মুঠোফোন হ্যাকিংয়ের ভয় করছেন! জেনে নিন প্রতিরোধের উপায়
- টিডিসি ডেস্ক
- প্রকাশ: ০৬ জুলাই ২০২৪, ০৮:০০ PM , আপডেট: ০৬ জুলাই ২০২৪, ০৮:০০ PM
পকেট বা ব্যাগে, আমরা প্রতিনিয়ত সঙ্গে নিয়ে ঘুরছি স্মার্টফোন। অপরদিকে সাইবার অপরাধীরা স্মার্টফোনে থাকা ব্যক্তিগত তথ্য চুরি করে। পরে সেগুলোকে হাতিয়ার হিসেবে কাগে লাগিয়ে ব্যাবহারকারীদের আর্থিক সমস্যা কিংবা অসম্মানজনক ক্ষতি সাধন করার চেষ্টা করে থাকে। হাতের মুঠোয় পুরো যোগাযোগ ব্যবস্থা জালের মতো হওয়ার ভালো দিক হচ্ছে যোগাযোগের সহজলভ্যতা।
তবে এই ভালোটাই আবার মন্দে পরিণত হয় যখন মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য সেই জালের ভেতর ছড়িয়ে পড়ে। এই বিড়ম্বনারই আরেক নাম মোবাইল ফোন হ্যাকিং। তাই ডিজিটাল নিরাপত্তা রক্ষায় নতুন স্মার্টফোনটিতে আগে থেকেই প্রতিরক্ষামূলক বেষ্টনী স্থাপন করা জরুরি। চলুন, মোবাইল ফোন হ্যাকিং প্রতিরোধে করণীয়গুলোর পাশাপাশি জেনে নেওয়া যাক কোনো কোনো অবস্থায় মোবাইল ফোন হ্যাক হতে পারে।
ফিশিং লিঙ্ক
ফিশিং আক্রমণগুলো সাধারণত প্রতারণামূলক ইমেল, এসএমএস বা ফোন কলের মাধ্যমে ঘটে। হ্যাকাররা বৈধ সত্তার বেশে বিভিন্ন সেবা প্রদানের কথা বলে বা প্রলোভন দেখিয়ে ফোন ব্যবহারকারীদের লগইন আইডি, পাসওয়ার্ড, ক্রেডিট কার্ডের বিশদ বিবরণের মতো সংবেদনশীল তথ্য নিয়ে নেয়। অতঃপর এগুলো দিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যবহারকারীকে জিম্মি করে হ্যাকাররা নিজেদের স্বার্থ হাসিল করে।
ম্যালওয়্যার আক্রমণ
ক্ষতিকারক সফটওয়্যার বা ম্যালওয়্যার মোবাইল ফোনের নিরাপত্তার জন্য একটি মারাত্মক হুমকি। এগুলো সক্রামক রোগের মতো ব্যবহারকারীর অজান্তেই তার ফোনে প্রবেশ করে মোবাইল অ্যাপলিকেশন বা অ্যাপের মাধ্যমে। ডাউনলোড করার সময় ব্যবহারকারী ঘুণাক্ষরেও টের পান না যে এটা আসলে একটা ম্যালওয়্যার। একবার ইনস্টল হয়ে গেলেই ম্যালওয়্যার ব্যক্তিগত তথ্য চুরি করার ক্ষমতা অর্জন করে। এ সময় ম্যালওয়ার নির্মাতা ফোন ব্যবহারকারীর যাবতীয় ক্রিয়াকলাপ দেখতে পারে। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে ডিভাইসের নিয়ন্ত্রণও নিয়ে নিতে পারে।
অরক্ষিত ওয়াই-ফাই নেটওয়ার্ক
পাবলিক ওয়াই-ফাই নেটওয়ার্ক, বিশেষ করে যেগুলোর যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই, এ জায়গাগুলো হ্যাকারদের জন্য স্বর্গক্ষেত্র। ব্যবহারকারীরা যখন এই নেটওয়ার্কগুলোর মাধ্যমে তাদের ব্যক্তিগত কোনো ছবি, ভিডিও বা অন্য কোনো তথ্য প্রেরণ করে তখন মাঝপথেই সেগুলো আটকাতে পারে সাইবার অপরাধীরা। তারপর তথ্যগুলোর গন্তব্য বদলে নিজেদের কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে নিয়ে আসে। এছাড়া জাল নেটওয়ার্ক সেট আপ করে বা প্যাকেট স্নিফিং টুল ব্যবহার করে হ্যাকাররা পাসওয়ার্ড এবং আর্থিক তথ্যসহ বিভিন্ন সংবেদনশীল তথ্য দেখে নিতে পারে।
