যাকাত: আত্মশুদ্ধি ও অর্থনৈতিক ভারসাম্যের বিধান
- মির্জা নাদিম
- প্রকাশ: ২৭ মার্চ ২০২৫, ০৫:৫৮ PM , আপডেট: ২৭ মার্চ ২০২৫, ০৫:৫৮ PM

যাকাত ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ, যা মুসলমানদের জন্য ফরজ বা অবশ্য পালনীয় ইবাদত। এটি আত্মশুদ্ধির অন্যতম মাধ্যম এবং সমাজে অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ। কুরআন ও হাদীসে যাকাতের গুরুত্ব, শর্তাবলী, হিসাব, এবং যাকাত না দেয়ার শাস্তি সম্পর্কে স্পষ্টভাবে আলোচনা করা হয়েছে।
যাকাতের সংজ্ঞা ও গুরুত্ব
যাকাতের ভাষাগত ও শরিয়াতসম্মত অর্থ: ‘যাকাত’ শব্দটি আরবি زَكَاةٌ (যাকাত) থেকে উদ্ভূত, যার আভিধানিক অর্থ পরিষ্কার, পবিত্রতা, বৃদ্ধি ও বরকত। ইসলামী শরিয়তে, নির্দিষ্ট সম্পদের একটি নির্দিষ্ট অংশ নির্ধারিত সময়ে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নির্ধারিত ব্যক্তিদের প্রদান করাকে যাকাত বলে।
যাকাতের ফরজ হওয়ার বিধান: হিজরি ২য় বর্ষ (৬২৪ খ্রিস্টাব্দ) থেকে যাকাত মুসলমানদের ওপর ফরজ করা হয়। এটি নামাজের পর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাওয়া ইবাদত। কুরআনে ৩২ বার যাকাতের উল্লেখ এসেছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে নামাজের সঙ্গে সংযুক্ত করে বলা হয়েছে:
وَاَقِيْمُوا الصَّلٰوةَ وَاٰتُوا الزَّكٰوةَ وَارْكَعُوْا مَعَ الرّٰكِعِيْنَ
"নামাজ কায়েম করো, যাকাত আদায় করো এবং الركاعীন (নামাজে নত হওয়া)দের সাথে নত হও।"— (সূরা আল-বাকারা: ৪৩)
যাকাত ফরজ হওয়ার শর্তাবলী: যাকাত ফরজ হওয়ার জন্য নিম্নলিখিত শর্তগুলো পূরণ হতে হবে: ১. ইসলাম গ্রহণ করা – যাকাত শুধুমাত্র মুসলমানদের জন্য বাধ্যতামূলক। ২. বালেগ বা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া – নাবালকের যাকাত তার অভিভাবক আদায় করবে। ৩. আক্বল (বুদ্ধিমান) থাকা – মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তির যাকাত তার অভিভাবক আদায় করবে। ৪. নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকা – শরীয়তের নির্ধারিত সীমার বেশি সম্পদ থাকতে হবে। ৫. ঋণমুক্ত হওয়া– যদি কারো ঋণ পরিশোধের পর নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকে, তবে তার ওপর যাকাত ফরজ হবে। ৬. এক চন্দ্রমাস (এক বছর) অতিক্রম হওয়া – সম্পদের উপর এক বছর অতিবাহিত হতে হবে।
যাকাতের নিসাব ও হার: কোনো মুসলিম ব্যক্তির সম্পদ যদি ৫২.৫০ তোলা রূপা বা ৭.৫০ তোলা স্বর্ণ বা সমপরিমাণ মূল্যের সম্পদ হয় এবং তার উপর এক বছর অতিবাহিত হয়, তাহলে তার ওপর যাকাত ফরজ হবে।
যাকাতের হার: সাধারণ সম্পদের উপর ২.৫% হারে যাকাত ফরজ। কৃষিজাত পণ্যের উপর ১০% (সেচ ছাড়া জমি), ৫% (সেচকৃত জমি) হারে যাকাত দিতে হয়।
বাংলাদেশে যাকাতের নিসাব নির্ধারণ (২০২৫): বর্তমানে রূপার বাজারমূল্য প্রতি গ্রাম প্রায় ১২০ টাকা হলে, ৬৭০.২৪ গ্রাম রূপার মূল্য হবে: ৬৭০.২৪ গ্রাম × ১২০ টাকা/গ্রাম = ৮০,৪২৮.৮০ টাকা
অতএব, যদি কারও মোট সঞ্চিত সম্পদ (নগদ অর্থ, স্বর্ণ, রূপা, বাণিজ্যিক পণ্য ইত্যাদি) ৮০,৪২৮.৮০ টাকা বা তার বেশি হয় এবং তার উপর এক ইসলামি বছর অতিক্রান্ত হয়, তবে তার উপর যাকাত ফরজ হবে।
যাকাতের হার: যাকাতের হার মোট সম্পদের ২.৫%। উদাহরণ: যদি কারও মোট সম্পদ ১,০০,০০০ টাকা হয়, তবে যাকাত দিতে হবে— ১,০০,০০০ × ২.৫% = ২,৫০০ টাকা। রূপার বাজারমূল্য পরিবর্তনশীল, তাই যাকাত প্রদানের সময় সর্বশেষ বাজারমূল্য অনুসারে নিসাব নির্ধারণ করা উচিত।
যাকাত গ্রহণের উপযুক্ত ব্যক্তি: কুরআনে যাকাত গ্রহণের ৮ শ্রেণি নির্ধারণ করা হয়েছে: إِنَّمَا الصَّدَقٰتُ لِلْفُقَرَاءِ وَالْمَسٰكِينِ وَالْعَامِلِينَ عَلَيْهَا وَالْمُؤَلَّفَةِ قُلُوبُهُمْ وَفِي الرِّقَابِ وَالْغَارِمِينَ وَفِي سَبِيلِ اللَّهِ وَابْنِ السَّبِيلِۗ فَرِيضَةً مِّنَ اللَّهِ
"নিশ্চয়ই যাকাত فقیر (অতিদরিদ্র), مساكين (অসহায়), যাকাত আদায়ে নিযুক্ত কর্মচারী, যাদের অন্তর ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করা প্রয়োজন, মুক্তিপ্রাপ্ত দাস, ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি, আল্লাহর রাস্তায় ব্যয়কারী এবং মুসাফিরদের জন্য নির্ধারিত।" — (সূরা আত-তাওবা: ৬০)
যাকাত না দেয়ার শাস্তি: যারা যাকাত দিতে সক্ষম কিন্তু ইচ্ছাকৃতভাবে আদায় করে না, তাদের জন্য কঠোর শাস্তির ঘোষণা করা হয়েছে।
কুরআনের শাস্তির কথা: وَالَّذِينَ يَكْنِزُوْنَ الذَّهَبَ وَالْفِضَّةَ وَلَا يُنْفِقُوْنَهَا فِيْ سَبِيْلِ اللّٰهِ فَبَشِّرْهُمْ بِعَذَابٍ اَلِيْمٍ
"যারা সোনা ও রুপা জমা করে এবং তা আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করে না, তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ।"— (সূরা আত-তাওবা: ৩৪-৩৫)
হাদিসে সতর্কবাণী: রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: "যে ব্যক্তি আল্লাহ তাকে সম্পদ দান করেছেন কিন্তু সে তার যাকাত আদায় করেনি, কেয়ামতের দিন সেই সম্পদ বিষাক্ত সাপের রূপ ধারণ করবে, যেটি তার গলায় পেঁচিয়ে দেয়া হবে এবং সে সাপ তাকে কষ্ট দিবে।"— (বুখারি: ১৪০৩)
যাকাত আদায়ে বিশেষ কিছু বিধান: ১. ঋণগ্রস্তদের যাকাত-যদি কারো ঋণ নিসাব পরিমাণ সম্পদের চেয়ে বেশি হয়, তবে সে যাকাত দিতে বাধ্য নয়। তবে কিস্তিতে ঋণ পরিশোধ করলে, শুধুমাত্র চলতি বছরের কিস্তির পরিমাণ বাদ দিয়ে যাকাত হিসাব করতে হবে। ২. যৌথ সম্পদের যাকাত- যদি কারো সম্পদে একাধিক ব্যক্তি মালিকানা রাখে, তবে প্রত্যেক অংশীদার তার নিসাব পরিমাণ সম্পদের উপর যাকাত আদায় করবে। ৩. অপ্রাপ্তবয়স্ক ও মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তির যাকাত-অপ্রাপ্তবয়স্ক বা মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তির সম্পদ থাকলে তার অভিভাবককে যাকাত আদায় করতে হবে।
যাকাত শুধু দান নয়, এটি মুসলিম উম্মাহর জন্য একটি ফরজ ইবাদত। এটি সমাজের অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করে এবং আত্মশুদ্ধি নিশ্চিত করে। যারা যাকাত আদায় করবে না, তাদের জন্য কঠোর শাস্তির হুঁশিয়ারি দেয়া হয়েছে। তাই আমাদের উচিত যথাযথভাবে আমাদের সম্পদের হিসাব রেখে সময়মতো যাকাত আদায় করা এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা।
লেখক: শিক্ষার্থী , তা'মীরুল মিল্লাত কামিল মাদ্রাসা