লবণের রাজ্যে শ্রমের রাজনীতির শিকার প্রান্তিক চাষিরা
- কক্সবাজার প্রতিনিধি
- প্রকাশ: ০২ মে ২০২৫, ০৩:৪৯ PM , আপডেট: ২২ জুন ২০২৫, ০৪:৫৫ PM
কক্সবাজারের উপকূলীয় এলাকায় শুরু হয়ে গিয়েছে লবণ উৎপাদনের মৌসুম। সূর্যের তাপে সাগরের পানি শুকিয়ে তৈরি হচ্ছে ঝকঝকে সাদা লবণ। জেলার চকরিয়া, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, পেকুয়া ও টেকনাফে হাজার হাজার পরিবার এই মৌসুমি শিল্পের সঙ্গে জড়িত।
জানা গেছে, প্রাচীন পদ্ধতিতে তৈরি হওয়া লবণ এখনো দেশের বিশাল অংশের চাহিদা পূরণ করছে। চাষ পদ্ধতিতে রয়েছে প্রযুক্তির অভাব। এ ছাড়াও প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও ন্যায্য বাজারমূল্যে। আধুনিক প্রযুক্তির অভাবে উৎপাদনশীলতা কমে যাচ্ছে। এখনও অধিকাংশ চাষিই মাটির প্যানেই কাজ করছেন, যেখানে উন্নত পলিথিন প্যান বা পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা নেই।
এ ছাড়াও চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ক্ষতিগ্রস্ত লবণ চাষিরা কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়কে কাফনের কাপড় পড়ে লবণ ঢেলে প্রতীকী প্রতিবাদ জানায়। তারা ‘ন্যায্য মূল্য চাই’ দাবিতে দুই ঘণ্টারও বেশি সময় সড়ক অবরোধ করে রাখে।
লবণ চাষিরা জানান, নভেম্বর থেকে মে মাস পর্যন্ত শুকনো মৌসুমে সমুদ্রের পানি প্যানে জমিয়ে রোদে শুকিয়ে লবণ তৈরি করা হয়। কিন্তু হঠাৎ বৃষ্টি কিংবা ঝড় উঠলে পুরো মাঠের লবণ নষ্ট হয়ে যায়। ফলে ক্ষতির মুখে পড়েন তারা।
মহেশখালীর লবণ চাষি মো. ইউনুছ বলেন, ‘লবণ তুলতে আমাদের অনেক খাটতে হয়, কিন্তু দাম ঠিকমতো পাই না। মাঝে মাঝে তো ধার করে সংসার চালাতে হয়।’
মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য ও বাজার ব্যবস্থাপনার অভাবকেও দায়ী করে চাষিরা বলেন, ‘লবণের উৎপাদন ব্যয় বাড়লেও বাজারে তার প্রভাব পড়ে না, বরং দালালেরা কম দামে কিনে নিয়ে লাভ করছে।’
টেকনাফের আরেক চাষি আহাব উল্লাহ বলেন, ‘আমরা লবণ করার জন্য যে টাকা দিয়ে জমি কর্জ নিয়ে থাকি, অনেক সময় সেই টাকাও পরিশোধ করতে পারি না। কারণ লবণ ন্যায্য মূল্যে বিক্রি করতে পারি না। এভাবেই আমরা শোষিত হচ্ছি বছরের পর বছর। তবে এবার আশা রাখি এ সরকার আমাদের দুঃখ বুঝবে এবং সকল লবণ সিন্ডিকেট ভেঙে দিবে।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি সহায়তা ও প্রশিক্ষণ দিলে লবণ উৎপাদন আরও বাড়ানো সম্ভব। পাশাপাশি আবহাওয়া পূর্বাভাস, ফসল বিমা ও বাজারমূল্য নির্ধারণের সুষ্ঠু ব্যবস্থা নিলে এই শিল্প হতে পারে উপকূলীয় অঞ্চলের অর্থনীতির বড় ভিত্তি।
এদিকে লবণ মাঠে দিনের পর দিন তীব্র রোদে কাজ করার ফলে চাষিদের মধ্যে চর্মরোগ, চোখের রোগ, এমনকি দীর্ঘস্থায়ী শারীরিক দুর্বলতা দেখা দিচ্ছে। নেই কোনো নিরাপত্তা সরঞ্জাম বা প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা। অধিকাংশ লবণ চাষি তাদের শিশুদের স্কুলে পাঠাতে পারছেন না, ফলে দারিদ্র্য ও অশিক্ষার চক্র অব্যাহত থাকছে।
বর্তমানে উপকূলীয় জীবিকার এ গুরুত্বপূর্ণ খাতটি টিকে আছে শ্রম আর প্রত্যয়ের ওপর। তবে সহায়তা না পেলে ভবিষ্যতে এ শিল্প থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেন অনেক চাষিই।