বিসিএস ক্যাডার হয়ে মাকে ফোন— ‘আমি ম্যাজিস্ট্রেট ইমন বলছি’

মো. ইমন হোসেন
মো. ইমন হোসেন  © টিডিসি ফটো

৪৩তম বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে (বিসিএস) প্রশাসন ক্যাডারে সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মো. ইমন হোসেন। বুয়েট থেকে স্নাতক শেষ করার বছরই বাবাকে হারান তিনি। এ পরিস্থিতিতে দেশে থাকবেন, নাকি বাইরে ক্যারিয়ার গড়বেন—সেটা নিয়ে চিন্তিত ছিলেন তিনি। পরে অনেকটা শোক নিয়েই স্নাতক শেষে চাকরির প্রস্তুতি শুরু করেন ইমন। পেয়েছেন সাফল্যও।

ইমনের বাড়ি বরিশাল জেলার মুলাদি থানার বাটামারা ইউনিয়নের আলিমাবাদে। তার বাবার নাম মো. আনিছুর রহমান। তিনি খামারবাড়ির কৃষি তথ্য সার্ভিসের দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা ছিলেন। মায়ের নাম রোকসানা রহমান। তিন ভাই বোনের মধ্যে বড় ভাই পপুলার ডায়াগনস্টিকের একজন প্যাথোলজিস্ট। আর ছোট বোন এইচএসসি প্রথম বর্ষে ছাত্রী।

ইমন ঢাকায় তার প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে গ্রামে ফিরে যান। সেখান থেকে নেন মাধ্যমিক শিক্ষার। এরপর আবার ঢাকায় ফিরে এসে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হন বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ পাবলিক কলেজে। এখান থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করেন তিনি। পরবর্তীতে ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষে বুয়েটের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হন। পরে বুয়েট থেকে ২০১৯ সালে বিএসসি শেষ করেন তিনি।

স্নাতক শেষ করার পরের বছর ২০২০ সালে তিনি তার বাবাকে হারান। অনেকটা শোক নিয়েই শুরু করে দেন বিসিএস ও অন্যান্য চাকরির প্রস্তুতি। পেয়েছেন সফলতাও। বর্তমানে তিনি পটুয়াখালির ১৩২০ মেগা ওয়াট তাপ বিদুৎ কেন্দ্রে সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। এরমধ্যে সর্বশেষ প্রকাশিত ৪৩তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন তিনি।

চাকরির প্রস্তুতির অভিজ্ঞতা জানিয়েছে ইমন জানান, ২০১৯ সালের এপ্রিলে বুয়েট থেকে বিএসসি শেষ করে বের হই। এরপর ২০২০ সালে বাবা মারা যান। তখন থেকেই চাকরির খুব প্রয়োজন ছিল। চাকরির তাড়না থেকে শুরু করলাম ইঞ্জিনিয়ারিং চাকরির প্রিপারেশন। আর ফাঁকে ফাঁকে বিসিএসের প্রিপারেশনও নিচ্ছিলাম।

তিনি বলেন, দুই প্রিপারেশন যেন বিপরীত মেরুর, মিল নেই। মেকানিক্যালে পদের সংখ্যা কম থাকায় সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত চাকরি পাওয়াও সহজ ছিল না। সেইসঙ্গে তখন চলছিল কোভিডের মহামারি। চাকরির পরীক্ষাগুলোও হচ্ছিল না। প্রায় ৮-৯ মাস এভাবেই কেটে যায়। 

May be an image of 2 people, wingtip shoes and suit

ইমন বলেন, এর মধ্যে বুয়েটে মাস্টার্স এডমিশন টেস্ট দিয়েছিলাম। চান্স পেলে পরবর্তীতে ভর্তি হই। মাস্টার্সে দেখা মিলল লম্বা ক্লাস শিডিউল, অ্যাসাইনমেন্ট ও ১৮ ক্রেডিটের থিসিস আতঙ্ক। একদিকে মাস্টার্স, অন্যদিকে জব প্রিপারেশন— একই সঙ্গে সম্ভব হবে না বুঝতে পারলাম। তাই আর মাস্টার্স সম্পন্ন করিনি।

ইমনের প্রথম চাকরি হয়েছিল পটুয়াখালী ১৩২০ মেগাওয়াট তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রে। তিনি বলেন, ২০২১ সালের অক্টোবরে সহকারী প্রকৌশলী (মেকানিক্যাল) হিসেবে পটুয়াখালী ১৩২০ মেগাওয়াট তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রে (আরএনপিএল) যোগদান করি। ছাত্র অবস্থায় পাওয়ার প্ল্যান্টে কাজ করা ড্রীম জব ছিল। সেই সুযোগও পেয়েছি, আলহামদুলিল্লাহ।

আরও পড়ুন: ক্যাডার হয়ে একরামুল বললেন— স্ট্রাগল আছে বলেই জীবন সুন্দর

বিসিএস প্রস্তুতির বিষয়ে তিনি বলেন, আমি কখনোই মেধাবীদের দলে ছিলাম না। ছোটবেলা থেকে শুধু পড়াশোনায় একটা রেগুলারেটি মেনটেইন করেছি। খুব বেশি মাত্রায় সিরিয়াস হয়ে যাওয়া কিংবা একদমই পড়াশুনা না করা— এমনটি কখনো হয়নি। পড়াশোনা সর্বদাই একই প্যাটার্নে বাঁধা ছিল। এতেই আমি অভ্যস্ত এবং আমার জন্য এটা কাজও করেছিল। 

রুটিন জীবনযাপন তাকে সফলতা পেতে সহায়তা করেছে বলে মনে করেন তিনি। ইমন বলেন, পাওয়ার প্ল্যান্টগুলোয় সাধারণত ৬ দিন কর্মদিবস থাকে। দিনে অফিস করতাম, রাতে পড়তাম। সন্ধ্যায় হাঁটার অভ্যাস ছিল। অবসরের মুভি বা বই পড়তাম। রোজ পত্রিকা পড়েছি। মাঝেমধ্যে উইকেন্ডে ঘুরেছি কলিগদের সাথে। সবই করেছি। পুরো বিসিএস জার্নিতে তাই খুব একটা হতাশ হয়ে পড়িনি।

হতাশা না থাকলেও এ যাত্রা মোটেও সহজ না ইমনের। তিনি বলেন, একটার পর একটা রিটেন দেওয়া, একই সিলেবাস বারবার পড়া খুব পীড়াদায়ক ছিল। কর্মস্থল শহর থেকে বেশ দূরে হওয়ায় কোচিং করার সুযোগ ছিল না। কোথাও মডেল টেস্ট বা ফর্মাল মক ভাইভাও দিতে পারিনি। হয়ত আরো ভালো করতে পারতাম। এজন্য কিছুটা আক্ষেপ রয়েছে।

তিনি বলেন, বিসিএসের আবেদন থেকে ফাইনাল রেজাল্ট পর্যন্ত সুদীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়। প্রিপারেশন যথেষ্ট হয়েছে কিনা কিংবা ভালো প্রিপারেশন থাকলেও ফাইনালি সিলেকশন হবে কিনা— তা খুবই অনিশ্চিত। এটা সব প্রার্থীদেরই মানসিক চাপের মধ্যে রাখে। তাই ভেঙে না পড়ে আত্মবিশ্বাস বজায় রেখে চেষ্টা করে যেতে হবে।

নিজের এমন সাফল্যের কৃতিত্ব দিয়েছেন মাকে। মায়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, মা আস্থা রেখেছিলেন আমার উপর। সাহস দিয়েছেন। কখনও অবাধ্য হইনি এবং তিনিও সর্বদা সাপোর্টিভ ছিলেন। বর্তমান কর্মস্থলের সহকর্মীরাও সাপোর্টিভ ছিলেন। রিটেন পরীক্ষার প্রিপারেশনের দিনগুলোতে কাজের বাইরে ফ্রি সময়ে অফিসে ঘণ্টাব্যাপীও পত্রিকা পড়েছি। এসব নিয়ে তারা কেউ কখনো কমপ্লেইন করেনি বা কথা শোনায়নি।

বিসিএস সফলতায় তার অনুভূতি জানতে চাইলে বলেন, আমার আবেদন করা সবগুলো বিসিএসই প্রথম পছন্দ পররাষ্ট্র ছিল। ৪৩তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশ পেয়েছি— এটি দ্বিতীয় পছন্দ। এতেও আমি খুশি। শুকরিয়া জানাচ্ছি মহান সৃষ্টিকর্তার প্রতি। লাখ লাখ প্রার্থীর মধ্য থেকে সিলেকশন হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে আমার।

বিসিএসের রেজাল্ট পেয়েই প্রথম মাকে ফোন করে তিনি বলেন, ‘আপনি কি রোকসানা রহমান বলছেন? আমি সহকারী কমিশনার ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট মো. ইমন হোসেন বলছি।’ সেদিন রেজাল্ট দিতে পারে মা জানতেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন এবং শুনে আলহামদুলিল্লাহ্ বললেন। বাবা বেঁচে থাকলে বেশ খুশি হতেন, বলেন ইমন।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে তিনি বলেন, পাস করার পর থেকেই দোটানায় ভুগছিলাম। বাইরে চলে যাব নাকি দেশেই থাকব। যখন আরএনপিএলে জয়েন করি, তখনই জানতাম কিছুদিন পর হয়ত নতুন জায়গায় যেতে হবে। বিসিএস সেই কনফিউশন দূর করে দিয়েছে। জীবনের লক্ষ্য অনেকটাই স্থির হয়ে গেছে। আশা করি পূর্ণ মনোনিবেশ ও উদ্যম নিয়ে কাজ করতে পারবো।

তিনি বলেন, প্রায় ১৭ কোটির মানুষের দেশে প্রশাসনিক সুবিধা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাতে আমাদের এখনো অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে। তাই এই যাত্রায় কিছুটা অবদান রাখতে পারলে নিজেকে সৌভাগ্যবান ও সার্থক মনে করবো। এজন্য নিজের জায়গা থেকে দেশের জন্য ও দেশের মানুষের জন্য সর্বোচ্চটা দিয়ে কাজ করতে চাই।


সর্বশেষ সংবাদ