ঈদ আনন্দ নেই সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বেসরকারি কর্মচারীদের

সরকারি কলেজের বেসরকারি কর্মচারী ইউনিয়নের আন্দোলন কর্মসূচী
সরকারি কলেজের বেসরকারি কর্মচারী ইউনিয়নের আন্দোলন কর্মসূচী  © ফাইল ছবি

‘ঈদের কোনও খুশি আমাদের নেই। বেতন বোনাস মিলিয়ে ১০-১১ হাজার টাকা পেয়েছি। পরিবার-পরিজন নিয়ে এ টাকায় ঈদ উদযাপন দূরে থাক, ভাত-ডাল খেয়ে কোনরকমে বেঁচে থাকাও কষ্টকর। জীবন পরিচালনার উচ্চ ব্যয়ে আমাদের তাল মেলানো কষ্টকর হয়ে গেছে।’ এভাবেই দীর্ঘশ্বাস আর আক্ষেপ নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন রাজধানীর ঢাকা কলেজে দীর্ঘদিন ধরে চাকরি করা বেসরকারি কর্মচারী মমতাজ উদ্দিন।

তিনি বলেন, আমাদের অবস্থা ‘নূন আনতে পান্তা ফুরায়’ এর মত হয়েছে। না পারি মুখ ফুটে কাউকে বলতে, না পারি সহ্য করতে। ছেলেমেয়েরা নতুন জামা কাপড়ের জন্য পথ চেয়ে আছে। এখন এ টাকা দিয়ে জামাকাপড় কিনে দেব নাকি ঈদের জন্য চাল-ডাল সেমাই কিনবো সেটির হিসাবই মেলাতে পারছি না।

শুধু মমতাজ উদ্দিনই নয় বরং এ প্রতিষ্ঠানের আরো ১৭০ জনেরও অধিক কর্মচারীর এমন দীর্ঘশ্বাস ও আক্ষেপ রয়েছে। বর্তমান দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির বাজারে অধিক পরিশ্রম করে এত অল্প টাকায় সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের। খরচ বাঁচাতে কেউ ভালো খাবার খাওয়া কমিয়েছেন কেউবা আবার বাদ দিয়েছেন পরিবারের সান্নিধ্য। বিভিন্ন ছুটিতেও বাড়তি খরচের ভয়ে বাসায় যাওয়া থেকে বিরত থেকে কোনরকমে ক্যাম্পাসেই কাটিয়ে দিচ্ছেন সময়। 

সংশ্লিষ্টরা জানান, ঢাকা কলেজের ২০টি বিভাগ, অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষের কার্যালয়, শিক্ষক পরিষদ, আইসিটি বিভাগসহ অন্যান্য কার্যক্রম পরিচালনায় সরকারি কর্মচারী রয়েছেন মাত্র ৩০-৩৫ জন। আর বাকি সকল কর্মচারী বেসরকারি। সংখ্যাটা নেহায়েত কমও নয়। এরমধ্যে অধিকাংশেরই চাকুরির বয়স  ৫-১০ বছরের ওপরে। 

অবশ্য এই চিত্র শুধুমাত্র ঢাকা কলেজেরই নয়। সারাদেশের অবস্থা আরও নাজুক। ঢাকার বাইরের সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত বেসরকারি কর্মচারীদের বেতনের পরিমাণ আরো কম। যে পরিমাণ বেতন তারা প্রতিষ্ঠান থেকে পান এতে করে এক প্রকার মানবেতর জীবনযাপন করতে হয় তাদের।  

সরকারি কলেজের বেসরকারি কর্মচারী ইউনিয়ন বলছে, বাংলাদেশের প্রায় ৩৩২টি সরকারী কলেজ ও তিনটি সরকারি মাদ্রাসায় বেসরকারি কর্মচারীরা বিগত ১০ থেকে ২৫ বছর বা তারও বেশি সময় ধরে ৩য় ও ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে কর্মরত আছেন। এসব কর্মচারীদের অধিকাংশেরই মাসিক বেতন ৫-১০ হাজার টাকা। 

সরকারি কলেজের বেসরকারি কর্মচারী ইউনিয়নের ঢাকা বিভাগের সভাপতি মো.  আব্দুর রশিদ বলেন, চাকরি জাতীয়করণ করা হবে এমন আশ্বাস আমরা বারবার পেয়েছি। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর কর্তৃপক্ষ ২০১৩ ও ২০২০ সালে জনবল নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। কিন্তু বোরকারি কর্মচারীদের কোন অগ্রাধিকার দেয়নি। সেই বিজ্ঞপ্তিতে মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের একটি রিট মামলার নির্দেশনা মোতাবেক বেসরকারি কর্মচারীদের অগ্রাধিকার থাকলেও মাউশি কর্তৃপক্ষ সে নির্দেশ মানেনি।

সংগঠনটির সভাপতি মো. দুলাল সরদার বলেন, বর্তমান সময়ে আমরা কি পরিমাণ কষ্টের মধ্যদিয়ে জীবন যাপন করছি সেটি কাউকে বোঝাতে পারবো না। যেখানে ৩০-৪০ হাজার টাকায় সংসার চালানো যাচ্ছে না এমন পরিস্থিতিতে মাত্র ১০-১৫ হাজার টাকায় পুরো পরিবার চালাচ্ছি আমরা। খেয়ে না খেয়ে দিন পার করছি। এ অল্প বেতনে আমরা পরিবার পরিজন নিয়ে দ্রব্যমূল্যের অতি উর্ধগতির বাজারে খুবই কষ্টে জীবন যাপন করছি। ইতোমধ্যেই সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত বেসরকারি কর্মচারীদের নিয়োগের তারিখ হতে চাকরি সরকারিকরণের দাবি জানিয়ে আমরা কর্মচারী সমাবেশ করেছি।

তিনি বলেন, আমরা চাকুরী স্থায়ী করার দাবিতে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে ২০২০ সালের ৮ নভেম্বর থেকে ২৬ নভেম্বর পর্যন্ত টানা ১৮ দিন পর্যন্ত অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী, শিক্ষা উপ-মন্ত্রী, শিক্ষা সচিব ও মহাপরিচালককে আমরা একধিকবার স্মারকলিপি দিয়েছি। কিন্তু তাতেও কোন লাভ হয়নি। আমারা ১০ থেকে ২৫ বছরের উর্দ্ধে নিজের সন্তানের মত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে ভালোবেসে নিজের বুকে ধারণ করেছি।  

এ অবস্থায় অগ্রাধিকারের মাধ্যমে নিয়োগ দিয়ে সাধারন কর্মচারীদের বেচে থাকার পথকে সুগম করার জন্য অনুরোধ জানান তিনি। তাদের দাবির মধ্যে রয়েছে-

১। সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত বেসরকারি কর্মচারীদেরকে নিয়োগের তারিখ হতে চাকরি সরকারিকরণ করতে হবে। 

২। চাকুরী সরকারিকরণের পূর্ব পর্যন্ত সরকারি স্কেল অনুযায়ী বেতনভাতাদি প্রদান করতে হবে।

সারাদেশের বিপুল সংখ্যক বেসরকারি কর্মচারীর সরকারিকরণের সম্ভাবনা রয়েছে কিনা জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চিশক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ বলেন, সরকারি কলেজে কর্মরত বেসরকারি কর্মচারীদের স্বল্প বেতনের বিষয়টি অত্যন্ত বাস্তব। বেসরকারি কর্মচারী যারা রয়েছেন তাদের বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য সুবিধা একেবারেই কম। বাস্তবতা হলো দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সহ আনুষাঙ্গিক বিষয়াদি বিবেচনায় বর্তমান সময়ে পাঁচ-ছয় হাজার টাকা বেতনে পরিবার পরিজন নিয়ে জীবনধারণ করা খুবই কঠিন।

তিনি বলেন, বাস্তবতা হলো সরকারি কলেজগুলোতে এসব কর্মচারী ছাড়াও সব কার্যক্রম চালানো সম্ভব হচ্ছে না। আবার ৩য়-৪র্থ শ্রেণীতে যে পদপদবী ও তার বিপরীতে যে পরিমাণ সরকারি কর্মচারী রয়েছেন সেগুলো যথেষ্ট নয়। এখন সরকারি কর্মচারীদের পদ-পদবী তৈরি করার চেষ্টা করা হচ্ছে। সেগুলো তৈরি করা সম্ভব হলে হয়তো এমন অবস্থার কিছুটা  সমাধান হবে। তবে আপাতত বেসরকারি কর্মচারীদের ব্যাপারে আমরা মন্ত্রণালয় কথা বলেছি। নিশ্চয়ই সেখানে তাদের জন্য চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে সবাই আন্তরিক। 

সরকারি নিয়োগের ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরে কর্মরত বেসরকারি কর্মচারীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে না কর্মচারীদের এমন অভিযোগের ব্যাপারে মাউশি মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল বলেন, সরকারি বিধান অনুযায়ী অগ্রাধিকার দেওয়ার সুযোগ নেই। কারণ বর্তমানে কর্মরত সকল বেসরকারি কর্মচারীই মাস্টার রোলে নিয়োগ পেয়েছেন। আর মাস্টার রোলের কর্মচারীরা সরকারি নিয়োগের প্রক্রিয়ার মধ্যে পড়েন না। ফলে সরকারি বিধি-বিধানের আলোকেই তাদের অগ্রাধিকার দেওয়ার সুযোগ নেই।

তিনি বলেন, আগে হয়তো একটা সময় এরকম সুযোগ ছিল। কিন্তু এখনকার সরকারি পদের বিপরীতে যেসব নিয়োগ হয় সবগুলোই সরকারি বিধিবিধান অনুযায়ী সম্পন্ন করা হয়। কাজেই তাদের এই প্রক্রিয়ায় রাজস্বখাতভুক্ত করার একটি সমস্যা আছে। তবে বেসরকারি কর্মচারীদের ব্যাপারে কি করা যায় সে ব্যাপারে শিক্ষামন্ত্রী ও মন্ত্রণালয় চিন্তা-ভাবনা করছে। বিষয়টি নিয়ে পর্যালোচনার ব্যাপার রয়েছে। যথেষ্ট চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে। হুট করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ নেই।

এ মুহূর্তে এসব কর্মচারীদের বেতন আসছে কলেজের অত্যাবশ্যকীয় ফান্ড থেকে। তবে সেটির পরিমাণও খুবই কম, অস্বীকার করার অবকাশ নেই। তবে এখনকার সরকারি বিধি-বিধানের বিষয়টিও খেয়াল রাখতে হবে। অন্য কোনভাবে বেতন ভাতা বাড়ানো যায় কিনা সেটিও চিন্তাভাবনা করতে হবে। অবশ্য এভাবে বেতন বাড়াতে গেলে আবার শিক্ষার্থীদের ওপর চাপ পড়বে।  সবদিকেই সংকট রয়েছে। কাজেই এটা নিয়ে যথেষ্ট পর্যালোচনার দরকার আছে।


সর্বশেষ সংবাদ