ক্ষুদ্র ও মাঝারি খামারিদের জন্য স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করার দাবি

ক্ষুদ্র ও মাঝারি খামারিদের জন্য স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করার দাবি
ক্ষুদ্র ও মাঝারি খামারিদের জন্য স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করার দাবি  © সংগৃহীত

ডিমের দাম কমে যাওয়ায় লোকসানের মুখে পড়েছেন ক্ষুদ্র ও মাঝারি লেয়ার (ডিমপাড়া মুরগি) খামারিরা। এমন পরিস্থিতিতে ডিমের যৌক্তিক দাম নির্ধারণ, বিদ্যুৎ বিলে ২০ শতাংশ রিবেট প্রদান, সরকারি মনিটরিংয়ে ডিম সংরক্ষণের ব্যবস্থা, খামারিদের নগদ আর্থিক প্রণোদনা প্রদানসহ ৮টি প্রস্তাব জানিয়েছে বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন (বিপিআইএ)।

সম্প্রতি মিরপুর ডিওএইচএস-এ বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ‘বিপিআইএ’র নেতৃবৃন্দ এই প্রস্তাব জানান।

সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহ হাবিবুল হকের সভাপতিত্বে লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন সংগঠনের মহাসচিব খন্দকার মহসিন।

এ সময় বক্তারা বলেন, বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের বিগত বছর গুলোর ডিমের বাজারের পর্যবেক্ষণ থেকে দেখা যায়, প্রতি বছর পবিত্র মাহে রমজান মাসে দেশে হোটেল রেস্টুরেন্ট, স্কুল কলেজ বন্ধ থাকা ও নানা সামাজিক অনুষ্ঠানাদি তেমন না হওয়াতে এবং বেকারি, বিস্কুট ফ্যাক্টরির উৎপাদন কমে যাওয়ার কারণে ডিমের চাহিদা বছরের অন্যান্য সময়ের তুলনায় অনেকটাই কমে যায়। বিগত বছরের তুলনায় এবারের ডিমের জেনারেল (ছোট ও মাঝারি খামার) উৎপাদন পর্যায়ে ফার্ম গেইট প্রাইস সর্বকালের সর্বনিম্ন (বর্তমান উৎপাদন খরচের তুলনায়)পর্যায়ে নেমেছে, যা ছোট ও মাঝারি খামারিদের গভীর হতাশায় ও লোকসানের মধ্যে ফেলেছে।

এসময় ক্ষুদ্র ও মাঝারি খামারিদের টিকিয়ে রাখতে 'বিপিআইএ'র থেকে ৮ দফা প্রস্তাব জানানো হয়। প্রস্তাবনাগুলোর মধ্যে রয়েছে—

১. বর্তমানে ডিমের দামের (ফার্ম গেইট প্রাইস) পতনে ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র ও মাঝারি খামারিদের জরুরি ভিত্তিতে নগদ আর্থিক প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে হবে, যেহেতু সরকার ডিমের মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছেন (কৃষি বিপণন আইন ২০১৮ অনুসারে) সেহেতু সরকারের উৎপাদনকারী টিকিয়ে রাখার স্বার্থে ও ডিমের উৎপাদনের ধারা অব্যাহত রাখতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বিশেষ তহবিল গঠন করে স্বল্প (নামমাত্র সুদে) সুদে- দ্রুত সময়ে দীর্ঘ মেয়াদি ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে, যেন এই সকল খামারিরা বর্তমান সংকট কাটিয়ে দ্রুত ঘুরে দাঁড়াতে পারেন।                                                                
২. কৃষি শিল্পের মত পোল্ট্রি খামারের বিদ্যুৎ বিলে ২০ শতাংশ রিবেট প্রদান ও তার জন্য সর্ত সহজ করতে হবে (ট্রেড লাইসেন্স ও  প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের  রেজিস্ট্রেশন দিয়ে এই সুযোগ প্রদান করা)। 

৩. ক্ষুদ্র ও মাঝারি খামারিদের টিকিয়ে রাখার স্বার্থে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় যেন অতিদ্রুত উদ্যোগ গ্রহন করতে হবে।

৪. প্রতি বছর রমজান মাসে সারা দেশে বা লেয়ার ফার্ম ঘন(যেখানে সবচেয়ে বেশি ডিম উৎপাদন হয়) জেলাগুলোতে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, কৃষি বিপন্ন অধিদপ্তর ও ভোক্তা অধিদপ্তরের সমন্বয়ে গঠিত মনিটরিং টিমের মাধ্যমে প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তরে নিবন্ধিত জেনারেল( ক্ষুদ্র ও মাঝারি) খামারিদের ডিম সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।

