পূর্বের রেকর্ড ভেঙে ঢাকা কলেজে উৎসবের আবহে মাসব্যাপী রমজান উদযাপন
- ঢাকা কলেজ প্রতিনিধি
- প্রকাশ: ২৯ মার্চ ২০২৫, ০৪:৪৩ PM , আপডেট: ২৯ মার্চ ২০২৫, ০৪:৪৬ PM

বিগত সময়ের ভয়ের সংস্কৃতির বিপরীতে সব রেকর্ড ভেঙে ঢাকা কলেজে এবারের রমজান উৎসবের আমেজে উদযাপন হয়েছে। পূর্বে ক্যাম্পাসে রমজানকে কেন্দ্র করে ইসলামি সাংস্কৃতিক কর্মসূচি পালনে ছিল অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পরে রমজানে ক্যাম্পাসে অনুষ্ঠিত হয়েছে তিন শতাধিক ইফতার মাহফিল, ইসলামিক সেমিনার, নাশিদ ও ইসলামি সংগীত প্রতিযোগিতা, কুরআন বিতরণের মতো কর্মসূচি। রমজানে ইসলামিক এসব অনুষ্ঠানে সম্মিলিত অংশগ্রহণে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের পারস্পরিক সহযোগিতা ও সহমর্মিতা গড়ে উঠেছে।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পূর্বে ক্যাম্পাসে ইফতার মাহফিল আয়োজনের কলেজ প্রশাসন থেকে ছিল না কোন সহযোগিতা। বরং বিভিন্ন সংগঠনের ইফতার মাহফিলে নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগ কর্তৃক প্রতিবন্ধকতা ছিল। রমজান উপলক্ষ্যে কলেজের অডিটোরিয়াম, গ্যালারি ব্যবহারে ছিল না অনুমতি।
ইফতার মাহফিলে প্রতিবন্ধকতার অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছিলেন ঢাকা কলেজ ডিবেটিং সোসাইটির সভাপতি শাহাদাত হোসাইন। তিনি বলেন, বিগত বছরগুলোতে ইফতার আয়োজন করতে গেলে কলেজ প্রশাসনের পক্ষ থেকে ইফতার আয়োজনকে নিরুৎসাহিত করা হতো। এর ফলে শিক্ষার্থীদের রমজান উদযাপন বাধাগ্রস্ত হতো। অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা এবং বিভিন্ন সংগঠন ক্যাম্পাসের বাইরে ইফতারের আয়োজন করতো বাধ্য হয়ে।
তিনি আরো বলেন, গত বছর আমরা ডিসিডিএস-এর পক্ষ থেকে ইফতার আয়োজনের অনুমতি চাইলে সেই অনুমতি দেওয়া হয়নি। ফলশ্রুতিতে, আমরা আজিমপুরে একটি রেস্টুরেন্টে ইফতারের আয়োজন করার পরিকল্পনা করেছিলাম। যদিও শেষ পর্যায়ে এসে আমরা আমাদের ক্যাম্পাসের ক্যাফেটেরিয়ায় সেই আয়োজনটি করতে সক্ষম হই। কিন্তু একেবারে শেষের দিকে ক্যাফেটেরিয়ায় ভেন্যু স্থানান্তর করায় আমরা সেই আয়োজনটি সুচারুরূপে করতে পারিনি।
জুলাই বিপ্লব পরবর্তী কলেজ ক্যাম্পাসে আনন্দঘন পরিবেশে রমজান পালন হয়েছে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, শিক্ষার্থীবান্ধব প্রশাসনের সহযোগিতায় ক্যাম্পাসে আনন্দঘন পরিবেশে শিক্ষার্থীবৃন্দ এবং বিভিন্ন সংগঠন ইফতার আয়োজন করতে সক্ষম হয়েছে। রমজানের প্রায় প্রতিটি দিনেই ক্যাম্পাসের অডিটোরিয়াম, গ্যালারিসমূহ এবং খেলার মাঠে শিক্ষার্থীদের আয়োজনগুলোতে প্রিন্সিপাল স্যার এবং অন্যান্য শিক্ষকবৃন্দও অংশগ্রহণ করেছেন; শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একত্রে বসে ইফতার করেছেন। যা পড়াশোনার জন্য পরিবার থেকে দূরে অবস্থানকারী শিক্ষার্থীদের রমজান উদযাপনে এক নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। তারা শিক্ষকদেরকে অভিভাবক হিসেবে সবসময় পাশে পেয়েছেন। আর তাই এই রমজানে কলেজ প্রশাসন বিগত বছরগুলোর তুলনায় একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে।
জানা যায়, এ বছরের রমজানে ঢাকা কলেজ ক্যাম্পাসে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনগুলো ব্যতিক্রমধর্মী বেশকিছু আয়োজন সম্পন্ন করেছে। রমজান উপলক্ষ্যে ইসলামি ছাত্রশিবিরের মসজিদে সাজসজ্জা এক ভিন্ন রকম মুসলিম সংস্কৃতির উদাহরণ সৃষ্টি করে। হলভিত্তিক ইফতার বিতরণ করে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। এর সাথে রমজানে খাবারের দাম কমাতে অধ্যক্ষ বরাবর স্মারকলিপি দেন ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা। গণ ইফতার ও সেমিনারের আয়োজন করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঢাকা কলেজ শাখার নেতাকর্মীরা। তাবলীগ জামাত ক্যাম্পাসে মসজিদে বিনামূল্যে শিক্ষার্থীদের জন্য প্রতিদিন ইফতারের ব্যবস্থা করে। এছাড়াও ব্যক্তিগতভাবে ক্যাম্পাসে ইসলামি সংগীত প্রতিযোগিতা ও প্রোডাক্টিভ রমজান সেমিনারের আয়োজন করা হয়। এতে শিক্ষার্থীদের ব্যাপক উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।
ব্যক্তি উদ্যোগে প্রোডাক্টিভ রমাদান সেমিনার আয়োজনে ঢাকা কলেজের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী জিহাদ হোসাইন। সেমিনারে আলোচক বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ইসলামিক স্কলার অধ্যাপক মুখতার আহমেদ। জিহাদ হোসাইন বলেন, বিগত দিনগুলোতে সরকার মানুষকে নৈতিক শিক্ষা থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল। তার ছাত্রসংগঠনগুলো এই অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়ন করতো। কাউকে নিয়মিত জামাতে নামাজ পড়তে দেখলে নজরদারি বাড়াত বিভিন্ন মিথ্যা অপবাদ বা ট্যাগ দিত।
জিহাদ হোসাইন আরো বলেন, সেখান এই অনুষ্ঠানের সাহস কেউ ভুলেও করত না। গতবছর সরকার থেকে বলা হয়েছিল ক্যাম্পাসে ইফতার বন্ধের বিষয়ে তারপরে ব্যাপক সমালোচনার মুখে তার অন্যভাবে ব্যাখ্যা করে জনরোষ কমাতে চেষ্টা করে। দেশের বিভিন্ন স্থানে ওয়াজ-মাহফিল বন্ধ করে দেওয়া হত। এমনকি মসজিদের খতীবদেরকে খুতবা দেওয়ার জন্য আটক হতে হয়েছে। বিভিন্ন ক্যাম্পাসের ধর্মীয় আলোচনা বা সেমিনারে হামলা করে আহত করে হলে বন্ধ করে নানা ট্যাগ জুড়ে দিয়ে রাজনৈতিকভাবে ওপর মহল দিয়ে ট্যাগ দিয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল।
তবে রমজানে কলেজ প্রশাসন থেকে গ্রহণ করা হয়েছিল নানাবিধ শিক্ষার্থীবান্ধব উদ্যোগ। রমজান শুরুর আগেই মসজিদে নামাজের নতুন কার্পেট ক্রয় করে কলেজের মসজিদ কমিটি। অডিটোরিয়াম, গ্যালারিগুলো ইফতার মাহফিল, ইসলামিক অনুষ্ঠান আয়োজনে শিক্ষার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। সেহেরির সময় কলেজের ক্যাফেটেরিয়া খোলা রাখার নির্দেশনা দেন কলেজ প্রশাসন। এর ফলে ঢাকা কলেজ ক্যাম্পাস হয়ে উঠে ইসলামি সংস্কৃতির এক জীবন্ত প্রতীক।
ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থী ও ছাত্রনেতাদের ভাষ্যমতে, জুলাই গণঅভ্যুত্থান রক্তের মাধ্যমে মাসব্যাপী আনন্দঘন পরিবেশ জাঁকজমকভাবে রমজান উদযাপন করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। ফ্যাসিস্ট সরকারের রোষানলে মুসলমানদের ধর্মীয় স্বাধীনতাকে বারবার বাধাগ্রস্ত করেছে। এ বিষয়ে মতামত ব্যক্ত করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঢাকা কলেজ শাখার আহ্বায়ক আফজাল হোসেন রাকিব।
তিনি বলেন, জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে স্বৈরাচারের পতন হয়েছে যার ফলশ্রুতিতে বিগত বছরের তুলনায় এই বছর ঢাকা কলেজে রমজান অধিকতর জাঁকজমকপূর্ণভাবে পালিত হয়েছে। হলের শিক্ষার্থী, হলের বাহিরের শিক্ষার্থী সহ সকল ছাত্র কল্যাণগুলোর স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল এই রমজানে। তাছাড়া, বিগত সময়ে শুধু নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্র সংগঠন ছাড়া অন্য সকল ছাত্র সংগঠনের অনুপস্থিতি লক্ষ্য করা গিয়েছে ক্যাম্পাসে কিন্তু এইবার নিষিদ্ধ সংগঠন ছাড়া সকল ছাত্র সংগঠনের সহাবস্থান ছিল, যা ঢাকা কলেজের রমজানের জাঁকজমকপূর্ণতা বৃদ্ধি করেছে। সকল ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠনের নানাবিধ ধর্মীয় কর্মসূচি ঢাকা কলেজের রমজানে পরিপূর্ণতা এনে দিয়েছে। আশা করি, সকল ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠন, সাধারণ শিক্ষার্থী সকলের সহাবস্থানের মাধ্যমে ঢাকা কলেজে ঐক্যের বন্ধন অটুট থাকবে।
এ বিষয়ে ঢাকা কলেজ অধ্যক্ষ অধ্যাপক এ কে এম ইলিয়াস বলেন, রমজান উপলক্ষ্যে শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত আয়োজনে যেন নির্বিঘ্ন হয় কলেজ থেকে সেই চেষ্টা করা হয়েছে। উৎসবমুখর পরিবেশে রমজানের এই আয়োজনের ক্রেডিট আমি ছাত্রদের দিতে চাই। দেখা গেছে একদিনে ১৬টা ইফতার মাহফিল হয়েছে। আমাকে সবগুলোতে দাওয়াত দেওয়া হয়েছে। আমি সবগুলোতে যেতে পারি নাই। সর্বোচ্চ সাতটি ইফতার মাহফিলে গিয়েছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পরে ভিন্ন এই পরিবেশের জন্য এটা এভাবে রমজান উদযাপন করা সম্ভব হয়েছে।