শাবিপ্রবির ৩০০ শিক্ষার্থীর মাথার উপর এখনও ঝুুলছে সেই মামলা

ভিসিবিরোধী আন্দোলনের ২ বছর পার

২০২২ সালের জানুয়ারিতে প্রাধ্যক্ষের বিরুদ্ধে করা উপাচার্যবিরোধী আন্দোলনে রূপ নেয়
২০২২ সালের জানুয়ারিতে প্রাধ্যক্ষের বিরুদ্ধে করা উপাচার্যবিরোধী আন্দোলনে রূপ নেয়  © ফাইল ছবি

দুই বছর ধরে পুলিশের করা অজ্ঞাতনামা মামলার ভার বয়ে বেড়াচ্ছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) ২০০-৩০০ শিক্ষার্থী। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগ দাবিতে শিক্ষার্থীদের করা আন্দোলনে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে মামলাটি করে। ২০২২ সালে ১৮ জানুয়ারি করা মামলাটি এখনো চলমান রয়েছে বলে জানিয়েছেন জালালাবাদ থানার অফিসার ইনচার্জ মোহাম্মদ মিজানুর রহমান।

পুলিশের করা এ মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই মো. আসাদুজ্জামান বলেন, মামলাটি অনেক পুরনো। এ মামলার আপডেট জানতে হলে পুলিশের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। আমরা মূলত সেভাবে কথা বলতে পারি না। পরে মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার (উত্তর) মো. আজবাহার আলী শেখের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার থেকে কোনো ধরনের প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।

আমার দায়িত্বে থাকাকালীন সময়ে তদন্ত প্রক্রিয়া চলমান ছিলো। অবসরে যাওয়ার আগে পরে দায়িত্বশীলদের এ বিষয়ে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। - মুহাম্মদ ইশফাকুল হোসেন, সাবেক রেজিস্ট্রার ও তদন্ত কমিটির সদস্যসচিব

জানা যায়, ২০২২ সালের ১৩ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়টির বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের প্রাধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অসদাচরণসহ বিভিন্ন অভিযোগ তুলে তার পদত্যাগসহ তিন দফা দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন হলের কয়েকশ ছাত্রী। ১৬ জানুয়ারি বেলা পৌনে ৩টার দিকে উপাচার্যকে অবরুদ্ধ করেন শিক্ষার্থীরা।

উপাচার্য তার কার্যালয় থেকে বের হয়ে ডিনদের এক সভায় যাওয়ার সময় শিক্ষার্থীদের ক্ষোভের মুখে পড়লে সঙ্গে থাকা শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা তাকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিটি ভবনে আশ্রয় নেন। পরে শিক্ষার্থীরা ওই ভবনের প্রধান ফটক অবরুদ্ধ করে স্লোগান দিতে থাকেন। বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে পুলিশ উপাচার্যকে মুক্ত করতে ভবনের ভেতরে ঢুকতে চাইলে আন্দোলনকারীরা বাধা দেন।

তখন বাগ্‌বিতণ্ডার একপর্যায়ে পুলিশ রাবার বুলেট ও সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ার পাশাপাশি লাঠিপেটা করে শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করে উপাচার্যকে মুক্ত করে তার বাসভবনে নিয়ে আসে।

এরপর এই আন্দোলন উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে রূপ নেয়। শিক্ষার্থীরা ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করে নানা কর্মসূচি দিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকেন। সে সময় টানা এক মাস আন্দোলনের পর তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি পাঁচ দফা দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাস দিলে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন থেকে সরে আসেন।

আন্দোলনে সক্রিয় থাকা অনেক শিক্ষার্থীর এখন পড়াশোনা শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু এখনো এ ধরনের ঝামেলা থেকে গেছে। আমাদের শিক্ষার্থীরা এটা নিয়ে চরমভাবে হশাতাগ্রস্থ। -মুহাইমিনুল বাশার রাজ, মুখপাত্র, ভিসিবিরোধী আন্দোলন

