খুবির শোক দিবস আজ: সেদিন চোখের সামনে ১১ সহপাঠীর মৃত্যু দেখেন শিক্ষার্থীরা

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শোক দিবস
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শোক দিবস  © সংগৃহীত

১৩ মার্চ। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের (খুবি) শোক দিবস। ২০০৪ সালের এ দিনে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য ডিসিপ্লিনের শিক্ষার্থীরা সুন্দরবনে বেড়াতে যান। এদিন কটকা সী-বিচে ঘোরাঘুরির সময় হঠাৎ জোয়ারের টানে সমুদ্রে হারিয়ে যান অনেকে। স্রোতের সাথে যুদ্ধ করে কেউ কেউ তীরে ফিরতে পারলে ও ফিরে আসতে পারেননি ১১ জন। 

তখন থেকে প্রতিবছর আজকের এ দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ে শোক দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। ঘটনাটিকে কটকা ট্র্যাজেডিও বলা হয়।

কী ঘটেছিল সেদিন
২০০৪ সালের ১২ মার্চ রাত সাড়ে ৯টার দিকে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য ডিসিপ্লিনের ৭৮ জন ছাত্র-ছাত্রী এবং তাদের ২০ জন অতিথি নিয়ে খুলনা থেকে রওনা দেন সুন্দরবনের উদ্দেশ্যে। সারারাত লঞ্চযাত্রা শেষে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে তারা কটকার নিকটবর্তী বাদামতলী এলাকায় পৌঁছান। বেলা ১টার দিকে তারা গভীর অরণ্য পেরিয়ে কটকা সৈকতে পৌঁছে যান। 

আধোঘুমে কেটে যাওয়া সারারাত ভ্রমনের ক্লান্তি যেন দূর করে দেয় অকুল সমুদ্রের ঢেউ। অনেকে হাটাহাটি করতে শুরু করেন সাগর পাড়ে, কয়েকজন দল বেধে বল খেলছেন হাঁটুপানিতে। কেউবা আবার নেমে পড়েন সমুদ্রে গোসলের জন্য। আনন্দে উল্লাসে মেতে উঠে তারা। 

হঠাৎ কানে এসে পৌঁছায় আত্নচিৎকার। তিন-চার জন শিক্ষার্থী ভাটার স্রোতের কবলে পড়েন। তাদের ‘বাঁচাও, বাঁচাও’ চিৎকারে পরিবেশ হঠাৎ করেই গম্ভীর হয়ে ওঠে। কিছুক্ষণের মধ্যে সবাই ব্যাপারটা বুঝতে পারেন। সাগরপাড়ে দাঁড়িয়ে চোখের সামনে এক অসহনীয় দৃশ্য। একটু দূরে সাগরের ঢেউয়ের ওপর কালো কালো কয়েকটা মাথা দেখা যাচ্ছে, আর তাদের উঁচু করা বাঁচতে চাওয়া হাতগুলো ভাটার টানে ভেসে যাচ্ছে আরো গভীরে। কিন্তু কারো যেন করার কিচ্ছু নেই। 

কেউ কেউ ছুটে গেলে তাদের দিকে। পাশের কাউকে একটু ওপরে এনেই আবার ছুটে যান অন্যকে উদ্ধারে। কারো চেষ্টা সফল হলেও অনেকেরই উদ্ধার সম্ভব হয়নি। যারা কোনমতে বেঁচে ফিরে এসেছেন, তারা বালুর ওপর শুয়ে পড়ে হাপাচ্ছিলেন, আর বমি করছিলেন। রুপা ও কাউসারকে তারা উদ্ধার করে আনলেও ততক্ষণে তারা আর নেই। চোখের সামনে প্রিয় সহপাঠীদের করুণ মৃত্যুর দৃশ্য দেখে অনেকেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন।

আরো পড়ুন: শিবির ট্যাগ দিয়ে মারধর, চুয়েট ছাত্রলীগের সাবেক ৬ নেতার বিরুদ্ধে মামলা

সাগরে ভেসে থাকা মুখগুলো আর দেখা যায়নি। গাছের ডাল আর লুঙ্গি দিয়ে স্ট্রেচার বানিয়ে কাউসার আর রূপাকে নিয়ে সবাই ফিরে আসেন লঞ্চঘাটের দিকে। অসহ্য যন্ত্রণ, চুপচাপ ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদছে সবাই। তখনো কেউ জানে না কতজনকে ফেলে এসেছে তারা। 

লঞ্চে এসে এক এক করে নাম ধরে ডাকা হচ্ছে সবাইকে। খুঁজে না পেলে ধরে নেয়া হচ্ছে তাদেরকে গ্রাস করে নিয়েছে সাগর। শেষে দেখা যায় ৯ জনকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। সাগর গ্রাস করে নিয়েছে ১১টি তরতাজা প্রান। এর মধ্য খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য ডিসিপ্লিনের নয়জন আর বাকি দু’জন বন্ধুদের সাথে ঘুরতে যাওয়া বুয়েটের যন্ত্রকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী। 

লঞ্চ চলতে শুরু করল খুলনার দিকে। নীচতলায় দুটি নিথর দেহ চাদরে ঢেকে রাখা। কেউ বসে, কেউ রেলিংয়ে হেলান দিয়ে, কেউ শুয়ে সবাই চুপচাপ। মাঝে মাঝে ডুকরে কেদে উঠছেন কেউ কেউ। এমন পরিবেশ যেন স্বান্ত্বনা দেওয়ার কেউ নেই।

যাদের হারিয়ে এসেছিলেন
• তৌহিদুল এনাম (অপু): চট্টগ্রামে জন্ম নেয়া অপু (পৈত্রিক নিবাস ফেনী) মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল, ঢাকা ও ঢাকা আইডিয়াল কলেজ শেষে ভর্তি হয় খুবির স্থাপত্য ডিসিপ্লিনে। চমৎকার আবৃতি করতেন। লেখালেখিও করতেন। খুবির প্রথম নাট্য সংগঠন নৃ-নাট্যের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অন্যতম সদস্য।

• আব্দুল্লাহ-হেল বাকী: খুলনা পাবলিক কলেজে স্কুল এবং খুলনা সুন্দরবন কলেজে শিক্ষা শেষে খুবির স্থাপত্য ডিসিপ্লিনে ভর্তি হন। ভালো ছড়া লিখতে পারতেন। বই পড়া ও বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে পছন্দ করতেন।

• কাজী মুয়ীদ ওয়ালি (কুশল): আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ঢাকা তে স্কুল জীবন পরে কোডা কলেজ অব অল্টারনেটিভ ডেভেলপমেন্ট কলেজ শেষে খুবিতে। ভালো ছবি আকতে পারতেন, বই পড়তেন। মেডিটেশন করতেন নিয়মিত।

• মো. মাহমুদুর রহমান (রাসেল): চট্টগ্রাম কলিজিয়েট স্কুল ও চট্টগ্রাম হাজী মো. মহসীন কলেজ শেষে খুবিতে। জন্মস্থান চাঁদপুর। টেবিল টেনিস খেলা পছন্দ করতেন। 

• মো. আশরাফুজ্জামান তোহা: স্কুল-কলেজ কাটিয়েছেন হারম্যান মাইনার স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মিরপুর, ঢাকাতে। জন্মস্থান ছিল যশোরে। ভাল গাইতেন এবং গীটার বাজাতেন।

• আরনাজ রিফাত রূপা: জন্ম ঢাকায়। স্কুল কেটেছে কাকলী বিদ্যালয় এবং কলেজ বদরুন্নেছা কলেজ, আজিমপুর ঢাকায়। ভালো রান্না পারতেন, অন্যকে রেধে খাওয়াতে পছন্দ করতেন।

• মাকসুমমুল আজিজ মোস্তাজী (নিপুন): জন্ম দিনাজপুরে। স্কুল কেটেছে দিনাজপুর জিলা স্কুলে পরে রাজশাহী ক্যাডেট কলেজে। সর্বদা হাশিখুশি থাকতেন। ভালো কবিতা আবৃতি করতেন ও লিখতেন। বিতর্ক ও আড্ডায় তার জুড়ি ছিল না। 

• মো. কাউসার আহমেদ খান: স্কুল বনানী বিদ্যা নিকেতনে পরে পাবনা ক্যাডেট কলেজ। জন্ম ঢাকায়। কম্পিউটারে গেমস খেলতে পছন্দ করতেন। স্বল্পভাষী ছিলেন, বই পড়তেন আর ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করতেন।

আরো পড়ুন: শিক্ষার্থীদের ৪ দাবি মেনে নিল নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, আন্দোলন প্রত্যাহার

• মুনাদিল রায়হান বিন মাহবুব শুভ: জন্মস্থান যশোরে। স্কুল-কলেজ কেটেছে দাউদ পাবলিক স্কুল ও কলেজ, যশোরে। বই পড়তেন খেলাধূলা করতেন। ঘুরে বেড়ানো ছিল তার শখ।

• শামসুল আরেফিন শাকিল: বুয়েটের যন্ত্রকৌশল বিভাগে পড়াশুনা করতেন। স্কুল কেটেছে টঙ্গী পাইলট স্কুল অ্যান্ড কলেজে। পরে নটরডেম কলেজে। তিমি ছিলেন ভ্রমণপ্রিয়। দেশের প্রায় ৪০টি জেলা ভ্রমণ করেছেন। অকাতরে বন্ধুদের সুখে-দুখে পাশে দাঁড়াতেন। কটকা সৈকতে দুর্ঘটনায় ১১জনকে উদ্দেশ্য করে টঙ্গীতে তাঁর বাবা একটা স্মৃতিসৌধ করেছেন। 

• সামিউল হাসান খান: আইডিয়াল প্রি-ক্যাডেট স্কুল কলেজ, ঢাকা ও নটরডেম কলেজ শেষে পড়াশুনা করতেন বুয়েটের যন্ত্রকৌশল বিভাগে। জন্মস্থান ঢাকায়। সাধারণ জ্ঞান ভাল পারতেন, বিভিন্ন প্রতিযোগীতায় অংশ নিতেন। কবিতা লিখতেন।


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence