নুসরাত হত্যার ছয় বছর, দীর্ঘদিনেও সেই বিভীষিকা থেকে বের হতে পারেনি পরিবার

নুসরাত জাহান রাফি
নুসরাত জাহান রাফি  © সংগৃহীত

আজ ১০ এপ্রিল, ফেনীর সোনাগাজীর আলোচিত মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফির হত্যাকাণ্ডের ছয় বছর পূর্ণ হলো। ২০১৯ সালের এই দিনে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান নুসরাত। তার কয়েক দিন আগেই, ৬ এপ্রিল আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাত আরবি প্রথম পত্র পরীক্ষায় অংশ নিতে সোনাগাজীর ইসলামিয়া ফাজিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসায় গিয়েছিলেন।

পরীক্ষা শুরুর আগে বান্ধবী নিশাতকে মারধরের কথা শুনে মাদ্রাসার ছাদে ছুটে যান নুসরাত। সেখানে আগে থেকে ওঁত পেতে থাকা পাঁচজন তাকে ছাদে শুইয়ে হাত-পা বেঁধে দেন ওড়না দিয়ে। এরপর গলা থেকে পা পর্যন্ত গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। আগুনে দগ্ধ হয়ে কয়েক দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে অবশেষে ১০ এপ্রিল মৃত্যু হয় নুসরাতের।

এই ঘটনায় সারা দেশে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। ২০১৯ সালের ২৭ মার্চ মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলার বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগ এনে নুসরাত থানায় মামলা করেন, যার পর থেকেই হত্যাকারীদের টার্গেটে চলে আসেন তিনি। নানা রকম হুমকি-ধমকি দিয়েও নুসরাতকে মামলা তুলে নিতে বাধ্য করা যায়নি। বরং অগ্নিদগ্ধ অবস্থায়ও তিনি প্রতিবাদ করে গেছেন।

ঘটনার তদন্তে উঠে আসে, সিরাজ উদদৌলা কারাগারে বসেই হত্যার পরিকল্পনা করেন। ৩ এপ্রিল কারাগারে দেখা করতে যাওয়া নুর উদ্দিন, শাহাদাত হোসেন শামীম ও আরও কয়েকজনকে তিনি নির্দেশ দেন প্রয়োজনে নুসরাতকে হত্যা করতে।

ঘটনার পর নুসরাতের ভাই মাহমুদুল হাসান বাদী হয়ে সোনাগাজী মডেল থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। পরে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) তদন্ত করে ২৮ মে আদালতে ৮৬৯ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্র দাখিল করে। এতে ১৬ জনের বিরুদ্ধে হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়।

২০১৯ সালের ২৪ অক্টোবর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল–ফেনীর বিচারক মামুনুর রশিদ ১৬ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে মর্মে প্রত্যেককে মৃত্যুদণ্ড দেন। একই সঙ্গে প্রত্যেককে এক লাখ টাকা করে জরিমানাও করা হয়।

তবে মামলার কার্যক্রম এখনো শেষ হয়নি। উচ্চ আদালতে ডেথ রেফারেন্সের শুনানি চলছে। বিচারপতি হাবিবুল গনি ও বিচারপতি জাহেদ মনসুরের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর থেকে এই শুনানি শুরু হয়। গত পাঁচ মাসে ৭ জন আসামির শুনানি শেষ হয়েছে। বাদবাকি ৯ জনের শুনানি শেষে চূড়ান্ত রায় দেওয়া হবে বলে জানান বাদীপক্ষের আইনজীবী এম শাহজাহান সাজু। তাঁর ধারণা, আগামী ঈদুল আজহার পর এই মামলার রায় প্রকাশ হতে পারে।

ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন মাদ্রাসার তৎকালীন অধ্যক্ষ এস এম সিরাজ উদদৌলা, সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি রুহুল আমিন, পৌর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাকসুদ আলম, ছাত্রনেতা নুর উদ্দিন, শাহাদাত হোসেন, সাইফুর রহমান মো. জোবায়ের, জাবেদ হোসেন ওরফে সাখাওয়াত, হাফেজ আবদুল কাদের, আবছার উদ্দিন, আবদুর রহিম শরীফ, ইফতেখার উদ্দিন, ইমরান হোসেন, মহিউদ্দিন শাকিল, মোহাম্মদ শামীম, কামরুন নাহার ও উম্মে সুলতানা পপি।

ফেনী জেলা কারাগারের জেলসুপার মো. আবদুল জলিল জানান, রুহুল আমিন ও মাকসুদ আলম ফেনী কারাগারে থাকলেও বাকি ১৪ জন বিভিন্ন কারাগারে—যেমন কাশিমপুর ও কুমিল্লা—বন্দি রয়েছেন।

এদিকে পরিবার এখনও সেই বিভীষিকা থেকে বের হতে পারেনি। গত বছরের ভয়াবহ বন্যায় তাদের বাড়ি ডুবে যাওয়ায় নুসরাতের অনেক স্মৃতিচিহ্ন নষ্ট হয়ে গেছে। তার মা শিরিন আক্তার বলেন, ‘ফুলের মতো মেয়েটি যে কী যন্ত্রণা ভোগ করেছে, সেটা ভাবলেই গায়ে কাঁটা দেয়। যদি দোষীদের ফাঁসি কার্যকর হয়, তাহলে কিছুটা সান্ত্বনা পাব।’

নুসরাতের ছোট ভাই রাশেদুল হাসান রায়হান বলেন, ‘আপুকে হত্যার পর থেকেই আমাদের পরিবারের বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। কখনো আমাকে শিবির, আবার কখনো ছাত্রলীগের দোসর বলে অপবাদ দেওয়া হচ্ছে।’

বড় ভাই মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এখনো আসামিপক্ষের লোকজন নুসরাতকে নিয়ে কটূক্তি করে। এতে পরিবার নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। আমরা চাই, যত দ্রুত সম্ভব উচ্চ আদালতের চূড়ান্ত রায় হোক, যেন নুসরাতের আত্মা শান্তি পায়।’

নুসরাতের বাবা এ কে এম মুসা জামেয়া সারাফাতিয়া ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার শিক্ষক ও ইমাম হিসেবে কর্মরত। সপ্তাহের ছয় দিন কর্মস্থলে থাকার পর প্রতি বৃহস্পতিবার রাতেই বাড়ি ফেরেন এবং শুক্রবার সকালে আবার ফিরে যান মাদ্রাসায়।


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence