‘এক ডিম ৩ জন খেয়ে রোজা রেখেছি’—বেতন না পাওয়া শিক্ষক

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি  © ফাইল ছবি

‘আমার বাবা বাজারে গেছে, তার হাতে আমি একটা টাকাও তুলে দিতে পারিনি। রোজার বাজারও করতে পারিনি। রাতে শুধু ডিম ভেজে তিন জনে ৩ ভাগ করে খেয়ে রোজা রেখেছি। বেতন না হওয়া পর্যন্ত দিনগুলো কীভাবে চলবে তা আল্লাহই ভাল জানেন’—আক্ষেপ নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন মো. আসাদুল্লাহ নামে এক শিক্ষক।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলার ভেরেন্ডী উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. মিলন হোসেন জানান, ‘জানুয়ারি মাসের ১ তারিখে ডিসেম্বরের বেতন পেয়েছি। এরপর বেতন ছাড়াই কেটে গেছে দুই মাস। আজ মার্চের ২ তারিখ, পকেটে এক টাকাও নেই। পানি খেয়ে ইফতার করতে হবে। রমজান মাস কী কষ্টে শুরু হয়েছে সেটা একমাত্র আল্লাহ জানেন। বেসরকারি শিক্ষকদের প্রতি এমন অবহেলা কেন? আমাদের পরিবারের কাছে কী জবাব দেব? শিক্ষকদের বোবা কান্না দেখার কেউ নেই।’

‘আমি শুধু বেতন পাঠাই। কি কারণে দেরি হচ্ছে তা শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং এডুকেশন ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম বা ইএমআইএস সেল ভালো বলতে পারবে।’—মোঃ শাহজাহান, উপপরিচালক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর

শুধু এই দুই শিক্ষকই নয়; বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত ৩ লাখ ৪৮ হাজার ৭৬১ জন শিক্ষক-কর্মচারী এখনো জানুয়ারি মাসের বেতন পাননি। বেতন না হওয়ায় তারা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। শিক্ষকরা বলছেন, দেশ এখনো বৈষম্যমুক্ত হতে পারেনি। সমাজের একটি শ্রেণি পরিবার নিয়ে সুখে ইফতার করছে। আরেকটি শ্রেণি বেতন না হওয়ায় পানি খেয়ে ইফতার করছে।

জানা গেছে, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ইলেক্ট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার বা ইএফটির মাধ্যমে বেতন-ভাতা পান। তবে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা সরকারি কোষাগার থেকে ছাড় হলেও তা রাষ্ট্রায়ত্ত আটটি ব্যাংকের মাধ্যমে ‘অ্যানালগ’ পদ্ধতিতে ছাড় হয়। এই অর্থ তুলতে শিক্ষকদের নানা ভোগান্তিতে পড়তে হতো।

ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে বেতন-ভাতা ছাড়ের জন্য কয়েক পর্যায়ে অনুমোদনসহ সংশ্লিষ্ট কাজে অনেক ক্ষেত্রেই এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বেতন-ভাতা পেতে দেরি হয়। অনেক সময় পরের মাসের ১০ তারিখের পরও আগের মাসের বেতন-ভাতা জোটে।

আমি এক দূর্গম চরের স্কুলে চাকরি করি। আমার বাড়িতে দুই হাজার টাকার মতো খরচ হয়। অথচ আমার কাছে ৪০০ টকাও নেই। কিছু অভিভাবক সবজি দিয়ে সহায়তা করেছেন, জানিনা এভাবে ভিক্ষাবৃত্তি করে কতদিন চলতে পারব? নতুন একটা চাকরির সন্ধান করছি, পেলেই সেই পেশায় চলে যাব।’

এ পরিপ্রেক্ষিতে গত ৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবসে ইএফটিতে বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দেওয়ার ঘোষণা দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। প্রাথমিকভাবে বেসরকারি এমপিওভুক্ত স্কুল-কলেজের ২০৯ জন শিক্ষক-কর্মচারীর অক্টোবর মাসের এমপিও ইএফটিতে ছাড় হয়। পরবর্তী সময়ে গত ১ জানুয়ারি ১ লাখ ৮৯ হাজার শিক্ষক ইএফটির মাধ্যমে বেতন-ভাতার সরকারি অংশের টাকা পেয়েছেন। দ্বিতীয় ধাপে ৬৭ হাজার, তৃতীয় ধাপে ৮৪ হাজার এবং চতুর্থ ধাপে ৮ হাজার ২০০ এর অধিক শিক্ষক-কর্মচারীকে ডিসেম্বর মাসের বেতন দেওয়া হয়েছে। তবে তারা এখনো জানুয়ারি মাসের বেতন পান নি।

শিক্ষক-কর্মচারীরা বলছেন, একজন সহকারী শিক্ষকের বেতন ১২ হাজার ৭৫০ টাকা। এই টাকা দিয়ে মাস চলতেই কষ্ট হয়ে যায় শিক্ষকদের। সেখানে দুই মাস ধরে বেতনহীন অবস্থায় রয়েছেন তারা। সরকার সব জেনেও কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। বেতন না হওয়ায় পরিবার নিয়ে কষ্টে রয়েছেন।

একটি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ট্রেড ইন্সট্রাক্টর রাশেদ মোশাররফ জানান, ‘জানুয়ারির ১ তারিখে বেতন পেয়েছি ১৬ হাজার ৯০০ টাকা। জানুয়ারি মাস চলে গেছে, পুরো ফেব্রুয়ারি চলে গেছে; আজ মার্চের ২ তারিখ। প্রথম রোজা! জীবন কোন সরলীকরণে চলছে সেটা জানি না। আজ প্রথম ইফতার। কাছে ১৫০ টাকা ছাড়া কিছুই নাই। বাবার হাতে ইফতারের বাজার করতে কোনো টাকা দিতে পারিনি। সন্তান হিসেবে আজ লজ্জিত।’

মো. আলী আকবর সামি নামে আরেক শিক্ষক জানান, আমি এক দূর্গম চরের স্কুলে চাকরি করি। আমার বাড়িতে দুই হাজার টাকার মতো খরচ হয়। অথচ আমার কাছে ৪০০ টকাও নেই। কিছু অভিভাবক সবজি দিয়ে সহায়তা করেছেন, জানিনা এভাবে ভিক্ষাবৃত্তি করে কতদিন চলতে পারব? নতুন একটা চাকরির সন্ধান করছি, পেলেই সেই পেশায় চলে যাব।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের উপপরিচালক (প্রশাসন) মোঃ শাহজাহান দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘শিক্ষকদের জানুয়ারি মাসের বেতন ব্যাংকে পাঠাবে আরও সময় লাগবে।’ ব্যাংকে বেতন পাঠাতে কেন বিলম্ব হচ্ছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি শুধু বেতন পাঠাই। কি কারণে দেরি হচ্ছে তা শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং এডুকেশন ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম বা ইএমআইএস সেল ভালো বলতে পারবে।’

এ বিষয়ে জানতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের যুগ্মসচিব (বাজেট অধিশাখা) মোর্শেদা আক্তারের ব্যবহৃত মুঠোফোনে কল দেওয়া হলে সাংবাদিক পরিচয় শুনে তিনি ফোন কেটে দেন। মাউশির ইএমআইএস সেলের সিনিয়র সিস্টেম এনালিস্ট খন্দকার আজিজুর রহমানের মুঠোফোনে একাধিকবার কল দেওয়া হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।


সর্বশেষ সংবাদ