নিসর্গে মিশে থাকা নৈঃশব্দ্যের সংলাপ

চিত্রকর্ম
চিত্রকর্ম  © এস এম রকিবুল হাসান

নিখুঁত বাস্তববাদের অনুসরণ না করেও কীভাবে একটি জীবন্ত অভিজ্ঞতা সৃষ্টি করা যায়, তার উজ্জ্বল উদাহরণ হয়ে উঠেছেন সমকালীন শিল্পী এস এম রাকিবুল হাসান। তার চিত্রকর্মগুলো যেন বাস্তব আর বিমূর্ততার মধ্যবর্তী এক ধূসর প্রান্তর—যেখানে দর্শক নিজেই নিজের অনুভব দিয়ে একটি দৃশ্য নির্মাণ করে নেন। রাকিবুলের ক্যানভাসে দৃশ্যমান যে সমুদ্র বা পাহাড়, তা নিছক কোনো ভূপ্রাকৃতিক উপাদান নয়; বরং একেকটি আত্মিক অনুরণন, যা আমাদের নিজস্ব স্মৃতি, যাপনের ব্যথা, অথবা হারিয়ে যাওয়া মুহূর্তের সঙ্গে গভীরভাবে সংযুক্ত।

সুনীলের লেখা ‘একটি স্তব্ধতা চেয়েছিল আর এর এক নৈঃশব্দকে ছুঁতে তারা বিপরীত দিকে চলে গেল, এ জীবনে দেখাই হলো না। জীবন রইল পড়ে বৃষ্টিতে রোদ্দুরে ভেজা ভূমি’। তার দুর্দান্ত এ লাইনগুলোকে মিথ্যা প্রমাণ করতেই কি না, জানি না এ প্রদর্শনীতে থাকা চিত্রকর্মগুলোর আঁচড় কখনো খুব মৃদু, কুয়াশার মতো—আবার কখনো গভীর ও তীব্র, ঠিক যেন কোনো অস্থির রাতের ঢেউ। রংগুলোও আবেগের নিরিখে বাছাই করা—কখনো বিষন্ন নীল, কখনো পুড়ে যাওয়া কমলা, কখনো থমকে থাকা ধূসর। তবে এ রঙের ব্যবহারে কোনো কৃত্রিম নাটকীয়তা নেই; সবকিছু যেন নিজের মতোই ঘটে যায়, ধীরে, নীরবে—যেমন প্রকৃতি ঘটে।

এস এম রকিবুল হাসানের ক্যানভাসে যে প্রকৃতি উঠে আসে, তা কখনো প্রমত্ত নয় বরং ধ্যানী, সংযত, নৈঃশব্দ্যময়। অনেকটা যেন রবীন্দ্রনাথের সেই “শান্ত ও ধীর রূপ”। এ নৈঃশব্দ্যের মধ্যেই শিল্পী সৃষ্টি করেন এক ধরনের সংলাপ প্রকৃতি ও মানুষের মাঝখানে, যার ভাষা নেই, আছে কেবল অনুভব। দর্শক হিসেবে আমরা এই সংলাপের সক্রিয় অংশীদার হয়ে উঠি, কারণ এই চিত্রকর্মগুলো আমাদের চোখ দিয়ে নয়, হৃদয় দিয়ে দেখা প্রয়োজন। বিশেষ করে তাঁর জলরঙের কাজগুলোতে যে স্বচ্ছতা, তা যেন আমাদের ভেতরের স্নিগ্ধ অনুভূতিগুলোর প্রতিচ্ছবি। আবার তেলরঙে আঁকা ঢেউ বা পাহাড়ের রেখায় যে গভীরতা, তা আমাদের অস্তিত্বের প্রশ্নগুলোকে সামনে এনে দাঁড় করায়। শিল্পী কখনোই সরাসরি কিছু বলেন না; বরং আমাদের ভাবতে বাধ্য করেন। একটি রেখা বা রঙের মধ্যেও কত অর্থ লুকিয়ে থাকতে পারে, তা আমরা তাঁর ছবির দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারি।

