ঈশা খাঁর স্মৃতিবিজড়িত জঙ্গলবাড়ি দুর্গে খননকাজে মিলছে ইতিহাসের স্তরভাঙা চিহ্ন

কিশোরগঞ্জে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের খননে মিলেছে মৃৎপাত্র, লোহার খণ্ড ও স্থাপনার অংশ, গড়ে উঠছে সম্ভাব্য পর্যটন কেন্দ্র

ঈশা খাঁর স্মৃতিবিজড়িত জঙ্গলবাড়ি
ঈশা খাঁর স্মৃতিবিজড়িত জঙ্গলবাড়ি  © সংগৃহীত

১৬শ শতাব্দীর বাংলার ইতিহাসে বারো ভূঁইয়াদের অন্যতম বীর ঈশা খাঁর নাম উচ্চারিত হয় গর্ব ও প্রতিরোধের প্রতীক হিসেবে। কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার নরসুন্দা নদীর তীরে তাঁর গড়ে তোলা দ্বিতীয় রাজধানী—জঙ্গলবাড়ি দুর্গ—আজও দাঁড়িয়ে আছে সেই গৌরবময় অতীতের সাক্ষী হয়ে। আর সেই প্রাচীন দুর্গের আঙিনায় এখন চলছে প্রত্নতাত্ত্বিক খননকাজ। উঠে আসছে ইতিহাসের স্তরভাঙা চিহ্ন, যেগুলো বাংলার রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসে নতুন আলো ফেলতে পারে বলে মনে করছেন গবেষকরা।

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের ময়মনসিংহ আঞ্চলিক কার্যালয়ের তত্ত্বাবধানে গত ১৬ মার্চ থেকে শুরু হয়েছে খননকাজ। এর নেতৃত্বে আছেন আঞ্চলিক পরিচালক আফরোজা খান মিতা ও সহকারী পরিচালক হালিমা আফরোজ। ফিল্ড অফিসার সাবিনা ইয়াসমিন ও গবেষণা কর্মকর্তা নূর মোহাম্মদের তত্ত্বাবধানে চলছে খুঁটিনাটি পর্যবেক্ষণ। তারা জানান, ‘এরিসমেট্রিকস’ পদ্ধতিতে ৬ ফুট বাই ৬ ফুট আকারের ব্লক ধরে খনন করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত প্রায় ৪ ফুট গভীরে খনন করেই পাওয়া গেছে স্থাপনার অবশিষ্টাংশ, পোড়া মাটির পাত্র, প্রলেপযুক্ত মৃৎপাত্র, পটারি ও লোহার খণ্ডাংশ। এগুলোর বয়স চতুর্দশ থেকে পঞ্চদশ শতাব্দীর মধ্যে হতে পারে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

স্থানীয় ইতিহাস অনুযায়ী, এই অঞ্চল একসময় কোচ রাজা লক্ষ্মণ হাজরা ও রাম হাজরার শাসনাধীন ছিল। ১৫৮৫ সালে ঈশা খাঁ তাদের পরাজিত করে জঙ্গলবাড়ি দুর্গ দখল করেন এবং এটি পুনর্গঠন করে তাঁর রাজনৈতিক ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করেন। তবে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, খননে প্রাপ্ত নিদর্শনগুলো প্রমাণ করে ঈশা খাঁর আগেও এখানে জনবসতি ছিল। ফলে জঙ্গলবাড়ির গুরুত্ব শুধু ঈশা খাঁর স্মৃতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এর শিকড় আরও গভীরে প্রোথিত।

এখনো স্পষ্টভাবে বলা যাচ্ছে না যে আবিষ্কৃত স্থাপনাটি কী কাজে ব্যবহৃত হতো। এটি বৈঠকখানা, সৈন্যদের ব্যারাক, ঘোড়ার আস্তাবল কিংবা আবাসস্থল—সবই হতে পারে। খনন আরও গভীরে গেলে হয়তো স্থাপনাটির প্রকৃতি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে।

ঐতিহাসিক সম্পত্তি ও বর্তমান বাস্তবতা
বর্তমানে ঈশা খাঁর বাড়ির দায়িত্বে আছেন তাঁর ১৫তম বংশধর দেওয়ান জামাল দাদ খান দেলোয়ার (৫০)। তিনি জানান, পরিবারটি এখনও ২৭ একর ভূমির খাজনা পরিশোধ করে, যদিও ভোগদখলে আছে মাত্র ৬ একর। বাড়ির সামনে থাকা বৃত্তাকার পরিখা—যেটি একসময় দুর্গের নিরাপত্তা নিশ্চিত করত—সেটিও এখন আংশিক দখলে। তিনি মনে করেন, পুরো পরিখা উদ্ধার করে সেখানে নৌভ্রমণের ব্যবস্থা করা হলে পর্যটনের পাশাপাশি সরকারের রাজস্ব আয়ও বাড়তে পারে। তবে তার উদ্বেগ, ভবিষ্যতে যদি সরকার এই এলাকা পর্যটন কেন্দ্রে রূপান্তর করে, তাহলে তাদের পরিবারকে বাড়ি থেকে সরিয়ে দেওয়া হতে পারে কি না। এজন্য তিনি সরকারের কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন, যেন পূর্বপুরুষদের এই ঐতিহাসিক বাড়িতে বসবাসের সুযোগ দেওয়া হয়।

অধিগ্রহণ, ক্ষতিপূরণ ও পর্যটনের সম্ভাবনা
জঙ্গলবাড়ি দুর্গকে ঘিরে ইতিমধ্যে সাড়ে ৯ একর জায়গা অধিগ্রহণ করেছে সরকার। স্থানীয় বাসিন্দা হারুন মিয়া ও তাঁর স্ত্রী অনুফা বেগম জানান, তাদের ১৮ শতাংশ জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে এবং এর জন্য তারা পেয়েছেন সরকারি দামের তুলনায় প্রায় তিনগুণ ক্ষতিপূরণ—৬৮ হাজার টাকার জায়গায় পেয়েছেন ২ লাখ টাকা প্রতি শতাংশ। তারা জানিয়েছেন, জমি ভরাট করে নতুন বাড়ি নির্মাণের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া প্রায় শেষ পর্যায়ে এবং এ প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে প্রায় ২১ কোটি টাকা। কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক ফৌজিয়া খান দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, “ধসে পড়া ভূগর্ভস্থ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন উদ্ধারে আমাদের কার্যক্রম চলছে। শিগগিরই ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে চেক প্রদান সম্পন্ন হবে।”

ঐতিহ্য ও আধুনিক পর্যটনের সংযোগ
২০০৬ সাল থেকে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে থাকা ঈশা খাঁর বাড়িতে ইতোমধ্যে দরবার হল ও মসজিদের আংশিক সংস্কার সম্পন্ন হয়েছে। পুরো এলাকাটি জরিপ করে ভবিষ্যতে বৃহত্তর পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলার পরিকল্পনাও রয়েছে, যাতে ইতিহাসপ্রেমী ও ভ্রমণপিপাসু মানুষ ঈশা খাঁর স্মৃতিবিজড়িত স্থানে এসে ইতিহাসের ছোঁয়া পেতে পারেন।

ঈশা খাঁর মৃত্যু হয়েছিল গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার বখতিয়ারপুরে, যেখানে এখনো তাঁর সমাধি রয়েছে। তবে জঙ্গলবাড়িতেও তাঁর বংশধরদের কিছু কবর রয়েছে বলে জানিয়েছেন দেওয়ান জামাল দাদ খান।

বাংলার ইতিহাসে প্রতিরোধ ও স্বাধীনচেতা নেতৃত্বের অন্যতম প্রতীক ঈশা খাঁর এই দুর্গ শুধু একটি স্থাপনা নয়, এটি একটি সময়ের দলিল। আর সেই দলিলের পাতা খুলতেই যেন একঝাঁক গবেষক, ইতিহাসবিদ ও প্রশাসন আজ একসাথে কাজ করছে জঙ্গলবাড়িতে।


সর্বশেষ সংবাদ