৫. বর্তমান সময়ে বিভিন্ন উপকরণের মূল্যে বৃদ্ধির বাস্তব পরিপ্রেক্ষিতে ডিম মুরগির সরকার ঘোষিত যৌক্তিক দাম অনতিবিলম্বে পূ:ণ নির্ধারণ করতে হবে। 

৬.ডিমের উৎপাদন খরচ কমাতে জেনারেল খামারিদেরকে সরকারের পক্ষ থেকে পোল্ট্রি শেড নির্মাণ, খাঁচা তৈরি/ক্রয় ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার যন্ত্রপাতি ও স্থাপনা নির্মাণের জন্য আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করতে হবে।

৭. ডিম মুরগির বাজারে ফড়িয়া সিন্ডিকেটের দৌরাত্ব কমানোর জন্য, ডিম মুরগির বাজার ব্যবস্থায় দক্ষ সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। 

৮. পোল্ট্রি শিল্পের বর্তমান সমস্যা ও ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করে আগামী দিনে ডিম মুরগির চাহিদা বৃদ্ধির সাথে উৎপাদন ও যোগানের সাথে তাল মিলিয়ে ডিম মুরগির গুনগত মান বজায় রাখা, নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন, ডিম ও মুরগির মাংসের আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানির পথ উন্মুক্ত করতে জাতীয় পোল্ট্রি ডেভেলপমেন্ট বোর্ড গঠন করতে হবে।

সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিআইএ) সভাপতি শাহ্ হাবিবুল হক বলেন, জেনারেল খামারিরা এখন যে দামে ডিম বিক্রি  করছেন, তাতে তাদের প্রতিদিনের মুরগি পালন করতে খাদ্য বাবত যে খরচ হয়, ডিম বিক্রি করে সেই ব্যয়ও উঠছে না। বর্তমানে একটি ডিমের উৎপাদন খরচ প্রায় ১১.৬৪ টাকার কাছাকাছি। সে হিসাবে প্রতি ডিমে একজন ক্ষুদ্র ও মাঝারি খামারির লোকসান দাঁড়ায় ২.৫৪ টাকা। ডিমের বর্তমান দামের এই ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী দিনে হাজার হাজার জেনারেল লেয়ার খামারি তাঁদের খামার বন্ধ করে দিতে বাধ্য হবেন, আমরা আমাদের সংগঠনের  বিভিন্ন জেলা উপজেলা প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জানতে পারতেছি যে, অনেক ছোট খামারি লোকসানের বোঝা টানতে না পেরে উৎপাদনে থাকা ডিমপাড়া মুরগি বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। যা অতি স্বল্প সময়ে রমজান পরবর্তী মাসগুলোতে ডিমের উৎপাদন ও যোগানের ভারসাম্য নষ্ট করবে, পোল্ট্রি ফার্মিং ও ডিম মুরগির বিপণনের সাথে জড়িত গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর লক্ষ লক্ষ মানুষ কর্মচ্যুতির শঙ্কায় পতিত হবেন, অন্যদিকে ভোক্তা বেশি দামে ডিম ক্রয়ের ঝুঁকিতে পড়বেন, এর ফলে ডিমের বাজারে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে অতীতের মত সুযোগ সন্ধানী সিজনাল ফড়িয়া সিন্ডিকেট ফায়দা লুটার চেষ্টা করবে, যা ভোক্তা, ডিমের খামারি ও নিয়মিত ডিমের সরবরাহের সাথে যুক্ত অংশিজন এবং সরকার কে অস্বস্তিতে ফেলবে। তাই দেশের ৮০% ডিমের যোগানদার জেনারেল (ক্ষুদ্র ও মাঝারি) খামারিদের টিকিয়ে রাখার স্বার্থে সরকারের অতিদ্রুত উদ্যোগ নিতে হবে।