এস এম রকিবুল হাসানের শিল্পকর্মের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো তিনি কোনো কিছুই নির্দিষ্টভাবে বোঝাতে চান না। তাঁর কাজ খোলা থাকে ব্যাখ্যার জন্য, যেমন প্রকৃতি নিজেই ব্যাখ্যাতীত। তিনি যেন এক ধরনের চুপ থাকা শিল্পচর্চা করেন—যেখানে শব্দের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে ফাঁকা জায়গা, স্পর্শ না করা রং, এবং অসমাপ্ত রেখা। তবে কী তিনি ক্যানভাসে খুঁজে ফিরেছেন তাঁর হারিয়ে ফেলা কোনো প্রিয়জনকে? কিংবা অপ্রাপ্তির কোনো বেদনা হাহাকার করে ওঠে তার রংতুলির আঁচড়ে কিংবা চিন্তার আখরে?

এ শিল্পী আমাদের মনে করিয়ে দেন, ছবি কেবল দেখে বোঝার বিষয় নয়, বরং অনুভবের একটি ধ্যানী অভ্যাস। তাঁর কাজ আমাদের শেখায় প্রকৃতি ও মানবজীবনের সংলাপ সর্বদাই সরব নয়, অনেক সময় নীরবতাই সবচেয়ে গভীর কথা বলে। এ নীরব উচ্চারণেই এস এম রকিবুল হাসানের চিত্রশিল্প আমাদের সামনে তুলে ধরে এক বিশুদ্ধ, আত্মিক শিল্পজগত, যেখানে প্রত্যেক দর্শক খুঁজে পান নিজেরই এক টুকরো ছায়া।

প্রদর্শনীর জন্য নির্বাচিত বেশিরভাগ চিত্রকর্মের গঠন-কাঠামো এবং সংরূপ বা কম্পোজিশনের ক্ষেত্রে আমরা এক ধরনের রৈখিক গভীরতা লক্ষ্য করেছি, যা একদিকে যেমন দৃষ্টির সরলরেখাকে অগ্রসর করে, অন্যদিকে তেমনি মানসচোখে তৈরি করে স্থানিক অনুভবের এক জটিল পরিসর। এই বৈশিষ্ট্যগুলো বিশেষভাবে লক্ষণীয় শিল্পী এস এম রকিবুল হাসানের কাজগুলোতে। তাঁর চিত্রকলাগুলোতে আমরা স্পষ্টভাবে দেখতে পাই ল্যান্ডস্কেপ ঘরানার একটি বিশুদ্ধ প্রকাশ, যেখানে তিনি বিমূর্ততার সূক্ষ্ম মিশ্রণ ঘটিয়ে দৃশ্যমান বাস্তবতাকে এক ধরনের ভাবসম্পন্ন পরাবাস্তবে রূপ দিয়েছেন।

রকিবুলের অধিকাংশ চিত্রকর্মে রঙের স্তরায়ণ এক ধরনের ঊর্ধ্বগামী রৈখিক অভিযাত্রা তৈরি করে, ঠিক যেন প্রত্নতাত্ত্বিক স্তরবিন্যাসের সূত্রে উপরিস্থাপনের তত্ত্বকে মনে করিয়ে দেয়। নিচ থেকে ওপরে দিগন্তরেখা পর্যন্ত যে ধাপে ধাপে রঙের বিন্যাস ঘটে, তা যেন কেবল দৃশ্যমানতা নয়—বরং একটি আভ্যন্তরীণ অভিজ্ঞতার ভৌগোলিক মানচিত্র। বিশেষত কাগজের সাদা অংশ সংরক্ষণ করে তিনি যে দৃষ্টিভ্রম সৃষ্টি করেন, তা একদিকে যেমন শৈল্পিক কৌশলের উৎকর্ষতা প্রকাশ করে, তেমনি তা দর্শকের মনে সৃষ্টি করে আলোর সঙ্গে ছায়ার, বাস্তবের সঙ্গে কল্পনার এক চমৎকার সংলাপ।

