ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ঘ’ ইউনিট

উত্তীর্ণদের পুনঃপরীক্ষাতেই পাপমোচন?

'মেধায় চান্সপ্রাপ্তদের পুনঃপরীক্ষায় ফেল করার সম্ভাবনা আছে, আবার ফেল করা শিক্ষার্থীরাও সুযোগ পেলে পাস করতে পারে।'

চান্সপ্রাপ্তদের সবাই প্রশ্ন পায়নি। মুষ্টিমেয় পেলেও অধিকাংশই মেধা প্রমাণ করে এসেছে। কিন্তু এই মেধা প্রমানিত হওয়া কেউ যদি সামনের পরীক্ষায় চান্স না পান; তবে ভবিষ্যতের অবস্থা কী হবে? তাছাড়া এসব চান্সপ্রাপ্তদের নিয়ে ইতোমধ্যেই পরিবার, সমাজ ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে  হইচই হয়ে গেছে। সামনের পরীক্ষায় ফেল করলে তাদের মানসিক অবস্থাই কী হবে?

প্রশ্ন দুটো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী জয়নাল আবেদিন ইমরানের। শুধু ইমরান নয়; বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ও অন্যসব ভর্তিচ্ছুর মাঝেও নানাভাবে ঘুরপাক খাচ্ছে এ ধরনের অগণিত প্রশ্ন। যার সদুত্তর সংশ্লিষ্ট অনুষদ কিংবা অক্সফোর্ড খ্যাত প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারক- কারো কাছেই পাওয়া যায়নি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পাস-ফেলের হিসাব কষে উত্তীর্ণদের পরীক্ষা নেয়ার কথা বলেছেন; যা একেবারেই অর্থহীন। তাদের ভাষ্য, যারা ফাঁসকৃত প্রশ্ন পেয়ে প্রথমবার পরীক্ষা দিয়েছিলেন, তারাই আবার দ্বিতীয়বার পরীক্ষার হলে বসতে যাচ্ছেন। অর্থাৎ প্রতারকরাই বারবার সুবিধাভোগী হচ্ছেন। দেশ সেরা প্রতিষ্ঠান একটা ভুল ঢাকতে গিয়ে আরেকটা ভুলের জন্ম দিচ্ছে বলে মনে করছেন তারা।

সিরাজগঞ্জ কামারখন্দের ভর্তিচ্ছু আনিসুজ্জামান মনে করেন, কতজন পরীক্ষার্থী প্রশ্ন পেয়ে পরীক্ষা দিয়েছেন; তার হিসাব কি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে আছে? সম্ভবত নেই। তার সাফ কথা, পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। তাই পরীক্ষা বাতিল করে পুনরায় পরীক্ষা নিতে হবে। এখানে পাস-ফেল দেখলে চলবে না।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী মো. আবু সুফিয়ান বলছেন, পুনরায় ভর্তি পরীক্ষার সিদ্ধান্ত শতভাগ সঠিক। কিন্তু শুধু পাশ করা শিক্ষার্থীদের সুযোগ দেওয়াটা কি যৌক্তিক হল? কেননা এখানে যারা সেরা একশর মধ্যে আছেন, তাদের প্রায় ৮০ জনই নিজ ইউনিটের পরীক্ষায় ফেল করেছে। সুতরাং প্রশ্ন না পেলে ‘ঘ’ ইউনিটেও তারা ফেল করত। তাই উত্তীর্ণ এবং অনুত্তীর্ণ সকলকেই সমান সুযোগ দেওয়া যুক্তিযুক্ত।

আইন অনুষদের ছাত্র আখতার হোসেন পরীক্ষা বাতিলের দাবিতে প্রথম অনশন শুরু করেন

 

আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ইমরান বলছেন, প্রশ্ন না পেয়ে ‌চান্সপ্রাপ্তরা যদি পুনঃপরীক্ষায় কোন কারণে আবার চান্স না পায়; তখন তাদের কতটা হতাশায় পড়তে হবে! কেউ কেউ হয়তো বলে উঠবে ‘‘প্রশ্ন পেয়ে চান্স পেয়েছিল বলে হয়নি।’’ ইমরানের ভাষ্য, হয়ত বলা যায়, ‘‘যারা মেধাবী, তারা বারবার পরীক্ষা হলেও চান্স পাবে।’’ কিন্তু সবসময় তার পজিশন এক নাও থাকতে পারে। কেউ বিশ্বাস করুক বা না করুক ঢাবিতে চান্স পাওয়ার জন্য মেধার পাশাপাশি ভর্তির ওই এক ঘন্টার পরিবেশও তার ভাগ্যে প্রভাব ফেলে।

শারমীন আক্তারা নামে এক শিক্ষার্থী বলছেন, ‘নগরে আগুন লাগলে দেবালয় কি এড়ায়!! শরষের মাঝে ভূত থাকলে সবাইকে তার খেসারত দিতে হয়!’

অবশ্য কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তকে সঠিক দাবি করে এর পক্ষেও যুক্তি তুলে ধরছেন অনেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী রায়হান আলীর বক্তব্য, ‌‘প্রশ্ন ফাঁসের সাথে ফেল করা স্টুডেন্টের কোনো সম্পর্ক নাই। কারণ পাসের জন্য নির্দিষ্ট একটা মার্কস দরকার হয়, যা প্রশ্ন ফাঁস হলেও পাওয়া সম্ভব। সুতরাং এটাই ঠিক সিদ্ধান্ত।’ মো. শরীফুল ইসলাম নামে আরেক শিক্ষার্থী মনে করেন, ‘বৃহৎ স্বার্থে ব্যক্তিস্বার্থ কিছুটা খোয়া তো যাবেই।’

খরচ ও ঝক্কি কমাতে অনুত্তীর্ণদের বাদ!
জানা যায়, এ বছর ‘ঘ’ ইউনিটের ১ হাজার ৬১৫টি (বিজ্ঞানে-১১৫২টি, বিজনেস স্টাডিজে-৪১০, মানবিকে-৫৩টি) আসনের বিপরীতে ভর্তিচ্ছু আবেদনকারীর সংখ্যা ছিল ৯৫ হাজার ৩৪১ জন। এর মধ্যে পরীক্ষায় অংশ নেয় নেয় প্রায় ৭৫ হাজার; যা অন্যসব ইউনিট থেকে বেশি।

ডিনস কমিটির মিটিং সূত্রে জানা যায়, সবচেয়ে বেশি সংখ্যক পরীক্ষার্থীর ঝামেলা এড়াতেই শুধু উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের নিয়ে বিশেষ এই পরীক্ষার আয়োজন করতে যাচ্ছে কর্তৃপক্ষ। যুক্তি হিসেবে মিটিংয়ে বলা হয়, গত ১২ অক্টোবর অনুষ্ঠিত পরীক্ষা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ৫০টি ও ক্যাম্পাসের বাইরে ৩১টি স্কুল-কলেজসহ মোট ৮১টি কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সবার পরীক্ষা নিতে গেলে ফের এই ঝক্কি পোহাতে হবে। তাছাড়া পরীক্ষা ব্যবস্থাপনার ব্যয়ও বেড়ে যাবে। সভায় এ প্রশ্নও ওঠে- আবার পরীক্ষা নিলেও যে প্রশ্ন ফাঁস হবে না- তার গ্যারান্টি কী? সামাগ্রিক বিষয়ে আলাপ-আলোচনা শেষে অধিকাংশ ডিন মত দেন, পরীক্ষার্থী অল্প হলে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা হবে। স্বভাবতই প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার সম্ভাবনা কম। তাছাড়া যারা ন্যূনতম পাস নম্বর পেতে ব্যর্থ হয়েছে, তাদের আবারও পরীক্ষা নেওয়ার যৌক্তিকতা নেই। এরপরই নতুন ওই সিদ্ধান্ত আসে।

দু’সপ্তাহ পরও অধরা হোতারা
এদিকে প্রশ্নফাঁস নিয়ে দেশব্যাপী তুলকালাম চললেও এখনও অধরা মূল হোতারা। ফাঁসের পর ছয়জনকে গ্রেপ্তার করে তিন দিনের রিমান্ড নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলেও অধরা রয়েছেন প্রকৃত অপরাধীরা। জানা যায়, থানার পাশাপাশি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগও (সিআইডি) পুরো বিষয়টির ছায়া তদন্ত করছে। সিআইডির এক কর্মকর্তা বলেন, ‘বগুড়ার রানা ও লিমনকে খুঁজছি আমরা। তাদের পাওয়া গেলে এর সঙ্গে আর কে বা কারা জড়িত আছে, তা জানা যাবে।’

তথ্যমতে, গত ১২ অক্টোবর ওই পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার আগে থেকেই প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ ওঠে। এরপর পরীক্ষাটি বাতিল চেয়ে পুনরায় ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার দাবি করেন শিক্ষার্থীরা। প্রথমে আইন অনুষদের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র আখতার হোসেন পরীক্ষা বাতিলের দাবিতে অনশন শুরু করেন। পরে তাতে সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ অংশ নিয়ে কর্তৃপক্ষকে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেয়। আর যাচাই-বাছাই সাপেক্ষে আবার পরীক্ষা নেওয়ার দাবিসহ চার দফা দেয় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ। শুধু তাই নয়, উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের বিশেষ ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার দাবি জানিয়ে মৌন পদযাত্রা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বরাবর স্মারকলিপি প্রদানের মত কর্মসূচিও গ্রহণ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ। মূলত এসব আন্দোলনের প্রেক্ষিতেই মঙ্গলবার দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিনস কমিটির এক জরুরি সভায় ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রায় ১৮ হাজার ৪০০ জন শিক্ষার্থীর পুনরায় পরীক্ষা নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। মিটিং সূত্রের তথ্য, পরীক্ষার তারিখ নির্ধারণের জন্য সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম, জীববিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ইমদাদুল হক, আইন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. রহমত উল্লাহ ও কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক আবু দেলোয়ার হোসেনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ঘ ইউনিট ভর্তি পরীক্ষার সমন্বয়ক অধ্যাপক সাদেকা হালিম বলেন, ডিনস কমিটির সভায় ভিসি, প্রোভিসিদ্বয় এবং ১০ জন ডিন ছিলেন। সবাই মিলে আলোচনা করে এমন একটি প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এখানে শিক্ষার্থীদের একটা বড় অংশই আসছে পরীক্ষায়। আমরা তাদের দক্ষতা যাচাই করব। আর বেশি কিছু না। উত্তীর্ণ ভর্তি ইচ্ছুকদের মধ্যে জালিয়াতি করেও অনেকে পাস করেছে তাদের ব্যাপারে কী ভাবছেন আপনারা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা তো ‘রুট কজ’ দেখতে চাই। তদন্ত কমিটি হয়েছে, সিআইডি কাজ করে যাচ্ছে, গোয়েন্দাদের সাথে যোগাযোগ হচ্ছে কোথায় কোন কোন অসঙ্গতি আছে এবং কেন সেটি আমরা দেখব। তবে আমরা রেজাল্ট যাচাই-বাছাই করে দেখেছি সেখানে বড় রকমের অসঙ্গতি পাইনি। কিন্তু শুধু ‘পাবলিক পারসেপশনের’ জন্য পুনরায় পরীক্ষা নিচ্ছি।

আর উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, প্রশ্ন ফাঁসে সবাই জড়িত নয়। তবে পুলিশের তদন্তে চিহ্নিতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেন, ডিনস কমিটির সিদ্ধান্তই গুরুত্বপূর্ণ। শুধু উত্তীর্ণদের পরীক্ষা পুনরায় নেওয়া হবে। শীঘ্রই নতুন পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করা হবে বলে তিনি জানান।

তবে সবকিছুর মধ্যেও প্রশ্ন থেকেই যায়- পুনঃভর্তি পরীক্ষা নিয়েই কি ঢাবির পাপমোচন শেষ? নাকি ঘাড় থেকে দায়িত্ব নামানোর কৌশল মাত্র। অজানা এমন বহু প্রশ্নের সদুত্তর।


সর্বশেষ সংবাদ