‘টাকা ছাড়া এমপিও হয় না’—মতিঝিল মডেল কর্তৃপক্ষের অডিও ফাঁস

মতিঝিল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ
মতিঝিল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ  © ফাইল ছবি

শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে ‘দুর্নীতিগ্রস্ত মন্ত্রণালয়’ আখ্যা দিয়েছেন রাজধানীর মতিঝিল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের গভর্নিং বডির সদস্য শাহজাহান মৃধা কচি। সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটির নন-এমপিও শিক্ষকদের এমপিওভুক্তি নিয়ে একটি বৈঠকে এমন মন্তব্য করেন তিনি। যার একটি রেকর্ড সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। একই বৈঠকে প্রতিষ্ঠানটির গভর্নিং বডির সভাপতি ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক বিষয়ক সম্পাদক আবদুল মতিন ভূঁইয়া এমপিও প্রত্যাশী শিক্ষকদের বলেছেন ‘টাকা ছাড়া এমপিও হয় না’।

শিক্ষালয়টিতে বর্তমানে মোট শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের মধ্যে প্রায় ৪১ জন শিক্ষক আছেন, যাদের এমপিওভুক্তি হয়নি। তাদের এমপিওভুক্তির জন্য প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগের অংশ হিসেবে এ বৈঠক হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন প্রতিষ্ঠানটির বেশ কয়েকজন শিক্ষক।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে ‘দুর্নীতিগ্রস্ত মন্ত্রণালয়’ আখ্যা দিয়ে মতিঝিল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের গভর্নিং বডির সদস্য শাহজাহান মৃধা কচি বলেছেন, ‘প্রথমত এটা (এমপিওভুক্তি) ইমপার্শিয়াল করা হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় হচ্ছে একটি দুর্নীতিগ্রস্ত মন্ত্রণালয়, যতই আমি ইন্ফ্লুয়েন্স করি না কেন; টাকা যা দেওয়ার ছিল, নিয়েছিল।’

আরো বলেন, ‘মতিন ভাই (গভর্নিং বডির সভাপতি) সবসময়ই বলেছিল টাকা নিয়ে তুমি চিন্তা কইরো না। তুমি যতটুকু পার, আগায়া নিয়া (এগিয়ে নিয়ে) যাও। মতিন ভাই পুরো সার্পোটটাই (সমর্থন) দিয়েছিলেন। আমরা কিন্তু অনেক সময় নিয়েছি কাজটি করার ক্ষেত্রে।’

আমাদের অতীতের অভিজ্ঞতা হচ্ছে, টাকা ছাড়া এমপিও হয় না, এমপিও হতে হলে টাকা লাগে। যে টাকা দিবে তার এমপিও হবে, আর যে টাকা দিবে না তার এমপিও হবে না—আবদুল মতিন ভূঁইয়া, সভাপতি, গভর্নিং বডি, মতিঝিল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ।

বিষয়টি নিয়ে গভর্নিং বডির এ সদস্যের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বিষয়টি অস্বীকার করেন। শাহজাহান মৃধা কচি বলেন, তার বক্তব্য খণ্ডিত করে ছড়ানো হয়েছে। এটি তার বক্তব্য নয়। উদ্দেশ্যমূলকভাবে এমন কাজ করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।

তবে বৈঠকে থাকা মতিঝিল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাধিক শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে নিশ্চিত করেছেন, গভর্নিং বডির সভাপতি ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক বিষয়ক সম্পাদক আবদুল মতিন ভূঁইয়া, গভর্নিং বডির সদস্য শাহজাহান মৃধা কচি ও অধ্যক্ষ মাহফুজুর রহমান খান ওই বৈঠকে এসব বক্তব্য দিয়েছেন। বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া রেকর্ডটির সত্যতা রয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গত ১৬ নভেম্বর বৃহস্পতিবার দুপুর ১২ টায় মতিঝিল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের মূল শাখা এবং বাসাবো শাখার মোট ৩৭ জন শিক্ষক ও ৪ জন অফিস সহকারীসহ মোট ৪১ জন এ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। ওইদিন বৈঠকে থাকা প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষক ও অফিস সহকারিদের তালিকাও পেয়েছে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস।