এ ঘটনায় জরুরি সিন্ডিকেট সভায় অধ্যাপক ড. মো. রাশেদ তালুকদারকে সভাপতি ও তৎকালীন রেজিস্ট্রার মো. ইশফাকুল হোসেনকে সদস্যসচিব করে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সব অনুষদের ডিন এবং শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক তুলসী কুমার দাসকে ওই কমিটির সদস্য করা হয়। তবে দুই বছর অতিবাহিত হলেও কোনো ধরনের প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি এ কমিটি। তদন্ত প্রক্রিয়ার নিয়েও কোনো তথ্য জানাতে পারেননি কমিটির সদস্যরা।

এদিকে, পুলিশের করার মামলাটিও চলমান রয়েছে। দুই বছরের আগের একটি ঘটনা এখনো সমাধান না হওয়ায় অনেকটা উদ্বিগ্ন সেসময়ে আন্দোলনে সক্রিয় থাকা শিক্ষার্থীরা। ইতিমধ্যে তাদের অনেকের এখন পড়াশোনা শেষ হয়ে গেছে। ক্যাম্পাস থেকেও অনেকে বেরিয়ে গেছেন। কিন্তু এখনো অজ্ঞাতনামা মামলার ভার তাদের মাথার উপর থেকে গেছে। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও কোনো তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়নি।

শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলনে ডোনেট করার অভিযোগে মামলা হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন কয়েকজন শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধেও। তাদের মামলাটি আপোসে তুলে নেওয়া হয়েছে। ভিসিবিরোধী আন্দোলনের মুখপাত্র মুহাইমিনুল বাশার রাজ দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, এ আন্দোলন প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের নামেও একটা মামলা ছিলো। পরে কয়েকজনকে তুলে নেওয়া হয়। একটা সময় তাদের এ মামলা আপোস নামা দিয়ে তুলে নেওয়া হয়েছে। গ্রেপ্তারকৃতদেরও ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

তবে এখনো অজ্ঞাতনামা ২০০-৩০০ শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে করা মামলাটি ঝুলে আছে। মুহাইমিনুল বলেন, পুলিশের করা মামলাটি নিয়ে আগে আমাদের সঙ্গে গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের কথা হতো। একটা সময় সেটাও বন্ধ হয়ে যায়। মামলাটির এখন কি অগ্রগতি, সে সম্পর্কে আমাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। আন্দোলনের সক্রিয় থাকা অনেক শিক্ষার্থীর এখন পড়াশোনা শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু এখনো এ ধরনের ঝামেলা থেকে গেছে। প্রশাসনও বিষয়টি নিয়ে কোনো ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে না। আমাদের শিক্ষার্থীরা এটা নিয়ে চরমভাবে হশাতাগ্রস্থ।

জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান (ভারপ্রাপ্ত) রেজিস্ট্রার ফজলুর রহমান দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও একাধিক মামলা আছে। এরকম যখন যেটা সামনে আসে তখন আসলে সেটা কথা বলার সুযোগ থাকে। শিক্ষার্থী সংশ্লিষ্ট পুলিশের এ মামলাটি যেহেতু দুই বছর আগের, আর আমি নতুন দায়িত্ব নেওয়ায় আমার এ বিষয়ে তেমন জানাশোনা নেই। খোঁজখবর নিয়ে এ বিষয়ে জানতে হবে।

মামলাটি অনেক পুরনো। এ মামলার আপডেট জানতে হলে পুলিশের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। আমরা মূলত সেভাবে কথা বলতে পারি না। -পুলিশের করার মামলার তদন্ত কর্মকর্তা

বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন রেজিস্ট্রার ও এ ঘটনার তদন্ত কমিটির সদস্যসচিব মুহাম্মদ ইশফাকুল হোসেন বর্তমানে অবসরে আছেন। জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার দায়িত্বে থাকাকালীন সময়ে তদন্ত প্রক্রিয়া চলমান ছিলো। অবসরে যাওয়ার আগে পরে দায়িত্বশীলদের এ বিষয়ে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন যারা দায়িত্বশীল আছেন, তারা এ বিষয়ে ভালো বলতে পারবেন।

এ বিষয়ে কথা বলতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের গঠিত তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক ও গণিত বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. রাশেদ তালুকদারের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়েছে। তিনি ব্যস্ত আছেন বলে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। আর এ বিষয়ে উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদকে মুঠোফোনে ক্ষুদেবার্তা পাঠানো হলে তার পক্ষ থেকেও প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়া পর্যন্ত কোনো ধরনের প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।


সর্বশেষ সংবাদ