ডেঙ্গু আতঙ্ক: ঈদ ছুটির আগেই ফাঁকা রাজধানীর ক্যাম্পাসগুলো

  © প্রতীকী ছবি

রাজধানী ঢাকায় ডেঙ্গুর‌ প্রকোপ ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। এবারের ডেঙ্গু ভয়াবহতা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে। ডেঙ্গুর প্রকোপ থেকে বাদ যায়নি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। এমনকি ঢাকা কলেজ, তিতুমীর কলেজ, ইডেন কলেজসহ ঢাবির অধিভুক্ত সাত উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। প্রতিদিন ডেঙ্গুর ছোবলে প্রাণ যাচ্ছে শিক্ষার্থীসহ অনেকের। লাশের সারিতে শামিল হচ্ছে শিশু থেকে বৃদ্ধরাও। এসব কারণে রাজধানী ঢাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মাঝে বিরাজ করছে বেশ আতঙ্ক। চলমান পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্দিষ্ট ঈদের ছুটির আগেই ক্যাম্পাস ছেডে যাচ্ছেন আতঙ্কিত শিক্ষার্থীরা। ঢাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সার্বিক চিত্র উঠে এসেছে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পসের বিশেষ প্রতিবেদনে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়:
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঈদের ছুটি শেষ হচ্ছে আজ বুধবার থেকে। কিন্ত তার আগেই ক্যাম্পাস খালি করেছে শিক্ষার্থীরা। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন কর্মসূচি নেয়ার কথা জানানো হলেও শিক্ষার্থীদের আতঙ্ক কাটেনি। তাই ছুটির আগেই সরে পড়লেন।

শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, হল প্রশাসন শুধুমাত্র কয়েকটি হল পরিচ্ছন্নতা অভিযান ও  মশা নিধন কীটনাশক ছিটিয়ে শেষ করেছেন, বাকি অধিকাংশ হলের কোন খোঁজখবর নেই। শিক্ষার্থীরা অসুস্থ হলেও তেমন সাড়া পাওয়া যায়নি হল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে। যে কারণে সাধারণ ছাত্রদের মধ্যে এক ধরনের ক্ষোভ বিরাজ করছিল বিষয়টি নিয়ে।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, হল প্রশাসন ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আন্তরিকভাবে বিষয়টির সমস্যা সমাধানে কাজ করছে। ডেঙ্গু নিরসন করার জন্য নতুন নতুন ডিভাইস সংযোজন করেছি আমাদের মেডিকেল সেন্টারে। অনেক শিক্ষার্থী এতে সন্তুষ্ট রয়েছে। আমরা আমাদের ছেলে মেয়েদের ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিতে পারে না।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়:
ঢাকা শহরের অদূরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। সেখানেও লেগেছে ডেঙ্গুর আতঙ্ক। এক ছাত্রীর মৃত্যুতে বেড়েছে আতঙ্কের মাত্রা। গত ৪ আগস্ট শুরু হয়েছে ঈদের ছুটি। কিন্তু তারও আগে ক্যাম্পাস ত্যাগ করতে দেখা গেছে বেশ কিছু শিক্ষার্থীদের।

সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ৩য় বর্ষের শিক্ষার্থী ইমাদ উদ্দিন বলেন,‘বিশ্ববিদ্যালয়ে ডেঙ্গুর প্রভাব লক্ষণীয়। ইতোমধ্যে এক ছাত্রীর ক্যাম্পাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে বাড়িতে মৃত্যুর খবর আমি সহ আমার সহপাঠীদের আতঙ্কিত করেছে। যার কারণে এবার ছুটির আগেই ডেঙ্গু মুক্ত শরীর নিয়ে বাসায় ফিরতে চাই।’

প্রীতিলতা হলের আবাসিক শিক্ষার্থী শারমীন আক্তার বলেন, ‘উখিংনু রাখাইন আমার হলেরই জুনিয়র ছিলো। আমাদের হলের নিচের তলায় জুনিয়ররা গণরুমে থাকে। যেটা মশাদের আস্তানা। দিনের বেলায়ও থাকা যায় না মশার প্রকোপে। একই হলের তিনতলায় মশারি ছাড়া ঘুমানো যায়। অথচ নিচতলায় থাকা যায় না এক মিনিটও। মেয়েটা মারা যাবার পর আম্মু আমাকে বলল, তোর আর হলে থাকা লাগবে না। যত কষ্ট হোক বাসায় আসবি।’

ছুটির আগেই শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যাওয়ার বিষয়ে হল প্রশাসন ও কেন্দ্রীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার রহিমা কানিজ বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আগে থেকেই সতর্ক অবস্থানে ছিলো এরপরেও একটি দুর্ঘটনা হয়ে যায়। আমরা চিকিৎসা কেন্দ্রে ডেঙ্গুজ্বর শনাক্ত ও চিকিৎসার ব্যবস্থা এবং প্রতিরোধ হিসেবে হলে হলে পরিচ্ছন্ন অভিযান চালানো হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।’

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়:
ছুটি কার্যকর হওয়ার আগেই ফাঁকা হয়ে গেছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি) ক্যাম্পাস। অচল অবস্থায় পরিণত হয়েছে বিভিন্ন সংগঠনের কার্যক্রম। ৬ আগস্ট ক্যাম্পাসে এসে দেখা যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি, শান্ত চত্বর, শহীদ মিনার প্রাঙ্গন, ক্যাফেটেরিয়া, কাঁঠাল চত্বর যেখানে শিক্ষার্থীদের ভিড় থাকতো তা এখন খালি পড়ে আছে। কিছুদিন আগেও ক্যাফেটেরিয়ায় লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে খাবার নিতে হতো সেখানে আজ অধিক টেবিলই ফাঁকা পরে আছে, শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি নাই বললেই চলে।

শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, পুরান ঢাকার ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি, দিনে দিনে এর মাত্রা আরো বৃদ্ধি পাওয়ায় শিক্ষার্থীদের আতঙ্কও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে করে ছুটির আগেই বাড়ি চলে গেছে শিক্ষার্থীরা।

গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী ফারদিন নিরবের সাথে মুঠোফোনে কথা বললে তিনি বলেন, আমার ডেঙ্গু হয়নি তবে আমার বন্ধুদের অনেকের হয়েছে। ডেঙ্গু হলে আমাদের ঢাকায় সেবা করার কেউ নেই, তাই পরিবার থেকেও ঢাকা ত্যাগ করার জন্য বলেছে। এর জন্যই বাড়ি চলে আসছি। ক্যাম্পাসে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা অভিযান কর্মসূচি পালন করলেও কমেনি ডেঙ্গু আতঙ্ক।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছুটি নির্ধারণ করা করা হয়েছে ৭ আগস্ট থেকে ২৫ আগস্ট পর্যন্ত। কিন্তু এরই মধ্যে জবির শতাধিক শিক্ষার্থী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে। শিক্ষার্থীরা ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ায় ও ডেঙ্গু হওয়ার আতঙ্কে বাড়ি চলে গিয়েছে।

রাজধানীর অন্যান্য ক্যাম্সাস:
একই চিত্র দেখা গেছে রাজধানীর সাত কলেজগুলোতেও। ঈদের ছুটির আগেই প্রাণের ক্যাম্পাস ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন শিক্ষার্থীরা। গত ৪ আগস্ট ইডেন মহিলা কলেজের এক ছাত্রীর মৃত্যুতে ব্যাপক নাড়া দেয় তাদের। এছাড়া আজ তিতুমীর কলেজের মাস্টার্সের এক শিক্ষার্থীও ডেঙ্গুতে মৃত্যু বরণ করেছেন। সহপাঠিদের এমন অনাকাঙ্খিত মৃত্যুতে একদিকে যেমন শোকাহত শিক্ষার্থীরা তেমনি নিজেদের কী হবে তা নিয়ে ব্যতিগ্রস্ত তারা। তাই ঢাকা শহরকে আর ভরসা পাচ্ছে না শিক্ষার্থীরা। সবাই গ্রামেই আশ্রয় খুঁজছেন। 

তিতুমীর কলেজের সুফিয়া কামাল ছাত্রী নিবাসের ছাত্রী মিফতাহুল জান্নাত বৃষ্টি জানান, আমাদের হলে ডেঙ্গুর তেমন একটা প্রভাব নেই বললেই চলে। রাজধানীসহ সারা দেশে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা শুরু হলে হল কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযানসহ বেশকিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। যার মাধ্যমে ডেঙ্গু প্রতিরোধ করা গেছে বলা চলে।

তিনি জানান, তবে সম্প্রতি ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে শিক্ষার্থীসহ মানুষ মরে যাওয়ার বিষয়ে হলের শিক্ষার্থীদের মাঝে আতঙ্কের জন্ম দিয়েছে। যার কারণে অনেকে ক্যাম্পাস বন্ধের আগেই হল ছেড়ে চলে গেছেন। হল মোটামুটি এখন ফাকাঁ বললেই চলে।

ইডেন কলেজের রাজিয়া হলের শিক্ষার্থী শায়লা আক্তার জানান, ডেঙ্গুর ভয়াবহতার সঙ্গে সঙ্গে সপ্তাহের ভিতরে আমাদের কলেজের একাধিক শিক্ষার্থী আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। হলে ডেঙ্গু প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেওয়া হলেও তেমন কোন কার্যকর ব্যবস্থা হচ্ছে না। আমরা শিক্ষার্থীরা আসলে ভয়ের জায়গা থেকেই ক্যাম্পাস ছুটির আগে বাসায় চলে আসছি।

ঢাকা কলেজের আক্তারুজ্জামান ইলিয়াস হল খাইরুল বাসার জানান, কলেজ মঙ্গলবার থেকে বন্ধ দিয়েছে। কিন্তু হলের বেশির ভাগ শিক্ষার্থী আগেই বাড়ি চলে গেছেন। হল প্রশাসন এবং শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে ডেঙ্গু প্রতিরোধে ব্যাপক কার্যক্রম চালানো হয়েছে। যার কারণে আমাদের এখানেও ডেঙ্গুর তেমন প্রভাব লক্ষ্য করা যায়নি। তবে ভয়-ভীতি থেকেই শিক্ষার্থীরা বন্ধের আগে হল ত্যাগ করেছেন।


সর্বশেষ সংবাদ