মায়ের কোলে এসে ঢাবিতে পরীক্ষা দেওয়া সেই হৃদয় ইন্টার্ন করছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে

মায়ের কোলে এসে ঢাবিতে পরীক্ষা দেওয়া সেই হৃদয় ইন্টার্ন করছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে
মায়ের কোলে এসে ঢাবিতে পরীক্ষা দেওয়া সেই হৃদয় ইন্টার্ন করছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে  © সংগৃহীত

মায়ের কোলে চড়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে আসা ‘সেরিব্রাল পালসি’তে আক্রান্ত হৃদয় সরকারের স্বপ্নের বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) ভর্তির সুযোগ পেয়ে স্বপ্ন পূরণ হয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী হৃদয়। মায়ের কোলে এসে ঢাবিতে পরীক্ষা দেওয়া সেই হৃদয় সরকার এখন ইন্টার্ন (শিক্ষানবিশ) করছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। তিন মাসের জন্য তিনি ইন্টার্ন করছেন। 

২০১৮ সালের ২১ সেপ্টেম্বর ভর্তি পরীক্ষার দিন মায়ের কোলে হৃদয় সরকারের সেই ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। সেই আলোচিত ছবিটি তুলেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী এম এ আল মামুন। জানা যায়, কলেজে থাকতে প্রতিদিন মা হৃদয়কে কলেজের চতুর্থ তলার উপরে উঠাতো আর নামাতো। মায়ের জোরেই সে এই পর্যন্ত এসেছে। রাজধানীর আজিমপুরে থাকেন হৃদয়। বাসা থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নিয়মিত যাতায়াত করেন। 

হৃদয় জানালেন, হুইলচেয়ারে করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির কাছে মেট্রোস্টেশন থেকে মেট্রোতে চড়েন। এরপর সচিবালয় স্টেশনে নামেন। তারপর আবার হুইলচেয়ারে মন্ত্রণালয়ে যান। শান্ত নামের এক সহায়তাকারী সঙ্গে থাকে। সেই মন্ত্রণালয়ের গেট পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। মন্ত্রণালয়ের নতুন ভবনে হুইলচেয়ার নিয়ে যাতায়াতে কোনো সমস্যা হয় না।

হৃদয় জানালেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় প্রথমবারের মতো এবার ইন্টার্নশিপ চালু করেছে। লিখিত, মৌখিক পরীক্ষাসহ বিভিন্ন ধাপ পার হয়ে এতে নির্বাচিত হতে হয়। তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর থেকেই ইচ্ছা ছিল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কাজ করব। এখন ইন্টার্ন করার সুযোগ পেলাম। ফরেন ক্যাডারের মতোই সকাল নয়টা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করছি। আমার আশা, এই মন্ত্রণালয়ে নিজের যোগ্যতায় একদিন পূর্ণকালীন চাকরি পাব।’

ইন্টার্ন হিসেবে এ কয় দিনের কাজের অভিজ্ঞতা কেমন? জানতে চাইলে হৃদয় বললেন, ‘মন্ত্রণালয়ে প্রবেশগম্যতা নিয়ে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে কেউ বাজে ব্যবহার করেন না। কাজে সবার কাছ থেকে সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে।’

হৃদয়ের ছোট ভাই অন্তর সরকার এবার এইচএসসি পরীক্ষা দেবে। দুই ভাই একসঙ্গে আজিমপুরের ভাড়া বাসায় থাকে। বাবা সমীরণ সরকার ও মা সীমা রানী সরকার থাকেন নেত্রকোনার বাড়িতে। মাঝেমধ্যে ঢাকায় এসে দুই ছেলের সঙ্গেও কিছুদিন থাকেন মা–বাবা। ছোটবেলা থেকে একা হাঁটতে বা চলাফেরা করতে পারেন না হৃদয়। একটি ইলেকট্রিক, আরেকটি ম্যানুয়াল হুইলচেয়ার আছে তাঁর। সেগুলো ব্যবহার করে চলাফেরা করেন। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা জয় করেই তিনি এত দূর এসেছেন। 

হৃদয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় ১২০ দশমিক ৯৬ নম্বর পান। ৩৭৪০তম হন তিনি। প্রতিবন্ধী কোটায় ভর্তির আবেদন করেছিলেন হৃদয়। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবন্ধী কোটার বিধিমালা অনুযায়ী, শুধু দৃষ্টি, শ্রবণ ও বাক্‌প্রতিবন্ধীদের জন্য এই কোটা প্রযোজ্য ছিল। ফলে হৃদয়ের ভর্তি নিয়ে তৈরি হয় অনিশ্চয়তা। ভর্তির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী কোটার বিধিমালায় সংস্কার আনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। শারীরিক প্রতিবন্ধীদেরও যুক্ত করা হয়। এর মধ্য দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পান হৃদয়।

মায়ের কোলে করে আসা হৃদয় এখন ঢাবি'র কাঙ্খিত বিভাগে

মায়ের কোলে চড়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে আসা ছবিটি ভাইরাল হওয়ার পর বিবিসি প্রকাশিত বিশ্বের ১০০ জন অনুপ্রেরণাদায়ী নারীর তালিকায় স্থান (৮১তম) পেয়েছেন হৃদয়ের মা সীমা সরকার। 

নেত্রকোনার এই কৃতিসন্তানের হাতের সবকটি আঙ্গুলও ঠিকভাবে কাজ করে না। একারণেই মা তাকে সবসময় কোলে করেই আনা নেওয়া করতেন। হৃদয় উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন আবু আব্বাস ডিগ্রি কলেজ নেত্রকোনা থেকে এবং মাধ্যমিক পাশ করেছেন নেত্রকোনা জিলা স্কুল থেকে।


সর্বশেষ সংবাদ