পোল্ট্রি প্রোডাকশন এন্ড সাপ্লাই চেইন স্পেশালিষ্ট ও 'বিপিআইএ'র কেন্দ্রীয় কমিটি সদস্য কৃষিবিদ অঞ্জন মজুমদার বলেন, ফেব্রুয়ারি থেকে জেনারেল (ক্ষুদ্র ও মাঝারি) লেয়ার খামারিদের উৎপাদিত ডিমের দাম ধারাবাহিকভাবে কমা শুরু হলেও পবিত্র রমজান মাস শুরুর পরে, আরও দ্রুত দরপতনের কারণে বর্তমানে বিভিন্ন জেলা ভেদে ক্ষুদ্র ও মাঝারি খামারিরা তাঁদের ফার্ম গেইটে ৭-৭.৫০ টাকা যা আজকে  ৯.১০ টাকায় প্রতি পিস ডিম বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। কোন স্থানে উল্লেখিত দামেও খামারিরা ডিম বিক্রি করতে পারতেছেন না, প্রতিদিন খামারে অবিক্রীত ডিম জমে যাচ্ছে এবং দেশের বর্তমান আবহাওয়ার উচ্চ তাপমাত্রার কারণে ২/৩ দিনের মধ্যে ডিম পচে যাওয়ার ঝুঁকি থাকছে, ফলে ডিমের সাপ্লাই চেইন থেকে অনেক ডিম নষ্ট হবে এবং চুড়ান্ত ভাবে সামনের দিনে ডিমের চাহিদার বিপরীতে ঘাটতির কারণ হতে পারে।

'বিপিআইএ'র সিনিয়র সহসভাপতি খন্দকার মনির আহম্মেদ বলেন, সরকারের নিকট গত বছরের ৬ই নভেম্বর ভোক্তা অধিদপ্তর কর্তৃক আয়োজিত বিভিন্ন পোল্ট্রি সংশ্লিষ্ট সংগঠনের প্রতিনিধি ও পোল্ট্রির স্টেকহোল্ডার, বিভিন্ন কোম্পানির উপস্থিত প্রতিনিধিদের মিটিং এ প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল,যেন একটি যৌথ মনিটরিং সেল গঠনের মাধ্যমে আপদকালীন সময়ে জেনারেল পোল্ট্রি খামারি ও সাপ্লাই চেইনের নিয়মিত আড়ৎদারদের ডিম সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা, যদি সেই প্রস্তাবটি আমলে নেওয়া হত তাহলে ডিম ব্যবসায়ী ও খামারিরা আজকের এই ন্যায্য দামের সংকটে পড়ত না।

এসময় ঢাকার নিকটবর্তী জেলা থেকে আগত প্রান্তিক খামারিরা নিজেদের বর্তমান সংকট থেকে বেরিয়ে এসে উৎপাদনে ফিরতে তাঁদের সুরক্ষা জন্য সরকারের নিকট আবেদন জানান। পোল্ট্রি খামারি জাহিদ হোসেন জোয়ার্দার বলেন, বর্তমানে তারা যে দামে ডিম বিক্রি করছেন তাঁতে তাদের প্রতিদিনের খাদ্যের দামও উঠছে না, এভাবে চলতে থাকলে লোকসানের হাত থেকে বাঁচতে পোল্ট্রি ফার্ম বন্ধ করে দিতে বাধ্য হবেন। 

নরসিংদীর খামারি বিলকিস বেগম বলেন, বিগত ১০ বছরে আমি খামার করছি, আমি পুরোপুরি খামারের উপর নির্ভরশীল। নরসিংদীতে আমাকে ৮ টাকা ৬০ পয়সাতে ডিম বিক্রি করতে হচ্ছে। ডিম বিক্রি করে মুরগির খাবারের দামই উঠাতে পারছি না, এখন আমার পথে বসার অবস্থা, বিদ্যুৎ বিল, কর্মচারীর বেতন দিতে পারছি না। এ অবস্থায় আমাদের মতো ছোট খামারিদের স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করলে আমরা উপকৃত হব।

গাজীপুরের খামারি তোফাজ্জল হোসেন বলেন, সরকারের নির্ধারণ করা দামের থেকে অনেক কম দামে আমরা বিগত কয়েক মাস ডিম বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছি। সরকার যদি উৎপাদন খরচ থেকে কম দামে ডিম বিক্রি করলে খামারিদের ভর্তুকি না দেয় তাহলে অনেক খামারি এই সংকটে হারিয়ে যাবে।

সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ এসোসিয়েশনের নেতৃবৃন্দ সহ প্রান্তিক খামারির মধ্যে আরও উপস্থিত ছিলেন শামীম মৃধা, গাজী নূর, মো. সাদেকুর রহমান, মো. রফিকুল ইসলাম, মো. শহীদ মল্লিক, মো. সোলেমান কবির প্রমুখ।


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence