গ্রাফিক আর্টস ইনস্টিটিউট

ছাত্রদল নেতার নেতৃত্বে ‘ছাত্রলীগ’ ট্যাগ দিয়ে ১৬ ঘণ্টা নির্যাতন

তিনবার অজ্ঞান, পরে মৃত ভেবে রেখে যান

গ্রাফিক আর্টস ইনস্টিটিউটের আতিকুর রহমান গাল্টুকে ১৬ ঘণ্টা আটকে রেখে নির্যাতন
গ্রাফিক আর্টস ইনস্টিটিউটের আতিকুর রহমান গাল্টুকে ১৬ ঘণ্টা আটকে রেখে নির্যাতন  © সম্পাদিত

রাজধানী ঢাকার গ্রাফিক আর্টস ইনস্টিটিউটের আতিকুর রহমান গাল্টু নামের ৫ম পর্বের এক শিক্ষার্থীকে ছাত্রলীগ সন্দেহে ১৬ ঘণ্টা আটকে রেখে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে। গত বৃহস্পতিবার (১৫ মে) দিবাগত রাত ১১টা থেকে পরের দিন বিকেল ৩টা পর্যন্ত টানা ১৬ ঘণ্টা এ নির্যাতন চলে বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগী। আজ বুধবার (২১ মে) রাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট করে ভুক্তভোগী নিজেই জানান। অভিযুক্তরা হলেন- ছাত্রদল নেতা মাহী ও কারিগরি ছাত্র আন্দোলনের এক কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে চাইলে আজ রাতে গ্রাফিক আর্টস ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ (অতিরিক্ত দায়িত্ব) ফারহানা ইয়াসমিন দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, এ ঘটনাটি গত বৃহস্পতিবারের, তবে আমি শুনেছি গত পরশুদিন (সোমবার)। শোনার সাথে সাথেই অভিযুক্তদেরকে সাময়িক বহিস্কার করা হয়েছে। এ ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। আমরা কাজ করছি। তদন্ত শেষে জড়িতদের ব্যাপারে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী জানান, ছাত্রলীগ এবং মোবাইল চোর সন্দেহে গাল্টুর ওপর নির্যাতন চালানো হয়। এসময় তিনি তিনবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। অভিযুক্তরা তার মোবাইল ফোন নিয়েও চেক করেন বলে তার অভিযোগ। ভুক্তভোগী জানান, তিনি কোনো অপরাধ করে থাকলে তাকে না মেরে পরিবার বা ইনস্টিটিউটের কাছে জানাতে পায়ে ধরে অনুরোধ জানালেও অভিযুক্তরা থামেননি।

আরও পড়ুন: চতুর্থ হয়েও ঢাবিতে মাস্টার্স করার সুযোগ পাননি হিজবুল্লাহ, পুলিশে দেওয়ার কথা বলেছিলেন সাদেকা হালিম

ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে ভুক্তভোগী আতিকুর রহমান গাল্টু লেখেন, আমি আতিকুর রহমান গাল্টু। গ্রাফিক্স আর্টস ইনস্টিটিউটের ৫ম পর্বের শিক্ষার্থী। গত ১৫/০৫/২০২৫ বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ১১.০৫ মিনিট পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী, ছাত্রদল নেতা মাহী ও কারিগরি ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি তার মোবাইল নম্বর থেকে কল দিয়ে আমাকে ডেকে নিয়ে যায়। আমি বলেছি, আমি কেবল ডিউটি থেকে আসছি। খুব ক্লান্ত এখন আসতে পারবো না। কালকে সকালে আসি? কিন্তু তারা বলে, এখনই আসতে হবে। খুব জরুরি কথা আছে৷ কোন সমস্যা হবে না। আমি আবার বললাম, আমার ফ্যামিলি টেনশন করবে। তারপরও তারা আমাকে জোরপূর্বক নিয়ে যায়। পরে আমি ছাত্রাবাসে গিয়ে দেখি আমার সহপাঠী দুজন ও ১৩/১৪ জন সিনিয়র ভাইরা বসে আছেন আমি যাওয়ামাত্রই তারা আমাদেরকে নানা কৌশলে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে আমাদেরকে বলে- আমরা ছাত্রলীগ করি ও হলে একটি মোবাইল হারিয়ে গিয়েছে সেই মোবাইল নাকি আমরা নিয়েছি। ‘কে নিছস তোরা এখন বল।’

তিনি বলেন, এক পর্যায়ে ওরা তিনজনকে আলাদা রুমে নিয়ে তাদেরকে নিয়ে বলে- টিটু ও শাওন বলেছে, আমি নাকি ফোন নিয়েছি ওরা স্বীকার করেছে। আবার ওদেরকে বলে আমি আতিক স্বীকার করেছি টিটু ও শাওন মোবাইল নিয়েছে। বিনাকারণে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে নানা কৌশলে রাতভর এবং শুক্রবার জুম্মা বিকেল ৩টা পর্যন্ত শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালায়৷ এর মধ্যে আমি তিন তিনবার অজ্ঞান হয়ে গিয়েছি। এর মাঝে যখন আমি জ্ঞান ফিরে পাই আমি খুব বিব্রতকর অবস্থায় ছিলাম এবং যন্ত্রণায় ছটফট করতেছিলাম। তাদেরকে তখন হাতে-পায়ে ধরে বলি, আমি যদি কোন অপরাধ করে থাকি তাহলে কর্তৃপক্ষ এবং আমার পরিবারকে জানান, তারা যা সিদ্ধান্ত নিবেন- আমি সেটাই মেনে নিব। "আমি আপনাদের ছোট ভাই আপনারা আমার ইনস্টিটিউটের বড় ভাই আপনাদের ছোট ভাই মনে করে আমাকে আর মারবেন না।" "আমাকে আর গায়ে হাত দিয়েন না আমার বাবা নেই, আমি এতিম- আমার মা বড় অসহায়৷ আমার কিছু হয়ে গেলে আমার মা সহ্য করতে পারবে না। দয়া করে আমাকে আর মারবেন না। আমি আর যন্ত্রণা সহ্য করতে পারছি না।" কিন্তু তারপরও তারা না শুনে একের পর এক অত্যাচার করেই যেতে থাকে। একটা সময় আমি একেবারে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। পরবর্তী দিন আমি বারোটার দিকে জ্ঞান ফিরে পাই। তখন দেখি যে রুমের দরজা খোলা। কিন্তু আমি আশেপাশে কাউকে দেখিনি।

