কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্যাতনের শিকার ছাত্রের লিখিত অভিযোগ, কী ঘটেছিল সে রাতে

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটক
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটক   © ফাইল ছবি

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) শহীদ ধীরেন্দনাথ দত্ত হলে মারধরের শিকার হওয়ার পর প্রাধ্যক্ষ বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী ও গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ কাউসার। এ ঘটনায় হল প্রাধ্যক্ষের কাছে মারধরে অভিযুক্ত শিক্ষার্থী অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশনস বিভাগের মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলামসহ সংশ্লিষ্টদের বিচার চেয়েছেন তিনি। গত রবিবার (২৭ অক্টোবর) রাতে হল প্রাধ্যক্ষ বরাবর এ অভিযোগপত্র তিনি জমা দেন ।

এর আগে গত শনিবার রাতে তাকে মারধর করা হয় বলে কাউসার জানিয়েছিলেন। প্রভোস্টের কাছে সে বিষয়ে লিখিত অভিযোগ দিতে চাইলে হল প্রভোস্ট সে অভিযোগপত্র পরেরদিন জমা দিতে বলেন। এরপর অভিযোগপত্রে পরিবর্তন এনে নতুন আবেদন জমা দিয়েছেন বলে তিনি জানান। মারধরে জড়িতরা ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলে হলের একাধিক শিক্ষার্থী জানান। তবে ছাত্রদলের কেউ মারধরের ঘটনায় জড়িত নয় বলে দাবি করেছেন বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নেতারা। তাদের ভাষ্য, যিনি মারধর করেছেন- তিনি ছাত্রদলের নাম ভাঙিয়েছেন ‘নিরাপদে’ থাকার জন্য।

তৌহিদুল ইসলাম আমার রুমে (১০০৪) এসে বলে ‘চল মিটিং আছে’। আমি তখন যেতে অস্বীকৃতি জানালে তৌহিদুল বলেন, ‘আমি আসছি তোকে যেতেই হবে’। আমি তখনও যেতে না চাওয়ায় তাওহিদ আমার মশারী টান দিয়ে ছিঁড়ে ফেললে আমি তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিই। 

অভিযোগপত্রে কাউসার সেদিন রাতের ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন। তিনি বলেন, গত ২৪ অক্টোবর রাত ১১টার দিকে আমি ঘুমাতে গেলে তৌহিদুল ইসলাম আমার রুমে (১০০৪) এসে বলে ‘চল, মিটিং আছে’। আমি তখন যেতে অস্বীকৃতি জানালে তৌহিদুল বলেন, ‘আমি আসছি, তোকে যেতেই হবে’। আমি তখনও যেতে না চাওয়ায় সে আমার মশারী টান দিয়ে ছিঁড়ে ফেলে। তখন আমি তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিই। 

পরে তৌহিদুল তাকে কাঠের টুকরো দিয়ে মাথায় আঘাত করেন জানিয়ে কাউসার বলেন, ওই সময় সে নেশাগ্রস্ত ছিল। তখন তৌহিদ তার আরেক ব্যাচমেট (অর্থনীতি বিভাগের) তোফায়েল মাহমুদ নিবিড়কে ফোন দিয়ে নিয়ে আসে। 

তিনি আরও বলেন, গত ২৪ অক্টোবর সন্ধ্যায় ১৬তম আবর্তনের ছাত্ররা (লামিম, ইপেল) ১৭তম আবর্তনের শিক্ষার্থীদের বৈঠকের জন্য একটি কক্ষে ডাকেন। মারধরের ঘটনার পরে ১৬তম আবর্তনের জুনায়েদ লামীম (নৃবিজ্ঞান বিভাগ) এবং মাহাদুজ্জামান ইপেল (বাংলা বিভাগ) আমাকে (১০৪) নাম্বার কক্ষে নিয়ে যান এবং ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে সমাধানের জন্য চাপ দেন। তবে আমি তাতে সায় দিইনি। 

এদিকে এ ঘটনায় সংবাদ প্রকাশ করে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস। নিউজের প্রতিক্রিয়ায় অভিযুক্ত তৌহিদুল ইসলাম বিষয়টি মীমাংসা হয়ে গেছে দাবি করেন। বিষয়টি বন্ধুবান্ধবের মধ্যে ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করেন। এছাড়া তিনি মারধরের শিকার হয়েছেন বলেও দাবি করেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কাউসার বলেন, ‘বিষয়টি তারা মীমাংসা করতে চাইলেও আমি রাজি হইনি। আমি প্রথম লিখিত অভিযোগ দিতে গেলেও প্রভোস্ট স্যার পরেরদিন (রবিবার) জমা দিতে বললে আমি এতে কিছু পরিবর্তন করে জমা দিই। তবে যারা মিটিং ডেকেছিল, তারা ক্যাম্পাসে-হলে এখন ছাত্রদলের ব্যানারে রাজনীতি করছেন। তারা সম্প্রতি ছাত্রদলের নেতার আয়োজিত ট্যুরেও গিয়েছিল। আমি এখনও এ ঘটনার বিচার চাই। তৌহিদ যে হাতের কাটাছেঁড়ার ছবি পোস্ট দিচ্ছে, সেগুলো আমাকে মারধরের সময়ে কাঠের সঙ্গে থাকা লোহাতে আঘাত পেয়ে হয়েছে।’

