কথায় কথায় সংঘর্ষে চবি ছাত্রলীগ, টার্গেট প্রধান ফটক
- সুমন বাইজিদ, চবি
- প্রকাশ: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১১:১০ AM , আপডেট: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১১:৩৬ AM
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) ৫ বছরে অন্তত ১৫০ বার সংঘর্ষে জড়িয়েছে শাখা ছাত্রলীগের উপগ্রুপগুলো। এসব সংঘর্ষে অসংখ্যবার প্রধান ফটকে তালা দিয়েছে। আহত হয়েছে সহস্রাধিক নেতা-কর্মী। এ সময়ে শিক্ষক, সাংবাদিক, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, চাকরিপ্রার্থীসহ শিবির ট্যাগ দিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সময় হুমকি ধামকি ও হেনস্তা করেছে ছাত্রলীগের উপগ্রুপগুলো। সবচেয়ে বেশি খবরের শিরোনাম হয়েছে উপগ্রুপ কোন্দল।
৯ মাসে ৩০ বারের বেশি সংঘর্ষ
চলতি বছরে এ পর্যন্ত অন্তত ৩০ বার সংঘর্ষ হয় উপগ্রুপগুলোর মধ্যে। আহত হয় অন্তত ১৫০ জন কর্মী। এর মধ্যে ৬ জানুয়ারি শাটল ট্রেনে বসাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ হয় উপগ্রুপ সিএফসি ও ভার্সিটি এক্সপ্রেসের মধ্যে। আহত হন ১৭ জন। একই ঘটনার জেরে পরদিন আবারো সংঘর্ষে জড়ায় গ্রুপ দুটি। এতে আহত হয় সাতজন কর্মী। মাস না পেরোতেই সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়া নিয়ে ত্রিমুখী সংঘর্ষ বাধে বিজয়, সিএফসি এবং সিক্সটি নাইনের মধ্যে। এতে আহত হয় সাতজন কর্মী।
বাদ যায়নি সাংবাদিক, শিক্ষকপ্রার্থী ও উপাচার্যের কার্যালয়
চবি ছাত্রলীগের বেপরোয়া কার্যক্রমের মধ্যে সাংবাদিক ও শিক্ষকপ্রার্থীকে মারধর, উপাচার্যের কার্যালয় ও বাসভবন হামলা ও ভাঙচুরসহ কোনো কিছুই বাদ পড়েনি। এ বছরে পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে সমকাল পত্রিকার ক্যাম্পাস প্রতিনিধি মারজান আক্তার ও আরটিভির ভিডিও জার্নালিস্ট এমরাউল কায়েস মিঠু ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের হাতে হেনস্তার শিকার হন।
এরপর ১৯ জুন চায়ের দোকানে বসা নিয়ে ঢাকা স্টেট পত্রিকার ক্যাম্পাস প্রতিনিধি দোস্ত মোহাম্মদকে মারধর করে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। সর্বশেষ সংবাদ প্রকাশের জেরে ছাত্রলীগের মারধরের শিকার হন চট্টগ্রাম দৈনিক প্রথম আলোর ক্যাম্পাস প্রতিনিধি মোশাররফ শাহ।
প্রধান প্রকৌশলীকে মারধর এবং ভারপ্রাপ্ত নিরাপত্তা কর্মকর্তাকে হেনস্তা
গত ২৮ আগস্ট চবির ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলীকে মারধর এবং ভারপ্রাপ্ত নিরাপত্তা কর্মকর্তার কাছে চাঁদা দাবিসহ তাকে লাঞ্ছিতের অভিযোগ উঠে শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম-সম্পাদক রাজু মুন্সির বিরুদ্ধে।
২০২২ সালে প্রায় ৩০ বার সংঘর্ষ
২০২২ সালে প্রায় ৩০ বারের সংঘর্ষে আহত হয়েছে অন্তত ১৫০ জন কর্মী। গত বছরের ২ ডিসেম্বর চিকা মারাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ হয় বিজয় ও ভার্সিটি এক্সপ্রেসের মধ্যে। এ ঘটনায় আহত হন ৩৫ জন কর্মী। সেইসাথে ৫০টি কক্ষ ভাঙচুর করা হয়।
চবির প্রধান ফটকে ছাত্রলীগের তালা লাগানো যেন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। বনিবনা না হলেই তালা লাগিয়ে দেওয়া হয়, অচল করে দেওয়া হয় পুরো ক্যাম্পাস। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নামে প্রধান ফটকে তালা লাগানোর পেছনে দলীয় ও রাজনৈতিক স্বার্থই যেন মুখ্য উদ্দেশ্য। ছাত্রলীগের সভাপতি রুবেল কে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে তালা দেওয়া, ছাত্রলীগের এক কর্মীকে পরীক্ষার অনুমতি না দেওয়ায় বন্ধ করা হয় প্রধান ফটক।
পান থেকে চুন খসলেই তালা প্রধান ফটকে
চবির প্রধান ফটকে ছাত্রলীগের তালা লাগানো যেন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। বনিবনা না হলেই তালা লাগিয়ে দেওয়া হয়, অচল করে দেওয়া হয় পুরো ক্যাম্পাস। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নামে প্রধান ফটকে তালা লাগানোর পেছনে দলীয় ও রাজনৈতিক স্বার্থই যেন মুখ্য উদ্দেশ্য। ছাত্রলীগের সভাপতি রুবেল কে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে তালা দেওয়া, ছাত্রলীগের এক কর্মীকে পরীক্ষার অনুমতি না দেওয়ায় বন্ধ করা হয় প্রধান ফটক।
ছাত্রলীগের দুই নেতার ওপর শাটলে হামলার অভিযোগে ফটকে তালা দেয় ছাত্রলীগের একাংশ। পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণার পরই প্রধান ফটক অবরোধ করে নেতাকর্মীরা। তিন শিক্ষার্থীকে সিএনজি চালক মারধরের প্রতিবাদে প্রধান ফটক তালা দেয়া হয়। পাঁচ জোড়া শাটল ট্রেন পুনরায় চালু করার দাবিতে মূল ফটকে তালা দেওয়াসহ পাঁচ বছরে অসংখ্যবার প্রধান ফটকে তালা দেয়ার ঘটনা ঘটেছে।
উপাচার্যের বাসভবন, শিক্ষক ক্লাব ও পরিবহনের বাস ভাঙচুর
গত ৭ সেপ্টেম্বর রাতে শাটল ট্রেন দুর্ঘটনার পর শিক্ষার্থীরা প্রথমে জিরো পয়েন্টে জড়ো হয়ে আন্দোলন শুরু করে। এর মধ্যে আহত একজন শিক্ষার্থীর মৃত্যুর গুজব ছড়িয়ে পড়লে শিক্ষার্থীরা ক্ষিপ্ত হয়ে পুলিশ বক্স, উপাচার্যের বাসভবন, পরিবহন দপ্তর ও শিক্ষক ক্লাবে ব্যাপক ভাঙচুর চালায়। এদিন ৬০টির অধিক বাস ভাঙচুর করা হয়। এ ঘটনায় জড়িত ১৪ জনের নাম উল্লেখ করে প্রশাসন, যার ১২ জনই ছাত্রলীগ কর্মী।
আরো পড়ুন: তিন বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিরতা, নেপথ্যে ছাত্রলীগ
ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি একটিরও
ছাত্রলীগের এমন কর্মকান্ডে ক্যাম্পাসে শিক্ষার পরিবেশ ব্যাহত হচ্ছে। কিন্তু প্রশাসন ছাত্রলীগের হাতে জিম্মি বলছেন সংশ্লিষ্টরা। শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আবদুল হক বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭৩ এর অধ্যাদেশকে সমুন্নত রেখে আইনের শাসন এবং নীতি নৈতিকতা মেনে প্রশাসন পরিচালনা করতে হয়। কিন্তু এ প্রশাসনের আগ্রহের জায়গা হচ্ছে নিয়োগ বাণিজ্য এবং ব্যক্তিগত সুবিধা আদায় করা। নিয়োগ কেলেঙ্কারিসহ বিভিন্ন সুবিধাভোগ করতে করতে প্রশাসনের ইমেজ তলানিতে পৌঁছে দিয়েছে।
তিনি বলেন, এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের যে একটা প্রশাসন আছে তা কেউ অনুভব করে না। এভাবে একটা বিশ্ববিদ্যালয় চলে না। বিচারহীনতার সংস্কৃতির দরুন এখানে এতো এতো অব্যবস্থাপনা রয়েছে, প্রশাসনের কোনো ভাবমূর্তি নেই। ডিসিপ্লিনারি কমিটি ঘটনাগুলোর বিচার করে শাস্তি দেয়অ আবার ছাত্রলীগ ক্ষমা চাইলে ক্ষমা করে দেয়। নতজানু নীতি ফলো করে শাস্তি কার্যকর অর্থাৎ যে লাউ সে কদু। এসব বিচার করার জন্য করা, কার্যত কিছুই না।
ছাত্রলীগের এমন ঔদ্ধত্য আচরণের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতার বলেন, শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে বহিষ্কৃত শিক্ষার্থীদেরও হল ছাড়তে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সাংবাদিক মারধরের ঘটনায় আমরা দ্রুত ব্যবস্থা নিচ্ছি। প্রভোস্ট কমিটির মিটিং হয়েছে। এটার তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ ঘটনায় মামলাও হবে। জড়িতদের বিশ্ববিদ্যালয় আইনে স্থায়ী বহিষ্কার করা হবে।