বৈঠকে থাকা মতিঝিল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাধিক সদস্য জানিয়েছেন, প্রতিষ্ঠানটির মূল বিল্ডিংয়ের চতুর্থ তলার কম্পিউটার ল্যাবে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে উপস্থিত থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং সংশ্লিষ্টদের ঘিরে এসব বক্তব্য রাখেন প্রতিষ্ঠানটির গভর্নিং বডির সভাপতি আবদুল মতিন ভূঁইয়া, গভর্নিং বডির সদস্য শাহজাহান মৃধা কচি ও অধ্যক্ষ মাহফুজুর রহমান খান।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে দেশের মাধ্যমিক শিক্ষাস্তরের প্রতিষ্ঠানগুলোর তদারক সংস্থা মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) এবং একই স্তরের শিক্ষকদের তদারক প্রতিষ্ঠান বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ) স্পষ্ট করেই বলছে, শিক্ষকদের এমপিওভুক্ত হতে কোনো টাকা লাগে না।

শিক্ষক নিবন্ধনের আবেদন শুরু হলে সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করা হয় অনলাইনের মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয়। ফলে এখানে আর্থিক লেনদেনের কোনো সুযোগ থাকে না। আর কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির জন্য টাকা নিলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছে মাউশি।

এর আগে আর্থিক অনিয়ম, নিয়ম বহির্ভূত নিয়োগ-বদলি, শিক্ষকদের হয়রানি, ছুটি না দেওয়াসহ নানা অনিয়মে নিয়ে রাজধানীর অন্যতম নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মতিঝিল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষকরা অভিযোগ জানান শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বোর্ডে। প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অধ্যক্ষ এবং সভাপতির নানা নিয়মবহির্ভূত কর্মকাণ্ডে ডুবতে বসেছে প্রতিষ্ঠানটির সুনাম। এছাড়াও অনেক বিষয় গড়িয়েছে আদালত পর্যন্তও।

আরও পড়ুন: মতিঝিল মডেলে শিক্ষক নিয়োগের আগেই অনুমোদন-জালিয়াতি, ২৮ বছর পর মামলা

এখন প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষকরা প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনায় চাচ্ছেন, শিক্ষানুরাগী ও রাজনৈতিক পরিচয়ের বাইরে রয়েছেন এমন ব্যক্তিদের। যদিও এসব অভিযোগ মানতে নারাজ অভিযুক্তরা। অবশ্য প্রতিষ্ঠানটির এসব অনিয়ম নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ঢাকা শিক্ষা বোর্ডসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে বিচার ও চলমান সমস্যার সমাধান চেয়ে লিখিত জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষকরা।

এছাড়াও মতিঝিল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজে শিক্ষক নিয়োগের আগেই অনুমোদন-জালিয়াতির অভিযোগে একটি মামলা হয়েছে গত অক্টোবরে। ঘটনার প্রায় ২৮ বছর পর হওয়া ওই মামলায় ফেরত চাওয়া হয়েছে জালিয়াতির মাধ্যমে নিয়োগ প্রাপ্ত ওই শিক্ষকদের বেতনসহ গৃহীত সব সুযোগ-সুবিধা।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় হচ্ছে একটি দুর্নীতিগ্রস্ত মন্ত্রণালয়, যতই আমি ইন্ফ্লুয়েন্স করি না কেন; টাকা যা দেওয়ার ছিল, নিয়েছিল। মতিন ভাই (গভর্নিং বডির সভাপতি) সবসময়ই বলেছিল টাকা নিয়ে তুমি চিন্তা কইরো না—শাহজাহান মৃধা কচি, সদস্য , গভর্নিং বডি, মতিঝিল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ।

একই বৈঠকে মতিঝিল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মাহফুজুর রহমান খান বলেছেন, ‘বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন কথা শোনা যায় যে, এমপিও হতে এতো টাকা লাগে, এতো টাকা নেয়। এ বিষয়ে কচি ভাই (গভর্নিং বডির সদস্য) আগেই আপনাদের ক্লিয়ার করেছেন। যদি (এমপিওভুক্তির জন্য) টাকা লাগে, সেটা কমিটি দেখবে। আপনারাও বিভ্রান্তি ছড়াবেন না বা সে সুযোগ যেন সৃষ্টি না হয় সেদিকে আপনারা সজাগ থাকবেন।’

এছাড়াও একই মিটিংয়ের বক্তব্য রেখেছেন মতিঝিল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের গভর্নিং বডির বর্তমান সভাপতি ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক বিষয়ক সম্পাদক আবদুল মতিন ভূঁইয়া। সেখানে তিনি এমপিও প্রত্যাশী শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, ‘আমি প্রথম লগ্ন থেকেই আপনাদের বলেছি, এমপিও (হতে) হইতে কেন টাকা লাগবে। আমাদের অতীতের অভিজ্ঞতা হচ্ছে, টাকা ছাড়া এমপিও হয় না, এমপিও হতে হলে টাকা লাগে।’

তাঁর ভাষ্য, ‘যে টাকা দেবে তার এমপিও হবে, আর যে টাকা দেবে না তার এমপিও হবে না। এমপিওর জন্য টাকা লাগলে যে কমিটি করে দিয়েছি, কচিকে (গভর্নিং বডির সদস্য) বলেছি, সেটা আমরা ম্যানেজ করবো, না পারলে প্রতিষ্ঠান দেবে।’

আরও পড়ুন: মতিঝিল মডেলে শিক্ষার্থী নেমেছে অর্ধেকে, নেপথ্যে সিন্ডিকেট-অনিয়ম

আবদুল মতিন ভূঁইয়া বলছেন, ‘আপনাদের প্রতি আমার বিনীত অনুরোধ থাকবে, আপনারা এ বিষয়ে নিজেরা গিয়ে কোনো তদবির করবেন না। এ বিষয়ে আপনাদের যদি তদবিরের দরকার হয়, কোনো কিছু জানার দরকার হয় তাহলে আমরা যে কমিটি করে দিয়েছি তার কনভেনর কচি (গভর্নিং বডির সদস্য) সাহেব ওনার সাথে কথা বলবেন, আমাদের প্রধান শিক্ষক আছেন।’

তিনি আরো বলেছেন, ‘আর কোনো কারণে তাদের একন্তুই না ফেলে আমার সাথে কথা বলতে পারেন। এছাড়াও আমাদের অন্য সদস্যরা আচেন তাদের সাথে কথা বলতে পারেন। এখন আপনার যদি বলেন, আমি এমপিও না পাইলে অন্যদের হতে দেবে না, আগুন লাগিয়ে দেবো—এ মানসিকতা থেকে সরে আসতে হবে।’

বিষয়টি নিয়ে জানতে যোগাযোগ করা হয় মতিঝিল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের গভর্নিং বডির সভাপতি ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক বিষয়ক সম্পাদক আবদুল মতিন ভূঁইয়া, গভর্নিং বডির সদস্য শাহজাহান মৃধা কচি ও অধ্যক্ষ মাহফুজুর রহমান খানের সঙ্গে। এর মধ্যে শাহজাহান মৃধা কচি বিষয়টি অস্বীকার করলেও বাকিদের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মাধ্যমিক শাখার পরিচালক মোহাম্মদ বেলাল হোসাইন বলেন, বর্তমানে শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির পুরো প্রক্রিয়াটি অনলাইনে সম্পন্ন করা হয়। সেজন্য শিক্ষকদের কোনো টাকা দিতে হয় না। মতিঝিল মডেলের বিষয়টি অবগত হয়ে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে আমাদের কাছে লিখিত অভিযোগ জানালে আমরা বিষয়টি তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।’

এমপিওভুক্তির জন্য শিক্ষকদের কোনো অর্থ দিতে হয় কিনা—এমন প্রশ্নে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) সহকারী পরিচালক, (প্রশাসন, আইন ও সমন্বয়) লুৎফর রহমান বলেন, ‘আমরা শিক্ষকদের পরীক্ষাগ্রহন, সিলেবাস প্রণয়নসহ সংশ্লিষ্ট কার্যাবলি সম্পন্ন করে এমপিওভুক্তির জন্য সুপারিশ করি।’ বর্তমানে এমপিওভুক্তির জন্য কোনো অর্থ দিতে হয় না বলেও নিশ্চিত করেছেন এনটিআরসিএ’র এ কর্মকর্তা।


সর্বশেষ সংবাদ