তার জলরঙের কাজে স্পষ্টভাবে ইনপ্রেশনিস্ট প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। প্রতিটি তরঙ্গ, প্রতিটি ছিটানো রঙ, এমনকি যেন হঠাৎ বিস্ফোরিত কুয়াশার রেখাও হয়ে ওঠে শিল্পীর মুহূর্তিক আবেগ বা অনুভূতির প্রতিচ্ছবি। এখানে ‘সঠিক’ বা ‘পরিপাটি’ কিছু নেই—আছে স্বতঃস্ফূর্ততা, মুহূর্তকে ধারণ করার তীব্র চেষ্টা, এবং অনুভবের সত্যতা। এই স্বতঃস্ফূর্ততার মধ্যেই লুকিয়ে থাকে এক গভীর প্রশান্তি, যা কেবল প্রকৃতিকে দেখে নয়, বরং উপলব্ধি করে উপলব্ধির মধ্যে মিশে যায়।

একজন প্রাচ্য শিল্পের নিবেদিত শিল্পী হিসেবে রকিবুলের হৃদয়ে গেঁথে আছে প্রকৃতির প্রতি এক গভীর শ্রদ্ধা, এক নীরব ভালোবাসা। তিনি প্রকৃতিকে কেবল দেখেন না, তিনি তার সঙ্গে কথা বলেন। জীবনের পারস্পরিক সংযুক্তি, প্রকৃতি-মানব সম্পর্কের সেই জটিল অথচ সূক্ষ্ম নীরবতার মধ্যেই তিনি খুঁজে নেন তাঁর শিল্পের ভাষা। সেই ভাষা কখনো রঙে, কখনো রেখায়, কখনো ফাঁকা জায়গায় প্রকাশিত হয়।

তাই “হৃৎকাব্যে প্রকৃতি” শীর্ষক এই প্রদর্শনী এস এম রকিবুল হাসানের অনুসৃত শিল্প ঐতিহ্যকে শ্রদ্ধাভরে উদযাপন করে। এখানে চিত্রকলার রূপে প্রকৃতি, পরিবেশ এবং মানবজীবনের নিঃশব্দ সংলাপ গেঁথে গেছে এক অনন্য রূপে। প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে জলরঙ, অ্যাক্রেলিক, মিশ্র মাধ্যম এবং সমসাময়িক উপস্থাপনার বিভিন্ন ধরন—যা একত্রে আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, শিল্প কেবল দর্শনের জন্য নয়, বরং অনুভবেরও একটি মহৎ মাধ্যম। প্রতিটি চিত্রকর্ম যেন এক একটি নীরব কাব্য যা দর্শকের হৃদয়ে ফেলে যায় গূঢ় সুরের অনুরণন।

বিবিধ দর্শনের ছায়ায় গড়ে ওঠা এস এম রকিবুল হাসানের শিল্পকর্মগুলো কেবল প্রকৃতিকে চিত্রিত করে না; বরং প্রকৃতির মধ্যেই বসবাস করে, নিঃশ্বাস নেয়, এবং ধ্যানস্থ হয়ে আমাদের অস্তিত্বের গভীরে ঢুকে পড়ে। তাঁর কাজে নিঃসঙ্গতার প্রতিরূপ হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা গাছ, নদী ও নারী, প্রকৃতি গবাক্ষে চলমান গরু, যেখানে আকাশে হেলান দিয়ে কাত হয়ে আছে ঘুমন্ত পাহাড়, অলৌকিক কুয়াশা, রঙে রাঙ্গা মাছরাঙা, ভোরের একাকী দোয়েল কিংবা নিস্তব্ধ কোনো মাঠ—এসব কিছুকে দেখা যায় একেকটি জীবন্ত প্রতীকেরূপে। শুধু তাই নয়, প্রাচ্যের নারী প্রতিকৃতি, গৃহকর্মে লিপ্ত মানুষ অথবা প্রাকৃতিক আড়ালে কোনো বিমূর্ততায় দাঁড়িয়ে থাকা মানবশরীর সব কিছুই যেন প্রকৃতির সঙ্গে এক হয়ে গেছে।

রকিবু্লের তুলির আঁচড়ে যে ধোঁয়াশা বা কুয়াশা দেখা যায়, তা কেবল সৌন্দর্যের পরিপূরক কোনো আবরণ নয়; বরং তা উপস্থিতি ও অনুপস্থিতির মাঝে এক ধ্যানী সমতা তৈরি করে। সেখানে নেই কোনো অতিরিক্ত নাটকীয়তা—আছে নিরবতা, সংযম এবং একটি আভ্যন্তরীণ ছন্দ, যা দেখতে দেখতে অনুভব করতে হয়। এ কুয়াশা কখনো একটি অনুচ্চারিত দুঃখ, কখনো এক বিষণ্ন প্রশান্তি, আবার কখনো সেই শূন্যতা, যা মানুষকে ভাবায়, স্থির করে।

রকিবুলের চিত্রে মানুষের উপস্থিতিও একান্ত বিনয়ী। সেই মানুষ কখনো নির্জনে হাঁটছে, কখনো প্রাকৃতিক ছায়ায় ধ্যানস্থ, কখনো ক্ষেতখামারে মাথা নিচু করে কাজ করছে। মানুষের এই আত্মসাৎ ভঙ্গি প্রকৃতির সামনে বিনয়ের প্রকাশ—এ যেন শিল্পীর নিজস্ব দর্শন, যেখানে মানুষ প্রকৃতির মালিক নয়, বরং তার অংশ। তবে ক্ষেত্রবিশেষে টাচ-রিটাচের বহুমাত্রিকায় কিছু জবড়জং ব্যাপারও প্রস্ফুটিত।

আধুনিক বিশ্ব যখন ভয়াবহ পরিবেশগত সংকটে নিপতিত, তখন রকিবুলের এ চিত্রভাষা এক অনন্ত বার্তা বহন করে—প্রকৃতি ও মানুষের আত্মার সুস্থতা একে অপরের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত। তাঁর কাজ আমাদের মনে করিয়ে দেয়, প্রকৃতি কোনো বাহ্যিক উপাদান নয়; এটি আমাদের চেতনা, স্মৃতি, এবং নৈতিক উপলব্ধির কেন্দ্র। এই উপলব্ধি এক ধরনের আত্মসন্ধান—যা তাঁর প্রতিটি ক্যানভাসে ধরা পড়ে।

শিল্পীর এ দৃশ্যপট কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলভিত্তিক নয়, বরং তা একটি বিস্তৃত ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক মানচিত্র। সাজেকের পাহাড়, বরেন্দ্রভূমির পাথুরে মাঠ, নদীর পাড়ে গরুর প্রতিচ্ছবি কিংবা স্নিগ্ধ ভোরের আলো—সবই যেন জীবনের একেকটি স্তর। তাঁর তুলির ছোঁয়ায় গাছপালার নরম ছায়া, নদীর নিঃশব্দ গতি, কিংবা বাতাসে দুলতে থাকা কোনো আম-কাঁঠালের ডাল, শালপাতা কিংবা হেলে থাকা ঘাস আর কাশবন হয়ে ওঠে জীবনের ব্যাকরণ।

তাইতো এ প্রদর্শনীতে রকিবুলের প্রতিটি চিত্রকর্ম একেকটি ধ্যানের স্থান। এখানে দর্শক কেবল ছবি দেখেন না তারা নীরবতার সান্নিধ্যে এসে অনুভব করেন নিজেকে, প্রকৃতিকে এবং তাদের মধ্যকার সম্পর্ককে। এ অনুভব থেকে জন্ম নেয় এক নতুন উপলব্ধি, যেখানে হৃদয় ও হৃদকলমের মধ্যে গড়ে ওঠে এক পবিত্র সংযোগ। সে সংযোগ আমাদের আমন্ত্রণ জানায় নতুন এক জগতে পা রাখার, যেখানে প্রতিটি রং, প্রতিটি রেখা, প্রতিটি ফাঁকা জায়গা বলে দেয়—রং তুলি হাতে নিলে এ পৃথিবী এখনো অনুভবের উপযুক্ত এক আশ্রয়। 

লেখক: চেয়ারম্যান, শিল্পকলার ইতিহাস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।


সর্বশেষ সংবাদ