পাহাড় ছাপিয়ে স্বপ্নের কাছে সজীব চাকমা
- এম রহমান
- প্রকাশ: ২৮ অক্টোবর ২০২৪, ০১:৫১ PM , আপডেট: ২৮ অক্টোবর ২০২৪, ০১:৫১ PM
সচিব কান্তি চাকমা, ডাকনাম সজীব। বাড়ি খাগড়াছড়ি জেলার লক্ষ্মীছড়ি উপজেলার শিলাছড়ি গ্রামে। ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হয়েছেন ময়মনসিংহের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগে। তবে মসৃণ ছিল না সজীবের এই চলার পথ। ছোট্ট এই জীবনে চড়াই উতরাই পার হতে হয়েছে অসংখ্য।
সজীবের জন্ম পাহাড়ের এক ছোট্ট জুম ঘরে। পাহাড়ের বাকি আট-দশ জনের মতন জুমঘরের চারপাশে সবুজ জুম ধানের ক্ষেত দেখেই কেটেছে তার শৈশব। পাহাড় থেকে পাহাড়ে উড়ে-ঘুরে বেড়াতো শিশু সজীব। জুমের ফসল যখন তোলার উপযুক্ত হত, জুমঘর ভরে উঠতো তার দাদু-দাদি, পিসিমা, কাকা-কাকিসহ অনেক আত্মীয় স্বজন দিয়ে। বাবা-মা আর সে, ভালোই দিন কাটছিলো ছোট্ট এই পরিবারটির। সজীব পার করেছে জীবনের সবে চারটি বছর।
চিত্র: সজীবের দাদা-দাদির জুমাঘর
সজীবের বয়স তখন সবে চার বছর। তার গল্পে হারানোর অংশটি এখান থেকেই শুরু। এক অজানা রোগ দানা বাঁধে সজীবের মায়ের শরীরে, জানতো না পরিবারের কেউ-ই। হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়েন সজীবের মা। নেওয়া হলো লক্ষ্ণীছড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। ফুফাতো ভাইকে নিয়ে মাকে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দেখতে যায় সজীব। সজীব সেদিন জানতো না তার মা তাকে শেষবারের মতো মমতা ভরা হাতে ফল খাওয়ালেন। আদর করলেন। মাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রেখে ফিরে আসে সজীব। পরদিন সজীবের মাকে ফেরত আনা হয় বাড়িতে। হয়তো শেষ সময়টুকু পরিবারের ছায়ায় কাটিয়ে যেতেই।
রাত পোহাতেই সজীবের মা বিদায় নিলেন চিরতরে। ছোট্ট সজীব না বুঝতে পেরেছিলো মা হারাবার দুঃখ, না আন্দাজ করতে পেরেছিলো জীবনের আসি শোচনীয় দিনগুলোর যন্ত্রণা। স্ত্রীকে হারিয়ে সজীবের বাবা কিছুদিন ভবঘুরে জীবন কাটিয়ে নতুন সংসার পাতেন।
আরও পড়ুন: খুমি সম্প্রদায়ের প্রথম নারী হিসেবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন তংসই
মা হারিয়ে সজীব বড় হতে থাকে দাদুর বাড়িতে। যত্নের কমতি না থাকলেও ছিলো কিছুটা অভাব, আর পড়াশোনা চালিয়ে যাবার পরিবেশের কমতি। পাকিস্তান আমলে তৃতীয় শ্রেণি পাস করা দাদু নিলেন সজীবের পড়ালেখার ভার৷ ভর্তি করান উপজেলা কিন্ডারগার্টেন স্কুলে। দাদুর আগ্রহ আর সহযোগীতায় প্রাথমিকের গণ্ডি পেরিয়ে যায় সজীব। ভর্তি হয় পিএফসি কিন্ডারগার্টেন স্কুলে। কিন্তু দিনকে দিন কঠিন হতে থাকে পরাবার রাস্তা। আর্থিকভাবে দূর্বল হওয়ায় সজীবের জন্য বিকল্প প্রতিষ্ঠান খুঁজতে গিয়ে সন্ধানে মেলে বান্দরবান কোয়ান্টাম স্কুলের- যেখানে অনাথ শিশুদের বিনামূল্যে পড়বার ব্যবস্থা করা হয়।
চিত্র: দাদা-দাদির সাথে জুমাঘরে সজীব
কোয়ান্টামে ভর্তির জন্য আদাজল খেয়ে লেগে পড়ে সজীব। কিন্তু বিধি বাম! ইংরেজিটা যে বড্ড কাঁচা। আর্থিক অসংগতির কারণে প্রাইভেট টিউটর রাখাও সম্ভব নয়। অগত্যা সজীব সিদ্ধান্ত নেয় জেএসসির ইংরেজি পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বনের। কিন্তু ধরা পড়ে বহিষ্কৃত হয় সজীব। দিশেহারা হয়ে পড়ে সে।
কিন্তু সেখানেই থেমে যাওয়া বোধহয় সজীবের ভাগ্যদেবতা লেখেননি। তার কয়েকজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক সোনা মিত্র চাকমা, রবি চন্দ্র চাকমা ও অনিময় চাকমার সহযোগিতায় সে তাঁদেরই প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে আবারো জেএসসি পরীক্ষা দেয় এবং সর্বোচ্চ ভালো ফল অর্জন করে উত্তীর্ণ হয়। সুযোগ পায় বিনামূল্যে নবম-দশম শ্রেণিতে অধ্যয়নের। এরই ফাঁকে করেছে রাজমিস্ত্রীর কাজও। শুধু তাই নয়, চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজে চেপে শ্রমিকের কাজ করতেও পাড়ি জমিয়েছিলো সজীব। অর্থাভাব ও পারিবারিক দুশ্চিন্তায় কোভিড-১৯ এর সময়টা কাটিয়েছে দুর্বিষহ ভাবে। পড়ালেখায় ছেদ পড়লেও ছেড়ে দেয়নি সজীব। এসএসসি পরীক্ষায় নিজের প্রতিষ্ঠান থেকে আবারও সর্বোচ্চ ভালো ফল অর্জন করে উত্তীর্ণ হয় সজীব। স্বপ্ন হয় আরও বড়।
আরও পড়ুন: চাকমা হয়েও পড়ছেন ইসলামের ইতিহাস, পদক জয় এসএ গেমসে
কিন্তু অর্থকষ্ট পিছু ছাড়ে না। কলেজে ভর্তি হওয়া যখন অনিশ্চিত, তখন এগিয়ে আসেন প্রাক্তন উপজেলা নির্বাহী অফিসার জনাব ইয়াছিন শিমুল সহ আরও অনেকে৷ ‘প্রিয়দর্শী চাকমা শিক্ষা বৃত্তি’ লাভ করে এককালীন কিছু অর্থ পাবার পাশাপাশি পায় ইয়াছিন শিমুল সহ অনেকের সহযোগিতা। উপহার পায় একটি সরকারি ঘর। পড়ালেখার পাশাপাশি চালিয়ে গেছে টিউশনিও। এই সময় তাকে মানসিক ও দিকনির্দেশনামূলক সাহায্য করেছে শান্তানু চাকমা নামে তার এক দাদা। এইচএসসির ফর্ম পূরণের সময় ‘মানুষ মানুষের জন্য’ ফাউন্ডেশন থেকে এককালীন অর্থ পায় সজীব। জিপির ৪.০০ নিয়ে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর সজীব স্বপ্ন দেখে বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখবার।
চিত্র: চিরসবুজ পাহাড়, সজীবদের জুমাঘর প্রাঙ্গণ থেকে
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দ্বারা পরিচালিত ‘জুম একাডেমি’ নামক কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয়ে পড়ালেখা শুরু করে সজীব। তার আর্থিক দুরাবস্থা ও লেখাপড়ার আগ্রহ দেখে তাকে বিনামূল্যে পড়বার সুযোগ করে দেন তাঁরা। স্বপ্নের আরো কাছাকাছি যেতে থাকে সজীব। কিন্তু চড়াই উতরাই যে পাহাড়ের ছেলে সজীবের চিরসখা! ঢাবির ভর্তি পরীক্ষার সময় অসুস্থ হয়ে পড়ে সজীব। মেলেনা আশানুরূপ ফল। একই ভাবে খারাপ হয়ে যায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাও। তবে মনোবল যুগিয়ে গেছেন শান্তানু চাকমা। অবশেষে সজীব ভর্তির সুযোগ পায় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগে। সিনেমার গল্পের মতো শোনালেও এটা সজীবের জীবনের গল্প। পুরোটা যাত্রায় সকল সাথী আর শুভাকাঙ্ক্ষীদের কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে সজীব। জানিয়েছে প্রতিষ্ঠিত হয়ে কিংবা হওয়ার পথেই থেমে যাওয়া শিক্ষার্থীদের পুনরায় উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করবে সে।
নির্মল আকাশের নিচে বিশাল পাহাড়ের বুকে বেড়ে ওঠা সজীবের জীবন ঝিরির জলের মতোন শান্ত ছিলো না যদিও, কিন্তু অটল ছিলো ঠিক পাহাড়ের মতোই। স্বপ্নের পথে এগিয়ে গেছে চঞ্চল মৃগের মতো। জীবনের আশীর্বাদ নেমে আসবে- এই আশার স্বপ্নই বুনছে সজীব।