বাংলাদেশে মাদ্রাসা ব্যাকগ্রাউন্ডের চাকুরিপ্রার্থীরা কি বৈষম্যের মুখোমুখি হয়?

মাদ্রাসা শিক্ষার্থী
মাদ্রাসা শিক্ষার্থী  © ফাইল ছবি

বাংলাদেশে চাকরির বাজারে সাধারণ ব্যাকগ্রান্ডের শিক্ষার্থীদের তুলনায় মাদ্রসার শিক্ষার্থীরা বেশি বৈষম্যের শিকার হয়। সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে পোষাকের তেমন কোনো সমস্য না থাকলেও কর্পোরেট সেক্টরে এটির গুরুত্ব বেশি দেখা হয়। একজন মাদ্রাসা পড়ুয়া ছাত্র বিশেষতই তার পোষাক হিসেবে পাঞ্জাবি টুপি পরিধান করে থাকে। বাহ্যিক দৃষ্টিকোন থেকেও অনেকের চেয়ে পিছিয়ে থাকেন তারা। বিশ্বব্যাংকের রিসার্চ কনসালটেন্ট শিব্বির আহমেদ এ বিষয়ে একটি গবেষণা করেছেন। তিনি সেই গবেষণাটি যুক্তরাষ্ট্রে একটি কনফারেন্সে তুলে ধরেন। 

২৪ জুলাই কনফারেন্সটি আয়োজন করে এগ্রিকালচারাল অ্যান্ড অ্যাপ্লায়েড ইকোনোমিক্স অ্যাসোসিয়েশন। অ্যাপ্লায়েড ইকোনোমিক্সের সবচেয়ে বড় কনফারেন্স এটি। বিশ্বের প্রায় দেড় হাজার অর্থনীতিবিদরা এই কনফারেন্সে অংশগ্রহন করেন। কনফারেন্সে শিব্বির আহমেদ "Labor Market Discrimination in Bangladesh: An experimental Evidence from the job market of college graduates" শীর্ষক শিরোনামে তাঁর গবেষণা তুলে ধরেন। 

এই গবেষণায় সহ-গবেষক হিসেবে ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির একজন অধ্যাপক ও একজন সহযোগী অধ্যাপক এবং বিশ্বব্যাংকের ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ গ্রুপের একজন অর্থনীতিবিদ। 

গবেষণায় দেখানো হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা একজন চাকরিপ্রার্থী তার হাইস্কুল (এসএসসি এবং এইচএসসি) কোন ধরণের প্রতিষ্ঠানে পড়েছে (মাদ্রাসা বা জেনারেল স্কুল), তার জেন্ডার, কিংবা  ধর্মীয় পোশাক (যেমন- ছেলেদের ক্ষেত্রে দাঁড়ি-টুপি, মেয়েদের হিজাব) পরার কারণে কোন ধরণের বৈষম্যের শিকার হয় কিনা! বৈষম্য থাকলে তার মাত্রা কতটুকু এবং বিভিন্ন সেক্টরে সেটা কিভাবে ভ্যারি করে?

গবেষণাটি করার জন্য চারজন পুরুষ ও চারজন নারীর মোট ৮টা কাল্পনিক সিভি (fictitious resume) বানানো হয়। যারা সবাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করেছে একই বা কাছাকাছি ধরণের বিভাগ থেকে। তাদের অ্যাকাডেমিক রেজাল্ট ও অন্যান্য যোগ্যতা সমান রাখা হয়েছে সেখানে।

চারজন পুরুষের দুজন মাদ্রাসা থেকে দাখিল আলিম পাশ করা, দুজন জেনারেল স্কুল থেকে এসএসসি এইচএসসি পাশ করা। মেয়েদের ক্ষেত্রেও একই রাখা হয়েছে। তাদের ছবিগুলোতে একজনকে ধর্মীয় পোশাক সহ (দাঁড়ি-টুপি/হিজাব), আরেকজন জেনারেল পোশাকে রাখা হয়েছে।

গবেষকরা সেই কাল্পনিক সিভিগুলো চারটা সেক্টরে- এনজিও, মিডিয়া, কর্পোরেট, এবং আইটি প্রেরণ করেন। প্রায় দশ মাস ধরে বিডিজবস, প্রথমআলোজবস সহ বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত চাকরির বিজ্ঞপ্তিগুলো ফলো করে প্রতিটা জবে আটটা করে সিভি পাঠানো হয়। সর্বমোট ৪০৬ টা জবে ৩২৪৮ টা সিভি।
 
গবেষণা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আমরা দেখতে চেয়েছি একজন এমপ্লয়ার প্রথমিক বাছাইয়ের পর কাদেরকে ইন্টারভিউ বা লিখিত পরীক্ষার জন্য ডাকে। প্রত্যেক সিভির বিপরীতে একটা করে ফোন নাম্বার ও ইমেইল আইডি ছিলো যা আমাদের দুজন গবেষণা সহকারী যত্নের সাথে মেইনটেইন করেছে।

সংক্ষেপে তাঁদের গবেষণার ফাইন্ডিংসগুলো তুলো ধরা হল
১) ঢাকাবিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা গ্রাজুয়েট যাদের দাখিল, আলিম মাদ্রাসা ব্যাকগ্রাউন্ড ছিলো, অন্যান্য সকল যোগ্যতা সমান থাকার পরেও তারা চাকরির বাজারে বৈষম্যের শিকার হয়। জেনারেল স্কুল ব্যাকগ্রাউন্ডের ক্যান্ডিডেটদের সমান সংখ্যক ইন্টারভিউ কল পেতে হলে তাদেরকে ওভারঅল অন্তত ৪০% বেশি চাকরিতে আবেদন করতে হয়। পুরুষদের জন্য সেটা ৯৬%। শুধু মাদ্রাসা ও স্কুল ব্যাকগ্রাউন্ডের দুজন ক্লিনশেভ করা পুরুষের মধ্যে তুলনা করা হলে- মাদ্রাসা ব্যাকগ্রাউন্ডের প্রার্থীকে ১৭১% বেশি চাকরিতে আবেদন করতে হবে সমান সংখ্যক ইন্টারভিউয়ের ডাক পেতে। সব সেক্টরেই এই বৈষম্য বিভিন্ন মাত্রায় বিদ্যমান।

২) একইভাবে দাঁড়ি-টুপি, হিজাবের জন্যও বৈষম্য বিদ্যমান। তবে এক্ষেত্রে হিজাবী নারীদের চেয়ে দাঁড়ি-টুপি আছে এমন পুরুষ প্রার্থীরা বেশি বৈষম্যের সম্মুখীন হচ্ছে। এনজিওগুলোতে হিজাবের কারনে বৈষম্য না থাকলে দাঁড়ি-টুপি বা মাদ্রাসা ব্যাকগ্রাউন্ডের কারনে পুরুষরা কম ইন্টারভিউ কল পেয়েছে। ধর্মীয় পোশাকের কারনে সবচেয়ে বেশি বৈষম্য হয় মিডিয়া ও কর্পোরেট সেক্টরে।
  
৩) জেন্ডারের ভিত্তিতে উল্লেখযোগ্য কোন ভিন্নতা দেখেননি গবেষকরা। এনজিওর চাকরিতে বরং নারীরা অনেক অগ্রাধিকার পায় (সেখানে পুরুষ প্রার্থীর বরং বৈষম্য ফেস করে)। নারীর প্রতি বৈষম্যের বিরুদ্ধে গত দু-তিন দশকের সচেতনতার সুফল হিসেবে এটা হয়েছে। তবে নারীরা তুলনামূলক কম বেতনের চাকুরিতে এবং ক্লায়েন্ট-ইন্টারেকশান বেশি এ ধরণের চাকুরিতে বেশি কল পেয়েছে। সামগ্রিকভাবে লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য কমলেও নারীদের কম বেতনের চাকরির অগ্রধিকার এখনো বেশি। গবেষকরা বলছেন, আমাদের অনুমান ছিলো এনজিও এবং মিডিয়াতে নারীরা বেশি কল পাবে। মজার বিষয় হচ্ছে, মিডিয়ার চাকরিতে নারীরা তুলনামূলক কম কল পেয়েছেন। সমান যোগ্যতার নারী ও পুরুষ আবেদন করলে মিডিয়া পুরুষ প্রার্থীকে তুলনামূলক বেশি অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।  

বাংলাদেশে জব মার্কেটে বৈষম্য আছে বলে মানুষের মধ্যে উপলব্ধ থাকলেও এব্যাপারে গবেষণামূলক কোনো প্রমাণ নেই। গবেষক শিব্বির আহমেদ বলছেন, এটা প্রথম গবেষণা যার মাধ্যমে বৈষম্যের বিদ্যমানতা প্রমাণিত হয়েছে। বৈশ্বিক পর্যায়েও হাইস্কুল ব্যাকগ্রাউন্ডের কারণে জব মার্কেটে বৈষম্য অনুসন্ধান করার গবেষণা এটি প্রথম। অত্যন্ত অবজেক্টিভ জায়গা থেকে বৈষম্য যাচাই করার ক্ষেত্রে দুনিয়া জুড়ে এ পদ্ধতি (audit/correspondence experiment) খুবই প্রশংসনীয় একটা পদ্ধতি। যুক্তরাষ্ট্র সহ অনেক দেশেই বর্ণ, লিঙ্গ, ধর্ম, জাতীয়তা ইত্যাদির ভিত্তিতে বৈষম্য অনুসন্ধান করার ক্ষেত্রে এ পদ্ধতি অনুসরণ করে অনেক গবেষণা করা হয়েছে।


সর্বশেষ সংবাদ