মোবাইল ফোনের তথ্য সংরক্ষণে করণীয়
টু-ফ্যাক্টর অথেন্টিকেশন(টুএফএ) সক্রিয় রাখা
টু-ফ্যাক্টর অথেন্টিকেশন মানে পাসওয়ার্ড দেওয়ার পরেও অ্যাকাউন্টে প্রবেশের জন্য দ্বিতীয়বার প্রবেশকারীর পরিচয় যাচাই করা। ফোনের মূল ব্যবহারকারীর যে কোনো একটি আঙ্গুলের ছাপ স্ক্যানের মাধ্যমে করা হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিবন্ধিত ফোন নাম্বারে পাঠানো ওটিপি (ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড) এর মাধ্যমেও করা হয়ে থাকে। এই কোডটি অনন্য হয় এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই তা নিস্ক্রিয় হয়ে যায়। ফলে খুব কম সময়ের মধ্যেই এই কোডটি দিয়ে অ্যাকাউন্টে প্রবেশ করতে হয়। এই টুএফএ পদ্ধতিটি মোবাইল ফোন হ্যাকিং-এর বিরুদ্ধে এক দুর্গ সদৃশ।
শক্তিশালী ও অনন্য পাসওয়ার্ড ব্যবহার করা
মোবাইল ফোনের জন্য কমপক্ষে আট ক্যারেক্টারের আলফানিউমেরিক পাসওয়ার্ড তৈরি করুন। এর মানে বড় ও ছোট হাতের অক্ষর, সংখ্যা এবং বিশেষ অক্ষর মিলিয়ে পাসওয়ার্ডটিকে শক্তিশালী করে তুলুন। নিজের জন্ম তারিখ বা ফোন নাম্বারের শেষে দুই-চারটি অক্ষরের মতো সাধারণ পাসওয়ার্ড তৈরি করা এড়িয়ে চলুন, কেননা এগুলো সহজেই অনুমান করা যায়। উপরন্তু, বিভিন্ন অ্যাপসে নিবন্ধিত অ্যাকাউন্টের জন্য ভিন্ন পাসওয়ার্ড ব্যবহার করুন। আর এই পাসওয়ার্ডগুলো কয়েক মাস পর পর পরিবর্তন করে নতুন শক্তিশালী পাসওয়ার্ড দিতে ভুলবেন না।
অ্যাপ ইনস্টল করার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা
শুধুমাত্র অফিসিয়াল অ্যাপ স্টোর (গুগল প্লে স্টোর, অ্যাপল অ্যাপ স্টোর) এর মতো বিশ্বস্ত উৎস থেকে অ্যাপ ডাউনলোড করুন। অ্যাপগুলো ডাউনলোড করার আগে ভালোভাবে সেগুলো যাচাই করে নিন। এর জন্য অ্যাপগুলো ব্যবহারকারীদের রিভিউ পড়া যেতে পারে। ডেভেলপাররা অ্যাপটি নির্দিষ্ট সময়মতো আপডেট করছে কি না, কোনো সমস্যার কথা জানালে তারা ঠিক মতো সাড়া দিচ্ছে কি না- এগুলো খুঁটিয়ে দেখুন। পুরানো বা একদম নতুন অ্যাপ ডাউনলোড করা এড়িয়ে চলুন।
যে কোনো লিঙ্কে ক্লিক করা থেকে দূরে থাকা
সন্দেহজনক ইমেল, বার্তা বা পপ-আপ থেকে সতর্ক থাকুন, কেননা এগুলো ব্যক্তিগত তথ্য, পাসওয়ার্ড বা আর্থিক বিবরণের জন্য জিজ্ঞাসা করে। লিঙ্কগুলোতে ক্লিক করা বা অজানা উৎস থেকে কোনো কিছু ডাউনলোড করা এড়িয়ে চলুন। বৈধ উৎসগুলো এভাবে সংবেদনশীল তথ্যের জন্য অনুরোধ করে না।
নিরাপত্তামূলক সফটওয়্যার ইনস্টল করা
একটি মোবাইল নিরাপত্তা অ্যাপ ইনস্টল করুন, ইতোমধ্যে ইন্ডাস্ট্রিতে যার সুখ্যাতি রয়েছে। এ ধরনের অ্যাপ ম্যালওয়্যার শনাক্তকরণ, অ্যান্টি-ফিশিং সুরক্ষা এবং নিরাপদ ব্রাউজিংয়ের মতো সুবিধাগুলো দিয়ে থাকে। যে কোনো হ্যাকিং হুমকির বিরুদ্ধে সর্বদা সুরক্ষিত থাকতে নিয়মিত এই অ্যাপ আপডেট করুন।
পাবলিক ওয়াই-ফাই ব্যবহারের সময় ভিপিএন ব্যবহার করুন
পাবলিক ওয়াই-ফাই নেটওয়ার্কগুলো প্রায়ই অরক্ষিত থাকে, অর্থাৎ এগুলোর মাধ্যমে হ্যাকাররা সহজেই তথ্যের লেনদেনে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। এক্ষেত্রে ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক বা ভিপিএন প্রয়োজনীয় তথ্যগুলো এনক্রিপ্ট বা একটি সংকেতের মোড়কে ভরে প্রেরণ করে। এতে করে হ্যাকারদের জন্য তথ্য চুরি করা তুলনামূলকভাবে আরও কঠিন হয়ে যায়।
গুগল প্লে-স্টোর বা অ্যাপলের অ্যাপ-স্টোরে ভালো ভিপিএন অ্যাপগুলো পাওয়া যাবে। ভিপিএন অ্যাপ ইনস্টল করার পর পাবলিক ওয়াই-ফাই ব্যবহারের আগে ভিপিএন সার্ভারের সঙ্গে সংযোগ করে নিন।
হ্যাক হওয়া ফোন পুনরুদ্ধার করার উপায়
সন্দেহজনক অ্যাপলিকেশন সরিয়ে ফেলা
মোবাইল ফোনের কোনো অ্যাপ নিয়ে সন্দেহ জাগলে সঙ্গে সঙ্গেই তা সরিয়ে ফেলুন। অনেক সময় এমন কিছু অ্যাপ পাওয়া যায় যেগুলো ব্যবহারকারী নিজে ইনস্টল করেননি। এমনকি সেগুলো মোবাইল ফোনের ফটো, কন্টাক্ট, লোকেশনে অনুমতি প্রাপ্ত থাকে। এ ধরনের অ্যাপগুলো অবিলম্বেই সরিয়ে ফেলুন। প্রাথমিক অবস্থাতেই যদি চোখে না পড়ে, তাহলে ফোন অপারেশন জনিত কোনো ঝামেলা হলে সঙ্গে সঙ্গেই এগুলো খুঁজে বের করে ডিলিট করুন।
ফিশ ফাইল সরিয়ে ফেলা
ফোনে কোনো ফিশ ফাইল আছে কি না সুক্ষ্মভাবে যাচাই করুন। এগুলো এমন ফাইল হতে পারে যেগুলোকে সচরাচর চিনতে পারা যায় না, অথবা সেগুলোর অদ্ভুত নাম বা এক্সটেনশন রয়েছে। এই ফাইলগুলো অনুসন্ধানের জন্য একটি ফাইল এক্সপ্লোরার অ্যাপলিকেশন ব্যবহার করা যেতে পারে। অতঃপর এগুলো খুঁজে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মুছে ফেলুন।
অ্যাপ থেকে অ্যাডমিন অ্যাক্সেস নিষ্ক্রিয় করা
অ্যাপগুলো হচ্ছে স্মার্টফোনে সাইবার অপরাধীদের প্রবেশদ্বার। ফোনের সকল অ্যাপের জন্য অ্যাডমিন অ্যাক্সেস সক্রিয় থাকলে নতুন ইন্সটল করা অ্যাপগুলোতেও অ্যাডমিন অ্যাক্সেস স্বয়ংক্রিয়ভাবে সচল হয়ে যেতে পারে। আর হ্যাকাররা একবার অ্যাপের মাধ্যমে ফোনে ঢুকে পড়লে সেই অ্যাডমিন অ্যাক্সেসটাও পেয়ে যায়। অর্থাৎ পুরো ফোনের নিয়ন্ত্রণ এখন তাদের হাতে।
তাই অ্যাডমিন অ্যাক্সেস নিষ্ক্রিয় করতে প্রথমে ফোনের সেটিংসে যেতে হবে। সেখানে ‘সিকিউরিটি’ বিভাগের ভেতরে ‘ডিভাইস অ্যাডমিনিস্ট্রেটর’ এর অধীনে অ্যাডমিন অ্যাক্সেস আছে এমন অ্যাপগুলোর একটি তালিকা দেখা যাবে। সেখান থেকে যেগুলোকে অনির্ভরযোগ্য মনে হচ্ছে সেগুলো থেকে অ্যাডমিন অ্যাক্সেস প্রত্যাহার করতে পারবেন।
সর্বসাকুল্যে, পুরো বিশ্বটা হাতের মুঠোফোনে চলে আসাটা নিঃসন্দেহে আশীর্বাদ। কিন্তু এর সূত্র ধরে যে বিপত্তিগুলো দানা বেধে উঠছে, সে ব্যাপারে যথাযথ সতর্কতা সময়ের দাবি। সেখানে মোবাইল ফোন হ্যাকিং প্রতিরোধে করণীয় অনুসারে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ আরো উপভোগ্য করে তুলতে পারে প্রযুক্তির সান্নিধ্যকে। তখন এই ছোট্ট ডিভাইস দিয়ে লেনদেন, কথোপকথন, তথ্য সংরক্ষণ- সবকিছুই হবে নির্ভয়ে ও নির্ভরতায়।