোস করতেই পারছি, সঞ্জু— তোমার সেই ‘ওটুকু’ নড়ে গিয়েছিল কীভাবে? কেন আমরা সেটা ফিরিয়ে দিতে পারলাম না? হয়তো তোমাকে ততটা ভালোবাসতে পারিনি, যতটা তোমার প্রয়োজন ছিল।’

সঞ্জুর বন্ধু ও নৃবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র হামিদুল হুদা স্টিভান দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলছিলেন, ‘সঞ্জুর মৃত্যু নিয়ে আমরা সবাই কনফিউজড। ওর ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইসিস ছিল। কিছুদিন আগে শুনলাম, একটা রিলেশন নিয়েও ক্রাইসিস চলছিল। আসলে সবকিছুই এত তাৎক্ষণিকভাবে ঘটে গেল, আমরা কিছুই বুঝতে পারিনি।’ হামিদুল আরও জানান, মৃত্যুর আগের রাতে বকশিবাজারে সরল নামে তার এক বন্ধুর বাসায় ছিল। সেখান থেকেই ভোরবেলায় হলে ফিরে ৫টা ৩৬-এর দিকে ছাদ থেকে পড়েন।

জানা যায়, আত্মহত্যার ৫ ঘণ্টা আগে একটি ফেসবুক স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন সঞ্জু। লিখেছিলেন, ‘আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি, আমি দিনের পর দিন কাউকে ডিস্টার্ব করে গেছি, উল্টো মানুষকে দোষারোপ করা আমার একদম ঠিক হয় নি, আমি সকলের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। আমি দিনের পর দিন অন্যায় করেছি, নিজের দোষ ঢেকে অপরজনকে দোষ দেয়া আমার ঠিক হয় নি। আমি সকলের কাছে ক্ষমা চাচ্ছি, আমার কারণে কারো কোনো ক্ষতি হলে সে দায় একান্তই আমার, আমি ক্ষমা চাচ্ছি।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জগন্নাথ হলের প্রভোস্ট দেবাশীষ পাল দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আনুমানিক ৫টা ৩৬ মিনিটে একজন ক্লিনার তার কাজ করতে গিয়ে তাকে (সঞ্জু) লাফ দিতে দেখে। পরবর্তীতে তা দারোয়ানকে জানালে সে আমাকে অবগত করে এবং অন্যান্যদের সহায়তায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। আমি ও হলের হাউজ টিউটরাও মেডিকেলে চলে যাই। তখন ডাক্তাররা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

তিনি বলেন, আমরা প্রথমে তার পরিচয় শনাক্ত করতে পারছিলাম না। পরবর্তীতে শাহবাগ থানা থেকে পুলিশ এসে তার পকেট থেকে একটা নৃবিজ্ঞান বিভাগের প্রশ্ন পায়। তারপর আমরা তার বিভাগের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের কাছ থেকে তার পরিচয় জানতে পারি সে ওই বিভাগের শিক্ষার্থী।


সর্বশেষ সংবাদ

X
APPLY
NOW!