সেশনজটের কবলে ঢাবির এক-তৃতীয়াংশ বিভাগ

লস রিকভারি প্ল্যান বাস্তবায়নে গড়িমাসি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়  © টিডিসি ফটো

করোনা মহামারীতে ২০২০ সালের মার্চের পর দেড় বছরের অধিক সময় ধরে ঢাকা বন্ধ ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম। এ কারণে শিক্ষার্থীদের সেশনজট লাঘবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ‘লস রিকভারি প্ল্যান’ প্রণয়ন করলেও অনেক বিভাগ ও ইনস্টিটিউট এই প্ল্যান অনুসরণ করলেও ৩১টি বিভাগ ও ইনস্টিটিউট এই প্ল্যান অনুসরণ করছে না বলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে। ফলে এক বছরের সেশনজটের আশঙ্কা করছে শিক্ষার্থীরা। এতে অনেকেই হতাশায় পড়েছেন।

তথ্য মতে, ২০২০ সালের ১ জুন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় ‘লস রিকভারি প্ল্যান’ এর অনুমোদন দেওয়া হয়। এই প্ল্যান অনুসারে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২ মাসের বর্ষ ৮ মাসে এবং ৬ মাসের সেমিস্টার ৪ মাসে শেষ করতে বলা হয়। এছাড়া ফল ঘোষণার ক্ষেত্রে সেমিস্টার পদ্ধতিতে ছয় সপ্তাহ ও বার্ষিক পদ্ধতিতে আট সপ্তাহের বেশি সময় নেওয়া যাবে না এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিল।

তবে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন অনেক বিভাগ রয়েছে যেগুলোতে ২টি সেমিস্টারের রেজাল্ট দেওয়া বাকি অথচ তৃতীয় আরেকটা সেমিস্টারের ক্লাস চলছে। এছাড়াও ‘লস রিকভারি প্লান’ অনুযায়ী আগের তুলনায় সশরীরে ২টি ও অনলাইনে ১টি ক্লাস বেশি নেওয়ার নির্দেশ রয়েছে। কিন্তু এ নির্দেশনাও উপেক্ষা করছে বেশ কিছু বিভাগ।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭৫টি বিভাগ ও ১০ ইনস্টিটিউটের মধ্যে সমাজকল্যাণ ইনস্টিটিউট, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগ, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ, যোগাযোগ বৈকল্য বিভাগ, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, টেলিভিশন ফিল্ম ও ফটোগ্রাফি বিভাগ, ফিন্যান্স বিভাগ, ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, গণিত বিভাগ, লোকপ্রশাসন বিভাগ, রসায়ন বিভাগ, পরিসংখ্যান বিভাগ, মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগ, ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট বিভাগ ও আধুনিক ভাষা শিক্ষা ইনস্টিটিউটের অধীনে জাপানিজ ভাষা ও সংস্কৃতি বিভাগ, ফারসি ভাষা ও সংস্কৃতি, চীনা ভাষা ও সংস্কৃতি বিভাগ এবং ইংলিশ স্পিকার ফর অ্যাদার লাংগুয়েজ বিভাগে ২০২০ সালে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীরা ২০২২ সালে এসেও প্রথম বর্ষেই রয়ে গেছে। কিছু বিভাগে ২০২০ সালে দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ বর্ষে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীরা ২০২২ সালে এসেও একই বর্ষে রয়ে গেছে।

এছাড়াও দুইটা সেমিস্টারের পরীক্ষা শেষ করে তৃতীয় আরেকটা সেমিস্টারের ক্লাস নিচ্ছেন অথচ একটা সেমিস্টারেরও রেজাল্ট দেওয়া হয়নি এমন বিভাগ রয়েছে প্রায় ১৩টি।

বিভাগগুলো হলো- ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস বিভাগ, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজম্যান্ট বিভাগ, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ইংলিশ স্পিকার ফর অ্যাদার ল্যাংগুয়েজ বিভাগ, ফলিত গণিত বিভাগ, বিশ্ব ধর্ম ও সংস্কৃতি বিভাগ, আরবি বিভাগ, একাউন্টিং এন্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগ, শিক্ষা ও গবেষণা বিভাগ, ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগ ও মার্কেটিং বিভাগ।

এছাড়াও বেশকিছু বিভাগে এক সেমিস্টারের ফাইনাল পরীক্ষা নেওয়ার পূর্বে আরেকটা সেমিস্টারের মিড ও একইসাথে তৃতীয় আরেকটা সেমিস্টারে ক্লাস নেওয়া হচ্ছে এমন অভিযোগও রয়েছে শিক্ষার্থীদের।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের এক শিক্ষার্থী বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের বাকি সবগুলো বিভাগ ও ইনস্টিটিউট ৪ মাসে সেমিস্টার অনুযায়ী রুটিন দিয়েছে। আমাদের বিভাগেই শুধু ব্যতিক্রম। যখন হল বন্ধ ছিলো তখন আমাদের ঢাকায় এনে পরীক্ষা নিয়েছে। আর এখন হল খোলা আর আমাদের গত দেড় মাস বসিয়ে রেখেছে। এভাবে চললে আমাদের এক বছর নষ্ট হবে।

বিভাগের শিক্ষকদের এই নিয়ে কোনো চিন্তাই নেয়। তারা আগের রুটিনেই ক্লাস নিবে। যেখানে আমাদের দুবছর ক্লাস অফ ছিলো সেখানে তারা দিনে একটি দুটি করে ক্লাস নেওয়ার রুটিন দিয়েছে। যেখানে অন্যান্যা বিভাগে আরো বেশি ক্লাস নিচ্ছে।

পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের এক শিক্ষার্থী বলেন, আমাদের বিভাগ অন্যান্য বিভাগ থেকে অনেক ধীর গতির। আমরা পরীক্ষা শুরু করছি গত বছরের ২৫ অক্টোবর আর এই পরীক্ষা শেষ হলো গত ৩ ফেব্রুয়ারিতে। রেজাল্ট যে কবে হবে এটার নিশ্চয়তা নেই। এভাবে চললে আমরা অনার্স শেষ করব কবে। শিক্ষকরাও শিক্ষার্থী বান্ধব না।

সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এই ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা হাতাশার মধ্যে আছে। কারণ ২০১৯-২০ সেশনে যারা প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়েছিল তারা ২০২২-এ এসেও প্রথম বর্ষেই রয়ে গেছে।

ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা জানান, এখানকার শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের নিয়ে ভাবেন না। তারা শিক্ষার্থী বান্ধব না। তাই অন্যান্য বিভাগে প্রথম বর্ষ শেষ করে দ্বিতীয় বর্ষে ক্লাস করা শিক্ষার্থীদের বন্ধু-বান্ধবরাই এ বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী, তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরা দ্বিতীয় আর চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থীরা এ বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী।

জানা যায়, বিভাগটিতে দ্বিতীয় সেমিস্টার পরীক্ষা চলমান অবস্থায় গত ২১ জানুয়ারি সশরীরে ক্লাস পরীক্ষা বন্ধ করে বিশ্ববিদ্যালয়। তবে অনলাইনে কিংবা কোন বিভাগ চাইলে সশরীরে ও পরীক্ষা নিতে পারবেন বলে জানান বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তা সত্ত্বেও মাত্র ২টি কোর্সের পরীক্ষা আঁটকে রেখে শিক্ষার্থীদের একটা দোটানায় ফেলে রেখেছে বিভাগটি।

ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের এক ছাত্র জানান, ২০২১ সালের ২৬ ডিসেম্বর ষষ্ঠ সেমিস্টার শেষ হলেও গত এক মাসের বেশি সময়ে সর্বসাকুল্যে ১০টি ক্লাস নিয়েছে বিভাগটি। ৮ জন শিক্ষকের মধ্যে এখন পর্যন্ত ৩ জন শিক্ষক ক্লাস নেওয়া শুরুই করেননি বলে জানান তিনি। এদিকে সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে ফাস্ট সেমিস্টার পরীক্ষা শেষ করে আগামী দেড় মাসের মধ্যে রেজাল্ট প্রকাশের আশ্বাস দিচ্ছেন বিভাগটি।

নাহিদ হাসান নামে এই বিভাগের আরেক ছাত্র বলেন, ৩য় ও ৪র্থ সেমিস্টারের রেজাল্ট বাকি, ৫ম সেমিস্টারের ক্লাস শুরু হলেও বেশিরভাগ শিক্ষকই ক্লাস নেয় না। সিআরদের ফোন রিসিভ করেন না অনেক শিক্ষক।

২০২০, ২০২১ ও ২০২২- একটানা তিন বছর ধরে তৃতীয় বর্ষে আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ বৈকল্য বিভাগের শিক্ষার্থীরা। ফাইনাল তো দূর তারা এখনো মিড দিতে পারেনি বলে জানা যায়। বিভাগটিতে ২০১৮-১৯ সেশনের শিক্ষার্থীরা এখনো দ্বিতীয় বর্ষে আর ২০১৯-২০ সেশনের শিক্ষার্থীরা আছে প্রথম বর্ষে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক টেলিভিশন ফিল্ম অ্যান্ড ফটোগ্রাফি বিভাগের ১৭-১৮ সেশনের এক শিক্ষার্থী বলেন, আমার এখন মাস্টার্সে থাকার কথা অথচ এখনো থার্ড ইয়ারে পড়ে আছি। ৫ম সেমিস্টার রেজাল্ট হয়নি এখনো। বিশ্ববিদ্যালয় ৪ মাসে সেমিস্টার শেষ করতে বললেও যথাসময়ে সেমিস্টার শেষ করছে না বিভাগটি। সপ্তাহে একটা ক্লাস হয়। এভাবে চললে আমাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে ডুবে যাবে।

দুই বছর ধরে দ্বিতীয় বর্ষে পড়ে আছেন উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৮-১৯ সেশনের শিক্ষার্থীরা। তারাননুম আহসান নামে ওই সেশনের এক ছাত্রী বলেন, এ বছর চতুর্থ বর্ষে থাকার কথা কিন্তু এখনো দ্বিতীয় বর্ষে ফাইনাল দিচ্ছি। তাও ল্যাব এক্সাম বাকি; আগে ল্যাব ক্লাস হবে তারপর এক্সাম!

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, সকল ধরনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। যেসব বিভাগের সক্ষমতা একটু কম তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্যোগ আছে। তিনি আরও বলেন, বৈশ্বিক মহামারির যে বাস্তবতা সেটাও আমাদের মেনে নিতে হবে। মানুষের সাধ্যের মধ্যে আমাদের সব ধরনের প্রয়াস অব্যাহত থাকবে।


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence