যেভাবে শহীদ হয়েছিলেন রাজু ভাস্কর্যের রাজু

মঈন হোসেন রাজু
মঈন হোসেন রাজু  © ফাইল ফটো

আন্দোলন মানেই যেন রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে দাঁড়াতে হবে। এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় টিএসসি চত্বরে অবস্থিত। পথচারী তো বটেই, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থীই পর্যন্ত এ ভাস্কর্যের ইতিহাস জানে না। অনেকে মনে করে, এটি মুক্তিযুদ্ধের আন্দোলনের একটি স্মারক। কিন্তু এই ভাস্কর্যর আসল ইতিহাসটি প্রজন্মের অধিকাংশ মানুষই জানে না। জানতে চায়ও না। ইতিহাস-বিস্মৃত এই জাতির কাছে অবশ্য এর বেশি কিছু আশা করাটাও ভুল!

১৯৯২ সালের ১৩ মার্চ। তৎকালীন প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনসমূহের জোট গণতান্ত্রিক ছাত্র ঐক্যের সন্ত্রাসবিরোধী মিছিল চলাকালে সন্ত্রাসীরা গুলি করলে মিছিলের নেতৃত্বদানকারী বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় নেতা মঈন হোসেন রাজু নিহত হন। রাজুসহ সন্ত্রাস বিরোধী আন্দোলনের সকল শহীদের স্মরণে নির্মিত হয় এই ভাস্কর্যটি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী রাজু। তার পুরো নাম মঈন হোসেন রাজু। তিনি ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের নেতা। সে সময় বুকভরা স্বপ্ন নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করেছিলেন রাজু। সুন্দর জীবনের স্বপ্ন, সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার, সমাজটাকে বদলে দেবার স্বপ্ন! কিছুটা একরোখা, জেদি অথচ আশ্চর্যরকম সরল রাজু ছিল সেই স্বপ্নবানদের একজন, বলা যায় মধ্যমণি। সকলের প্রিয়। সেই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ইউনিয়ন যারা করত তারা মোটামুটি একই রকম হলেও রাজু ছিল একটু আলাদা। সে ছিল অন্য সবার চেয়ে শান্ত কিন্তু দৃঢ়।

রাজুর নিয়মানুবর্তিতা ছিল চোখে পড়ার মতো। ক্লাস-পড়া-সংগঠনের কাজ সব কিছুতেই সে ছিল কর্তব্যনিষ্ঠ। সব কিছু ম্যানেজ করে চলত। তবে কিছুটা ব্যত্যয় ঘটত পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার ব্যাপারে। তখন রাজুর বাসা ছিল রাজধানীর শ্যামলীতে, যেখানে তার মা, বড়ভাই ও বোন থাকতেন। এই পরিবারের স্নেহধন্য জেদি ছেলে রাজুকে তাই পরিবারের টানে ও মায়ের অনুরোধে নিয়মিত বাসায় যেতে হতো। রাজু বাসায় যেত ঠিক, কিন্তু আবার ফিরেও আসত। ওর মন জুড়ে ছিল ক্যাম্পাস, বন্ধু-বান্ধব, সংগঠন, ছাত্রদের দাবি-দাওয়া-আন্দোলন। তাই তো বাসার চেয়ে ক্যাম্পাসে (শহীদুল্লাহ হলের ১২২ নম্বর রুমে, যেখানে তার সিট বরাদ্দ) তাকে বেশি দেখা যেত।

শুক্রবার ছিল সেদিন। রমজান মাস। ১৯৯২ সালের ১৩ মার্চ। রাজুসহ কয়েকজন ছাত্র ইউনিয়নের উদ্যোগে পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি কোচিং নিয়ে কথা বলছিল সবুজ চত্বরে। হঠাৎই বন্দুকযুদ্ধে অবতীর্ণ হয় ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা। টিএসসিতে জিম্মি হয়ে পড়ে শত শত সাধারণ শিক্ষার্থী। ঘটনাস্থলে বিপুল সংখ্যক পুলিশ উপস্থিত থাকলেও তাদের ভূমিকা ছিল স্রেফ দর্শকের।

পুলিশের এই ভূমিকার প্রতিবাদেই প্রথম সোচ্চার হয় রাজু। কর্তব্যরত পুলিশ অফিসারকে অস্ত্রবাজদের গ্রেপ্তার করার আহ্বান জানান তিনি। ক্ষোভ ও প্রতিবাদের মুখে পুলিশ ভূমিকা পালন করে বটে, কিন্তু সেটা ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক কর্মীদের প্রটেকশন দেওয়ার কাজে। অন্যদিকে বিপরীতে থাকা নেতাদের দিকে টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ করে; যা ক্রমেই বিস্তৃত হয় পুরো টিএসসিতে। অসংখ্য ছাত্রছাত্রী অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন।

এরই প্রতিবাদে তাৎক্ষণিকভাবে মিছিল বের করে রাজুরা। মিছিলে শরিক হন ‘গণতান্ত্রিক ছাত্রঐক্যভুক্ত’ বাম ছাত্রসংগঠনের কর্মীরা। টিএসসির সড়কদ্বীপ প্রদক্ষিণ করার সময় ডাসের সামনে ‘অস্ত্র শিক্ষা একসাথে চলবে না’, ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজ এক হও’- এ স্লোগান যখন উচ্চারণ হচ্ছিল, তখন হাকিম চত্বরের সামনে থেকে একঝাঁক বুলেট মিছিল লক্ষ্য করে ছুটে আসে। এর একটি গুলি কপালে লাগে তার।

স্লোগান মুখে নিয়েই সে লুটিয়ে পড়ে টিএসসির স্বোপার্জিত স্বাধীনতা ভাস্কর্যের সামনে সড়ক দ্বীপের পাশের রাস্তায়। মিছিল ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। সাধারণ শিক্ষার্থীরা প্রাণভয়ে দ্বিগ্বিদিক ছুটতে থাকে। তখন সময় সন্ধ্যা সোয়া ছয়টা। রাজুর রক্তমাখা দেহ নিয়ে তার বন্ধুরা রওনা হন ঢাকা মেডিকেল কলেজে, ৩২নং ওয়ার্ডে। রাজুর দেহ থেকে অবিরাম টপ টপ করে রক্ত ঝরতে থাকে। তার শার্ট রক্তে ভিজে যায়। রক্তাক্ত রাজুকে এক ঝলক দেখেই কর্তব্যরত ডাক্তার বললেন, রক্ত চাই, অনেক রক্ত। মুহূর্তে রাজুর সহযোদ্ধারা দল বেঁধে রক্ত দেওয়ার প্রক্রিয়ার শামিল হন।

আরও পড়ুন: ভাস্কর্যে ভাস্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

কিন্তু রাজুকে আর রক্ত দিতে হয়নি। সবার সব প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে, কাউকে কিছু করার সুযোগ না দিয়ে রাজু চিরতরে চলে যায়। একটা দুঃসহ বেদনা আচ্ছন্ন করে। রাজুর পরিবারের সদস্য– শোকবিহ্বল বড় ভাই রানা, শোকাতুর বোন রুমা আর গভীর যন্ত্রণাহত মাকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা হারিয়ে ফেলে তার বন্ধুরা। সন্ত্রাসনির্ভর রাজনীতির বুলেটে এভাবেই শেষ হয়ে যায় একটি অনন্ত সম্ভাবনা। বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লেখাপড়ার প্রকৃত পরিবেশ ফিরে আসুক। এমন একটি পবিত্র আকাঙ্ক্ষার মঈন হোসেন রাজু জীবন বিসর্জন দিয়েছে।

গানরত রাজুর কাঁধে যে ব্যাগটি ছিল সেই ব্যাগে ছিল নোটখাতায় নিজ হাতে টুকে রাখা জীবনানন্দের কবিতা এবং রং করার ব্রাশ ও হকিয়ার। সেই দিনের শহীদ রাজুর রক্তমাখা শার্ট ও ব্যাগ এখনো সংরক্ষিত রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সংগ্রহশালায়।

মৃত্যুর আগে মাকে বলতেন, ‘দেখো, একদিন আমার পরিচয়ে তুমি পরিচিত হবে।’ সেটিই হয়েছে আজ রাজুর নামেই তার মাকে চিনতে পারে সকলে। আজ রাজু বেঁচে নেই। কিন্তু রয়েছে তার রেখে যাওয়া চেতনা। যে চেতনা এখনো লক্ষ কোটি ছাত্রজনতাকে শিক্ষা দেয় প্রতিবাদের স্ফুলিঙ্গ কিভাবে প্রজ্বলিত করতে হয়। সে চেতনার সাক্ষী হয়ে এখনো দাঁড়িয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির সড়ক মোড়ে ‘সন্ত্রাসবিরোধী রাজু স্মারক ভাস্কর্য’। যেটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের ১৮ কোটি মানুষকে শিক্ষা দেয় কিভাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হয়।

রাজুর সহপাঠী চিররঞ্জন সরকার বলেন, “প্রতি বছর ১৩ মার্চ আসে, আমাদের হৃদয় বিষাদে ছেয়ে যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে শহীদ রাজু স্মরণে নির্মিত সন্ত্রাসবিরোধী ভাস্কর্যটি হতাশার মর্মরমূর্তি হয়ে দেখা দেয়। বুকের রক্তে সলতে জ্বেলে সন্ত্রাসের অন্ধকারে আগুন জ্বেলেছিল রাজু। আমরা যারা রাজুর সহযোদ্ধা ছিলাম, তারা চেষ্টা করেছিলাম একটি সুস্থধারার সমাজ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে যুক্ত থাকার। কিন্তু আমাদের সেই চেষ্টা অনেকটাই বিফলে গেছে। আজ আমরা অনেকেই কেবল স্মৃতিতাড়িত, অবসন্ন। সেই কাঙ্ক্ষিত স্বদেশ থেকে আমরা যেন ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছি। সব কিছু নষ্টদের দখলে চলে যাচ্ছে। অক্ষম দীর্ঘশ্বাস নিয়ে আমাদের সব স্বপ্ন-প্রত্যাশা-সম্ভাবনার কবর রচনা করতে দেখছি!”

১৯৯৭ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ. কে. আজাদ চৌধুরীর হাতে রাজু ভাস্কর্যের উদ্বোধন হয়। এর সামগ্রিক তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে আছে ছাত্র ইউনিয়ন। রাজু ভাস্কর্যের নকশাকার ভাস্কর শ্যামল চৌধুরী।

তিনি চারুকলায় ভাস্কর্য নিয়ে পড়েছেন। ঢাকা চারুকলায় বিএফএতে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট ছিলেন। অধ্যয়নকালে তিনি প্রোট্রেট ফিগার ও হিউম্যান ফিগার নিয়ে কাজ করতেন। পড়ালেখা শেষে ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ করতেন, এখনো করেন। কারণ তার চাকরি করার কোনো ইচ্ছা ছিল না। 

রাজু ভাস্কর্যের বিশেষত্ব সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘সন্ত্রাসবাদ বন্ধ করতে হলে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নাই। ভাস্কর্যে ছাত্রদের শক্তিশালী রূপ দেখানো হয়েছে ঐক্যবদ্ধতা দিয়ে। এটা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটা বার্তা।’

ভাস্কর্যে ৮ জনের অবয়ব ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। যাদের প্রতিকৃতি ব্যবহার করা হয়েছে তারা হলেন- মুনীম হোসেন রানা, শাহানা আক্তার শিলু, সাঈদ হাসান তুহিন, আবদুল্লাহ মাহমুদ খান, তাসফির সিদ্দিক, হাসান হাফিজুর রহমান সোহেল, উৎপল চন্দ্র রায় ও গোলাম কিবরিয়া রনি।


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence