নোবিপ্রবির শিক্ষক ড. শরিফুরের বিরুদ্ধে ৩৮ অভিযোগ, খতিয়ে দেখছে ফ্যাক্ট চেকিং কমিটি

ড. আ শ ম শরিফুর রহমান
ড. আ শ ম শরিফুর রহমান  © সংগৃহীত

স্বেচ্ছাচারিতা, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক ব্যবহার, বিভাগের প্রশাসনিক ক্ষমতা ব্যবহার করে নিজের স্বার্থ হাসিল করা, নোটিশ ছাড়াই একাডেমিক কমিটির মিটিং ডাকা, মার্ক টেম্পারিংসহ অভিযোগের পাহাড় উঠেছে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (নোবিপ্রবি) প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান ও সহযোগী অধ্যাপক ড. আ শ ম শরিফুর রহমানের বিরুদ্ধে। এ ছাড়া নিয়োগ-সংক্রান্ত জালিয়াতির অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। 

গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর ড. শরিফুর রহমানের বিরুদ্ধে পৃথক দুটি অভিযোগপত্রে মোট ৩৮টি অভিযোগ উল্লেখ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার বরাবর আবেদন করেন বিভাগটির শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। বর্তমানে এসব অভিযোগ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ফ্যাক্ট চেকিং কমিটিতে খতিয়ে দেখছে। সেখানে তদন্ত সাপেক্ষে এই শিক্ষক দোষী প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইসমাইল।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রাণিবিদ্যা বিভাগের এক শিক্ষক জানান, শরিফুর রহমান দীর্ঘদিন ধরে বিভাগের প্রশাসনিক ক্ষমতা ব্যবহার করে নিজের স্বার্থ হাসিল করছেন। বিভাগের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে অন্য শিক্ষকদের মতামতকে উপেক্ষা করে এককভাবে তিনি সিদ্ধান্ত। তাই তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার বরাবর অভিযোগ দেন।

প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষকরা প্রশাসন বরাবর যেসব অভিযোগগুলো জমা দেন, তা হলো—কোনো ধরনের নোটিশ ছাড়াই একাডেমিক কাউন্সিলের মিটিং ডাকা হয়, বিভাগীয় চেয়ারম্যানের অনেক দায়িত্ব থাকার পরও বেশির ভাগ গুরুত্বপূর্ণ কোর্সগুলো পড়ান, যদিও বিভাগে অন্য জুনিয়র শিক্ষক আছে, স্টাফদের তিনি নিজের প্রয়োজন ছাড়া অন্য শিক্ষকদের ব্যবহার করতে দেয় না, বিভাগের অন্য শিক্ষকদের নিয়ে শ্রেণিকক্ষে ছাত্রদের সামনে আলোচনা করা, কিছু শিক্ষকের সঙ্গে মিটিং করে অন্য শিক্ষকদের ওপর সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া, বিভাগের অন্য শিক্ষকদের জন্য বসার উপযুক্ত ব্যবস্থা না করে আগের বসার জায়গার চাবি নিয়ে নেওয়া। ফলে বিভাগীয় প্রধানের অনুপস্থিতে বিভাগের অন্য শিক্ষকরা বসার জায়গার সংকটে ভোগেন।

এ ছাড়া শিক্ষক ও কর্মচারীদের সঙ্গে অশোভনীয় আচরণ, বিভাগের অন্য শিক্ষকদের কোর্সগুলো তাদের সঙ্গে আলোচনা না করে গেস্ট শিক্ষকদের দিয়ে দেওয়া হয়। যদিও চেয়ারম্যান অনেকগুলো কোর্স নেওয়ার পরও সেখান থেকে কোনো কোনো কোর্স গেস্ট শিক্ষককে দেওয়া হয় না, বিভাগের ক্লাস, পরীক্ষা, ছুটি-সংক্রান্ত কোনো নিয়মনীতি নেই, বিভাগের শিক্ষকদের বিভিন্নভাবে হুমকি দেওয়া, বিভাগের অন্য শিক্ষকদের কম্পিউটার ও প্রিন্টারের ব্যবস্থা না করে বিভাগের কম্পিউটারে পাসওয়ার্ড দেওয়া ও ব্যবহার করতে না দেওয়া।

শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেন, ‘আমরা যতটুকু জানি, প্রাণিবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান ড. আ শ ম শরিফুর রহমান স্যার নোবিপ্রবির প্রাক্তন উপাচার্য অহিদুজ্জামান চাঁন স্যারের আমলে উপাচার্যের পিএ থেকে সহকারী অধ্যাপক পদে নিয়োগ পান। এ বিষয়টিসহ আরও কিছু বিষয়ে অভিযোগ সাপেক্ষে উনার বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের তদন্ত চলমান ছিল এবং তদন্ত চলমান থাকায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ উনাকে চেয়ারম্যানের পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তদন্তের কোনো ফলাফল ব্যতিরেকেই ওনাকে পুনরায় বিভাগের চেয়ারম্যানের পদে নিযুক্ত করা হয়।’

শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, ‘শরিফুর রহমান মার্ক টেম্পারিং করা ও পরীক্ষার মার্কিংয়ের ক্ষেত্রে পছন্দের শিক্ষার্থীকে অধিক গুরুত্ব দেন। সিটি কিংবা অ্যাসাইনমেন্টের ক্ষেত্রে সঠিকভাবে খাতা মূল্যায়ন না করা এবং ইচ্ছে অনুযায়ী মার্ক দেওয়া ও পরীক্ষার আগে নিজের পছন্দের শিক্ষার্থীদের প্রশ্নপত্র সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার বিষয়েও আমরা অবগত হই। তিনি একাই বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কোর্স নেন। একাডেমিক পাঠদানের ক্ষেত্রে তিনি নিজের লিখা নোটের অনুসরণ করতে বলেন এবং এর বাইরে কিছু লিখার ক্ষেত্রে অনুৎসাহিত করেন।’

শিক্ষার্থীরা আরও অভিযোগ করেন, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে হওয়া যেকোনো ব্যক্তিগত মতানৈক্য বা বিরোধের প্রভাব সেই শিক্ষার্থীর পরীক্ষার খাতায় মার্কিংয়ের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেন শরিফুর রহমান। কোনো শিক্ষার্থী ছোট ভুল করলেও সেটিকে কেন্দ্র করে তিনি অতিরিক্ত আগ্রাসী মনোভাব প্রকাশ করেন।’