গাল্টু আরও বলেন, আমার মোবাইল থেকে শুরু করে সকল কিছু নিয়ে যাওয়ায় আমি কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারিনি। ক্লান্তিতে আমি উঠতেই পারছিনা। আমি ওই ভাবেই পড়েছিলাম তিনটা পর্যন্ত। একটা সময় দেখি যে আমার সাথে একজন সহপাঠী যে অত্যাচারিত হয়েছে। ও রুমের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। ওরা ভেবেছে আমি মনে হয় মারা গেছি। আমার অচেতন অবস্থা দেখে ও কান্নায় ভেঙে পড়ে। আমি অল্প অল্প চোখ খুলছিলাম। এমন সময় রুমে কেউ না থাকায় ওর কাঁধে ভর দিয়ে অন্য এক ক্লাসমেটের রুমে নিয়ে যায়। আমার পরিবারের সাথে যোগাযোগের ব্যবস্থা করতে বলে। সেখানে আমার কিছু সহপাঠী উপস্থিত ছিল। আমার ফোন না থাকায় ওরা ওদের ফোন দিয়ে আমার ফ্যামিলির সাথে যোগাযোগ করেছে। পরে তারা 999 এ ফোন দিয়ে আমাকে পুলিশসহ সাতটার সময় উদ্ধার করে। ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে আমার ফ্যামিলি বলে, ওর মোবাইল কোথায়- মোবাইল এখন দিতে হবে। তখন ওরা ভয়ে মোবাইলটি দিয়ে যায় আমার ফ্যামিলির কাছে।

আরও পড়ুন: দুই লাখ টাকা চাঁদা দাবি, বৈষম্যবিরোধীর সাবেক ২ নেতা গ্রেপ্তার

নির্যাতনের ঘটনার পরে অবস্থা জানিয়ে ভুক্তভোগী এই শিক্ষার্থী লেখেন, সেখান থেকে বের হয়ে আমি শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেলে গিয়ে চিকিৎসা নেই। চিকিৎসার পর আমরা থানায় আসি এবং মামলা দায়ের করতে চাই। কিন্তু তারা মামলাটা গ্রহণ করতে চাচ্ছিল না। তারা বলছিল ইনস্টিউটের কর্তৃপক্ষকে জানাতে। সেদিন ছিল শুক্রবার, বন্ধের দিন। তাই কর্তৃপক্ষকে জানাতে পারছিলাম না। আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না কি করব। তখন আমি ট্যাক্স সদস্যদের ফোন দেই। তারা তখন সাথে সাথেই আসে।

‘‘আমি ও আমার ট্যাগ মেম্বাররা পুলিশ সদস্যদেরকে বলি, আমরা আপনাদের হয়ে এসিস্ট্যান্ট হিসেবে কাজ করছি। সেই খাতিরে আমার মামলাটা দয়া করে আপনারা নেন। যখন তারা বুঝতে পারছে আমরা তাদের সাথে সম্পৃক্ত আছি তারা তখন মামলাটি না নিয়ে অভিযোগ আকারে নেন এবং বলেন ইনস্টিউট প্রশাসনকে অবগত করতে বলেন। পরে ইনস্টিটিউট যখন খোলা হয় আমরা তাদেরকে জানাই এবং তারা দুই পক্ষে সবকিছু শুনে আমাকে নির্দোষ বলে জানিয়েছে। আমাদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী৷ আমি ভেবেছিলাম, তাদের ক্ষমা করে দিব।’’

গাল্টু বলেন, আমি যেহেতু একজন ছাত্র। তাদের ভবিষ্যৎ নষ্ট করতে চাইনি। তারা ছিল লাস্ট ইয়ারের ছাত্র। আমি যখন পদক্ষেপ নিলাম, তখন এই শুনি আরেক ছাত্রর সাথে এই ধরনের ঘটনা ঘটেছে। তার নাম হলো কুরবান। আর গলার উপর পাড়া দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল চিৎকার করছে তবুও তারা ছাড়েনি।

‘‘এটা শুনে তখন আমি ভাবলাম, এটা আসলে ক্ষমার যোগ্য না। পরে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম আবরার, তোফাজ্জল, সাম্যর মতো বিনা অপরাধে আর কারো মা-বোনের বুক যেন খালি না হয়। আমাকেও মারার সময় বারবার জিজ্ঞেস করছিলো, ‘আবরারের কথা মনে আছে?’ তখন আমি ভেবে নিয়েছি এটাই আমার শেষ। আমার পরিবার, আমার মা-বোনের সাথে আর কখনো দেখা হবে না।’’


সর্বশেষ সংবাদ