বিসিএস পরীক্ষার আগে স্ত্রীকে বলেছিলাম—‘তোমার জন্য ক্যাডার হতে চাই’

মো. হাবিবুর রহমান
মো. হাবিবুর রহমান  © টিডিসি ফটো

৪৩তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন মো. হাবিবুর রহমান। বিসিএসের আগে তিনি কাজ করেছেন একাধিক ব্যাংকে। হাবিব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত গণিত বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করেন। বিসিএসে সুপারিশপ্রাপ্ত হওয়ার আগে ২০২০ সালে তিনি বিয়ে করেছেন, হয়েছেন সন্তানের বাবাও। নিজের সাফল্যে হাবিব তার বাবা-মা ও স্ত্রীকে কৃতিত্ব দিয়েছেন। এমন সাফল্যে পূর্ণ করেছেন স্ত্রীকে দেওয়া নিজের প্রতিশ্রুতিও।

হাবিবুর রহমানের গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরের উত্তর মতলবের ছেংগারচর বাজারের তালতলীতে। তার বাবার নাম মো. আবুল কালাম। তার বাবা পেশায় একজন ব্যাংকার (রূপালী ব্যাংক পিএলসি)। তারা এক ভাই এক বোন। তিনি তার মাধ্যমিক একে উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এবং উচ্চ মাধ্যমিক ঢাকা কলেজ থেকে পাস করেন। পরবর্তীতে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০১৪-২০১৫ সেশনে ফলিত গণিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করেন।

বড় ভাইয়ের মুখে প্রথম বিসিএস সম্পর্কে শুনে শুরু করেছিলেন প্রস্তুতি। তিনি বলেন, অনার্স ৩য় বর্ষ পর্যন্ত তেমনটা আগ্রহ ছিলো না। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় ভাই আর আমি মিলে একসঙ্গে একটা কোচিং সেন্টার চালাতাম। বড় ভাইয়ের মুখেই প্রথম বিসিএস সম্পর্কে শোনা। তার মুখেই ক্যাডার হলে কী হবে না হবে সব কিছু সম্পর্কে আইডিয়া নিয়েছি।

শুরু থেকেই শুরু করেছেন হাবিব। তিনি বলেন, প্রিলিমিনারি ব্যাপারগুলো ভাইয়া থেকেই জেনেছি। এরপর বিসিএস রিলেটেড যত গ্রুপ আছে সবগুলাতে এড হই। বিভিন্ন ক্যাডার ভাইদের প্রোফাইলে ঘুরতে থাকি। ধীরে ধীরে স্বপ্ন বাধতে শুরু করি বিসিএসের প্রতি। এরপর স্নাতকোত্তর ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করি। করোনার সময় সবকিছু যখন বন্ধ হয়ে যায়, তখন ভালো একটা সময় পাই পড়াশুনা করার। সেই সময়েই মূলত বিসিএসের প্রস্ততি নিয়েছি।

শুরুর দিকে অগোছালোভাবে পড়লেও বিগত সালের প্রশ্ন দেখে একটা ভালো ধারণা পেয়েছেন তিনি। বলেন, প্রস্তুতির শুরুতে অনেক কিছু ঘেটে ঘেটে অযথা অনেক কিছু পড়ে ফেলেছিলাম। যেগুলো না পড়লেও হতো। মডেল টেস্ট ও বিগত বছরের প্রশ্ন ভালোভাবে শেষ করার পর বুঝতে পারি, কী পড়তে হবে বা কতটুকু পড়তে হবে। বিসিএস প্রিপারেশনে আসলে কী কী পড়বো তার থেকে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে কী কী পড়বো না। এই বোধটা চলে আসলে অল্প সময়ে খুব ভাল প্রস্ততি নেওয়া যায়।

হাবিবুর ৪১তম বিসিএসে প্রথম অংশগ্রহণ করেন। আশানুরূপ ফল না পেয়ে অংশ নেন ৪৩তম বিসিএসে। এই বিসিএসেই দিয়েছেন প্রথম ভাইভা। পেয়েছেন সাফল্য। প্রশাসন ক্যাডারে হয়েছেন ২৪৩তম।

সফলতার অনুভূতি নিয়ে তিনি বলেন, এটাকে আমি একটা দায়িত্ব বলতে চাই। উপরে যিনি আছেন তিনি খুব কঠিন একটা দায়িত্বের মধ্যে আমাকে ফেলেছেন। উনি সহায় না হলে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা খুব কষ্ট হবে। আমি সবসময় আমার নিজের কাজটুকু ঠিকঠাকভাবে করে গেছি। আমি দুইটা সরকারি ব্যাংকে চাকরি করা অবস্থায় প্রিপারেশন নিয়েছি। প্রিলি পরীক্ষার সময় শিখো টেকনোলজিস নামক একটা ইডিটেক প্রতিষ্ঠানে ডেপুটি ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত ছিলাম। রিটেন পরীক্ষার সময় প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকে অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলাম। আর ভাইবার দেওয়ার সময় সোনালী ব্যাংক পিএলসিতে সিনিয়র অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলাম।

হাবিব বলেন, এই তিন প্রতিষ্ঠানের কেউ বলতে পারবেন না, আমার পড়াশুনার জন্য তাদের কাজের কোনো ক্ষতি হয়েছে। অন্যদিকে আমার মনে হয়, অন্য অনেকের চেয়ে আমি আরও বেশি কাজ করেছি। এটা বলার জন্য বলছি না, আমি নিজের কাজটুকু ঠিকঠাক করতে খুব ভালোবাসি। সম্ভবত এটাও আমার এই সাফল্যগুলোর পেছনে ভূমিকা রেখেছে।

প্রশাসন ক্যাডার হাবিবের জীবনেও আছে অপ্রাপ্তির গল্প। না বলা সে গল্প শেয়ার করেছেন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের সঙ্গে। তিনি বলেন, আম্মুর স্বপ্ন ছিল তার ছেলে ডাক্তার হবে। কিন্তু পূরণ করা যায়নি মায়ের সে স্বপ্ন।

‘‘শেষবার হাসপাতালে গেলে এক ডাক্তারকে আসতে দেখে সবাই যখন দাঁড়িয়ে সালাম দিচ্ছিলো, সম্মান দিচ্ছিলো, আম্মু তখন কীভাবে যেন আমার দিকে তাকিয়ে ছিল! হয়তো অনেক কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারেনি। রেজাল্টের পর প্রশ্ন করেছিলাম আর কিছু লাগবে কী না? আম্মু বলেছে, এক জীবনে তার আর এর থেকে বেশি কিছু চাওয়ার নেই। আম্মুর মুখ থেকে এই লাইনটা শুনার সৌভাগ্য সব ছেলে-মেয়ের হয় না।’’

হাবিব বলেন, একবার জমি রেজিস্ট্রি করতে সাব রেজিস্টার অফিসে গিয়েছিলাম আব্বুর সাথে। সাব রেজিস্টারকে দেখে বাবা খুব কাচুমুচু হয়ে কথা বলছিলেন। সেদিন নিজেকে ছেলে হিসেবে কেমন জানি অসহায় লাগছিলো। আমি সাব রেজিস্ট্রারকে কোনো দোষ দিচ্ছি না বা খাটো করে দেখছি না। কিন্তু বাবা কাচুমুচু হওয়াটা কেন জানি কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সেদিন ওই জায়গায় দাঁড়িয়ে নিজেকে ওয়াদা করছিলাম, নিজে বড় কিছু হয়ে আব্বুকে খুশি করবো। আলহামদুলিল্লাহ।

হাবিব একা একাই বিসিএসে এমন সাফল্য পাননি। তার সাফল্যের পেছনে রয়েছে তার স্ত্রীর অবদানও। তিনি বলেন, আমি বিবাহিত। বউ আপাতত গৃহিণী, ভালো রাঁধুনি। বিসিএস জার্নির পথচলার শুরু দিকে একবার তাকে বলেছিলাম, তোমার জন্য ক্যাডার হতে চাই। কেন বলেছিলাম জানি না। কিন্তু মন থেকেই বলেছিলাম। এরপর রেজাল্টের কিছু দিন আগেও একজন এসিল্যান্ড অফিসে রুমের একটা ছবি দেখে আমার বউ বলে উঠে, ইশ এরকম একটা জায়গায় যদি আমি ছবি তুলতে পারতাম। সত্যি কথা বলতে কী, ওইদিন মনে মনে অনেক ভয় কাজ করেছে। আসলেই কী পারবো আমি? যদি নেগেটিভ কিছু আসে তাহলে বউকে মানাবো কীভাবে। এরকম হাজারো প্রশ্ন ঘুরে ফিরে আসে।

বিয়ে করা, বাচ্চা নেওয়া ইত্যাদি জীবনের একটি অংশ। তিনি বলেন, এগুলোর কোনটার জন্যই ক্যারিয়ার নষ্ট হয় না বা প্রতিবন্ধকতা হয় না। তিনি বলেন, যদি আপনি সবকিছু ম্যানেজ করে নিতে পারেন, তাহলে এগুলো ক্যারিয়ারের সাথে প্যারালারলি চালানো সম্ভব। 

হাবিবুর রহমান বলেন, জীবনে সবসময় প্ল্যান ‘বি’ রাখতে হবে। চাইলে প্ল্যান ‘সি’ অথবা ‘ডি’ও রাখা যায়। যেন প্রথম প্ল্যান ফেল হলে ওই জায়গাতে বসে পড়তে না হয়। আমি যখন ব্যাংকে চাকরি করছি আমার প্রথম প্ল্যান ছিল বিসিএস হলে ব্যাংক থেকে বের হয়ে আসবো। প্ল্যান ‘বি’ ছিল সোনালি ব্যাংকেই শেষ পর্যন্ত থাকা। এর জন্য যা যা করার করে গেছি। অর্থাৎ কোনো কারণে বিসিএস না হলেও আমার মধ্যে জীবন যুদ্ধে হেরে যাওয়া ব্যাপারটা কাজ করতো না।


সর্বশেষ সংবাদ