তবে অভিযুক্ত তৌহিদুল ইসলাম অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘আমাদের ঘটনাটি দুইবার মীমাংসা হওয়ার পরও সে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে। আমাদের মাঝে হালকা একটু ঝামেলা হয়েছিল। আর আমি ছাত্রদলের কেউ না, ছাত্রদলের মামুনকে চিনিও না। আমি ট্যুরে গিয়েছিলাম আমার বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে।’ তবে এর আগে গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে কুবি শাখা ছাত্রদলের আহবায়ক আব্দুল্লাহ আল মামুনের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক আছে বলে জানিয়েছিলেন তিনি। 

ছাত্রদলের ওই ‘ট্যুরের’ বিষয়ে জানতে চাইলে আহবায়ক আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, তারা দলীয় কোনো ট্যুরের আয়োজন করেননি। এর আগে গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘এরা আমার কর্মী না। আমাদের সঙ্গে অনেকেই ভ্রমণ করতে গিয়েছিল।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদলের একাধিক সূত্র জানায়, ছাত্রদলের ট্যুরের আয়োজন করা হয়েছিল সাবেক সভাপতি নোমানসহ কয়েকজন ব্যবসায়ীর সহযোগিতায়। এ ছাড়া ছাত্রদলের ছেলে ঝামেলায় পড়েছেন শুনে ঘটনার সময় আারেক নেতা উপস্থিত হন। এমন তথ্যের অডিও রেকর্ড এ প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগঠনটির ৩১ সদস্যের আহবায়ক কমিটি রয়েছে।

এ বিষয়ে শহীদ ধীরেন্দনাথ দত্ত হলের প্রাধ্যক্ষ ড. জিয়া উদ্দিন বলেন, ‘আমার কাছে কাউসার নামের একজন ছাত্র অভিযোগ দিয়েছেন। প্রথমদিন আমাকে অভিযোগপত্র যেটি দিয়েছিল, সেটি আমি অফিস টাইমে জমা দিতে বলি। পরে সে সেখানে কিছু পরিবর্তন এনে জমা দেয়। রাজনৈতিক কোনো মিটিং ছিল কি না, জানতে পারিনি।’

আরো পড়ুন: ২৮ অক্টোবর: লগি-বৈঠা আন্দোলনে মানুষ মেরে লাশের ওপর নৃত্য করেছিল সেদিন

তিনি রবিবার সন্ধ্যায় বলেন, ‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি এখন নিষিদ্ধ। এছাড়া যে দুই জনের বিষয়ে কথা হচ্ছে, তারা কেউই আবাসিক না। আগামীকাল (সোমবার) বসে আমরা সিদ্ধান্ত নেব। তবে মৌখিকভাবে তাদের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে।’ 

এদিকে রবিবার (২৭ অক্টোবর) সন্ধ্যায় শিক্ষার্থীকে মারধরের ঘটনায় সংবাদ সম্মেলন করেন শাখা ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা। এ সময় মারধরকারীর সঙ্গে শাখা ছাত্রদলের কোনো সম্পর্ক নেই বলে উল্লেখ করেন তারা। এতে উপস্থিত ছিলেন শাখার আহবায়ক আব্দুল্লাহ আল মামুন ও সদস্য সচিব মুস্তাফিজুর রহমান শুভসহ অন্য নেতারা। 

আহবায়ক আব্দুল আল মামুন বলেন, ‘মারধরকারীর সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের কোনো সম্পর্ক নেই। সে ছাত্রদলের নাম ব্যবহার করেছে নিজেকে সেইফ জোনে রাখছে। আমার সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। এ ঘটনায় তার যথাযথ শাস্তি হোক। আমরা চাই শিক্ষার্থী, সাংবাদিক সবাইকে সঙ্গে নিয়ে সুন্দর ক্যাম্পাস পরিচালনা করি। দলের হাই কমান্ডের নির্দেশ শিক্ষার্থীবান্ধব যা কাজ করা যায়, তা করা। আমরা তা করছি, সামনেও করব।’ 


সর্বশেষ সংবাদ