এ ছাড়া শিক্ষাথীদের অন্য অভিযোগগুলো হলো: টেকনোলজি সম্পর্কে ন্যূনতম জ্ঞান না রাখা, পাওয়ার পয়েন্টে কখনোই স্লাইড না দেখানো, শিক্ষার্থীরা ল্যাবরেটরি-বিষয়ক সাহায্য চাইলে সেক্ষেত্রে অনুৎসাহিত করা, শিক্ষক-শিক্ষার্থী এবং কর্মচারীদের সামনে প্রায়ই বেফাঁস মন্তব্য করা, জাতীয় দিবসগুলোয় অনুপস্থিত থাকা, ব্যক্তিগত পছন্দের শিক্ষক কিংবা শিক্ষার্থীরা ধিক গুরুত্ব দেওয়া, শিক্ষক কিংবা শিক্ষার্থীদের মতামতকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া, আশপাশের পরিস্হিতি আমলে না নিয়ে যে কারো সম্পর্কে বিরূপ প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করা কিংবা সবার সামনেই সেই ব্যক্তিকে হেয়প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করা, কোনো কোর্স সম্পর্কে গভীর জ্ঞান না দেওয়া এবং সীমিত কিছু টপিক পড়িয়ে শেষ করে দেওয়া, গভীর জ্ঞান প্রদান না করায় শিক্ষার্থীর ভাইভা বোর্ডে প্রায়ই বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতে ব্যর্থ হয়, ভাইভা বোর্ডে অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করা এবং কোর্স-সম্পর্কিত প্রশ্ন করলেও তা একেবারেই নিম্নমান, কোনো বিষয়ে কারো সাথে মতপার্থক্য হলে তার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা, একাডেমিক কাজের তুলনায় প্রশাসনিক কাজের তুলনায় প্রশাসনিক কাজের প্রতি বেশি আগ্রহ প্রদর্শন করা, বিভিন্ন সময়ে একজনের কাছে অন্যজনের নামে উসকানি মূলক মন্তব্য করা ইত্যাদি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘বিভাগে একমাত্র পিএইচডি ডিগ্রীধারী হওয়া সত্ত্বেও শিক্ষক হিসেবে ওনাকেই (শরিফুর রহমান) সবচেয়ে কম যোগ্যতাসম্পন্ন মনে হয়। শুধু ওনার হাতে লেখা নোট ট্রান্সলেট করা ব্যতীত কোনো দিনই কিছু পড়িয়েছেন কি না, সন্দেহ আছে। আর সেই নোটেও অনেক সময়ই প্রশ্নের সঙ্গে উত্তরের কোনো সামঞ্জস্য থাকে না। এ ছাড়া কিছু শিক্ষার্থীকে উনি ব্যক্তিগত উদ্দেশ্যে ওনার নিজের কোর্স এবং অন্যান্য কোর্সের সেমিস্টার পরীক্ষার আগে প্রশ্ন সম্পর্কে ইঙ্গিত দেন। ওনার মতের সঙ্গে পার্থক্য তৈরি হলেই সবার সামনেই উনি খুবই বাজে ব্যবহার করেন এবং কিছু ক্ষেত্রে আপত্তিকর শব্দ ব্যবহার করেন, যা শিক্ষকের কাছ থেকে কোনো স্টুডেন্ট এর কাম্য নয়। ডেপ্টের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে ওনার কাছে অভিযোগ জানালেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই উনি সেগুলো এড়িয়ে যান।’

তিনি আরও বলেন, ‘বিভাগের চেয়ারম্যান রেজাল্টের ক্ষেত্রেও অপছন্দের শিক্ষার্থীদের ওনার কোর্সে আশানুরূপ ফলাফল না আসাও অনেকটাই ওনার ব্যক্তিগত ক্ষোভের ফলই নির্দেশ করে। রিসার্চের ক্ষেত্রেও উনি মুঠোফোনে কিংবা তৃতীয় ব্যক্তির সহায়তায়, বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার প্রলোভন দেখিয়ে অন্য ফিল্ডে রিসার্চ করতে আগ্রহী শিক্ষার্থীদের নিজের দিকে নিয়ে আসার প্রবণতাও দেখান। এ ছাড়া অনেকেই ওনার ভয়ে মুখ খুলতে চায় না। কারণ বিভাগের কিছু শিক্ষার্থীকে তিনি নিজের ফেভারে নিয়ে এসেছেন। কেউ ওনার বিরুদ্ধে কোনো কথা বললেই সেটা যেন সে জানতে পারে। তাই আমরা চাই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যাতে এ বিষয়ে খুব দ্রুত একটা ব্যবস্থা নেয়।’

অভিযোগের বিষয়ে মুঠোফোনে জানতে চাইলে প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রধান ড. আ শ ম শরিফুর রহমান বলেন, ‘আমি এখন ক্যাম্পাসের বাইরে একটা প্রোগ্রামে আছি। এখানে কথা বলা সম্ভব না। রবিবার ক্যাম্পাসে গেলে কথা বলব।’

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইসমাইল বলেন, ‘উনার (শরিফুর রহমান) বিষয়ে আমরা অভিযোগ পেয়েছি এবং তা ফ্যাক্ট চেকিং কমিটিতে পাঠিয়েছি। ফ্যাক্ট চেকিং কমিটির রিপোর্ট হাতে পেলে আমরা সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব।’


সর্বশেষ সংবাদ