শিক্ষার্থীদের দাবির প্রেক্ষিতে বিবেকের তাড়নায় আমি পদত্যাগ করেছি 

সহকারী অধ্যাপক ইনজামুল হক সজল
সহকারী অধ্যাপক ইনজামুল হক সজল  © টিডিসি ফটো

‘শিক্ষার্থীদের দাবির প্রেক্ষিতে বিবেকের তাড়নায় আমি পদত্যাগ করেছি। আমার বিরুদ্ধে যতগুলো অভিযোগ করেছেন এবং যতবার মৌখিক পদত্যাগ দাবি করেছেন আমার নিজের কাছে নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট শিক্ষক মনে হয়েছে’ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের জিওগ্রাফি এন্ড এনভায়রনমেন্ট বিভাগের সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করার পর বিভাগের শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে এমনই এক স্ট্যাটাস দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির সহকারী অধ্যাপক ইনজামুল হক সজল। 

এর আগে গত শনিবার বিভাগের ২০১৯-২০ সেশন থেকে ২০২২-২৩ সেশন পর্যন্ত প্রতিটি ব্যাচের শিক্ষার্থীরা বিভাগের নাম পরিবর্তন, সেশনজট নিরসন এবং নির্দিষ্ট সময়মতো ক্লাস-পরীক্ষা নেওয়া, ফিল্ড ওয়ার্কের অর্থ বরাদ্দ সহ ৯ দফা দাবিতে বিভাগের সভাপতি সহকারী অধ্যাপক ইনজামুল হক সজলের কাছে স্মারকলিপি প্রদান করতে গেলে শিক্ষার্থীদের সাথে শিক্ষকদের এক বৈঠক শেষে শিক্ষার্থীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এবং ব্যক্তিগত কারণ উল্লেখ করে পদত্যাগ করেন তিনি। 

কিন্তু পদত্যাগ করার পর তিনি স্বেচ্ছায় করেছেন নাকি শিক্ষার্থীদের চাপে পড়ে পদত্যাগ করেছেন তা নিয়ে সবার মাঝে আলোচনা সমালোচনার জন্ম নিলে বিভাগের শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে দেওয়া এক ফেসবুক পোস্টে তার অবস্থান স্পষ্ট করেন তিনি। শিক্ষার্থীদের লিখিত দাবির মধ্যে তার পদত্যাগের দাবি ছিল না উল্লেখ করে শিক্ষার্থীরা তার পদত্যাগ চায়নি বলে দাবি করে একদল শিক্ষার্থী। 

অপরদিকে শিক্ষকদের রীতিমতো অসম্মান করে এবং কথাবার্তার একপর্যায়ে বিভাগের সভাপতি ইনজামুল হককে চেয়ারম্যান হিসেবে অযোগ্যও ঘোষণা করা হয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন অধ্যাপক সজল। বিষয়টি পরিষ্কার করতে তিনি তার অবস্থান জানিয়ে স্ট্যাটাস দেন। 

প্রদানকৃত স্ট্যাটাসে ইনজামুল হক সজল বলেন, ‘প্রথম বিষয়টি হচ্ছে গতকাল শিক্ষকদের অসম্মান করা হয়েছে কি না? উত্তর: হ্যাঁ, অবশ্যই হয়েছে। আমি না হয় অভিনয় করি আমার বিষয় বাদ দিলাম কিন্তু বাকি ৩ জন শিক্ষক যে আপনাদের কথায় আফসোস আবেগ প্রদর্শন করেছেন এবং চোখের পানি ঝড়িয়েছেন তা কি অকারণেই? হয়ত আপনারা মনে মনে বলেছেন "অভিনয় কম কর পিও"। কিন্তু আমি হলফ করে বলতে পারি আমার সম্মানিত সহকর্মীদের আবেগ আফসোস আর চোখের পানি মোটেও ফেইক ছিলোনা।’ 

‘দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে বিভাগীয় সভাপতির পদত্যাগ, আপনাদের দাবির মুখে আমি পদত্যাগ করেছি না স্বদিচ্ছায়? উত্তরটা হচ্ছে আপনাদের দাবির প্রেক্ষিতে বিবেকের তাড়না থেকে (ব্যক্তিগত) আমি পদত্যাগ করেছি এবং পদত্যাগপত্রে এমনটাই লিখেছি। আমার বিরুদ্ধে আপনারা আপনাদের ক্ষোভের জায়গা থেকে অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা, স্বৈরাচারী মনোভাব, প্রহসনমূলক কর্মকাণ্ড, বিভাগের উন্নয়নে কোনও কাজ না করা, ডকুমেন্ট ছাড়া রিজাইন নিয়ে নাটকবাজী এবং কথাপ্রসঙ্গে দুর্নীতির কথাও বলেছেন।’

‘এই আন্দোলনের সকল ব্যাচের সমন্বয়কগণ সরাসরি কিংবা পরোক্ষভাবে একাধিকবার আমার পদত্যাগ চেয়েছেন। আপনারা লিখিত দাবিতে উল্লেখ না করলেও মৌখিক আলোচনায় আমার উপরই আপনাদের সকল অভিযোগের সিংহভাগ দায় চাপিয়েছেন। আলোচনার এক পর্যায়ে আপনারা চেয়ারম্যান হিসেবে আমাকে অযোগ্যও ঘোষণা করেছেন। এরপরেও কি বলবেন এটা আপনাদের দাবি ছিল না?’

ইবির এই শিক্ষক আরও বলেন, ‘সারাংশে আপনারা বলেছিলেন দাবি ঠিক যেমনটা লেখা আছে ঠিক তেমনভাবে না মানা হলে বিভাগ শাটডাউন এবং চেয়ারম্যানের পদত্যাগ আপনাদের চূড়ান্ত দাবি। আমি বাধ্য গত হয়েই আপনাদের কথা রেখেছি মাত্র এবং আপনাদের দাবিগুলো যতটুকু অ্যাড্রেস করা সম্ভব করার চেষ্টা করেছি। আমার অসম্মান নিয়ে আপনাদের প্রতি আমার কোনও অভিযোগ নেই, আপনারা আমার প্রতি আপনাদের দীর্ঘদিনের চাপা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন মাত্র। কিন্তু আমার সম্মানিত সহকর্মীদের অসম্মান আমি এখনও মেনে নিতে পারিনি। এক দিনের আন্দোলনের মধ্যেই যেভাবে নিজেদের যৌক্তিক দাবির পক্ষে বিভাগের শিক্ষকদের লিখিত সমর্থন আদায় করেছেন তা ইবির ইতিহাসে বিরল।’

এসব বিষয় নিয়ে অধ্যাপক ইনজামুল হক সজলের সাথে কথা হলে তিনি জানান, শিক্ষার্থীদের লিখিত দাবি একরকম এবং বিক্ষোভের জায়গা গুলো অন্য রকম। বিভাগের মাত্র ৩ জন অ্যাক্টিভ শিক্ষক দিয়ে ৬টা ব্যাচ চালাচ্ছি। আমাদের যে পরিমাণ ক্লাস হয় সেটা আসলে তারা জানে না। ৬ টা ব্যাচের ল্যাব, থিওরি মিলিয়ে মোট কোর্স আছে ৫০ টির মত, একেকজন ৫/৭ টি কোর্স নেওয়ার পর বাকিগুলো কে নেবে। 

আমি একাধিকবার প্রশাসনের কাছে শিক্ষক নিয়োগের আবেদন দিয়েছি কিন্তু কাজ হয়নি। এই বাস্তব প্রেক্ষাপটেও আমরা বিভাগের কার্যক্রম চালিয়ে নিচ্ছিলাম। ২০১৮-১৯ সেশনের ৪.২ সেমিস্টারের পরীক্ষা আগস্টে ছিল যেটা পিছিয়ে গেছে, ২১-২২ সেশনের ১১ মাসের মধ্যে দুইটা সেমিস্টার শেষ করে পরেরটার ডেট দিয়েছিলাম, ২২-২৩ সেশনের এক সেমিস্টার শেষ, আরেকটাও এতদিনে হয়ে যেত। বিভাগে এখন যতটুকু সেশনজট আছে সেটা করোনাকালীন এবং বর্তমান প্রেক্ষাপটের।

সেদিন কি ঘটেছিল জানতে চাইলে তিনি বলেন, সেদিন আমি কয়েক দফা ধাক্কা খেয়েছি। প্রথমে রাত সাড়ে ১১ টায় আমাদের নোটিশ দেওয়া হলো যে পরের দিন আসতে হবে, এটা প্রথম। এরপর সকাল নয়টা থেকে দুই ঘণ্টা আমাদের বসিয়ে রাখা হয়েছে। পরবর্তীতে তারা বলে এটা নাকি মেটাফোরিক প্রতিবাদ, আমাদের ক্লাস না নিয়ে যেমন বসিয়ে রাখেন আমরাও তাই করেছি, এটা দ্বিতীয়। এরপরে আমি দেখলাম শিক্ষার্থীদের সাথে আমাদের আলোচনার পূর্বেই সাংবাদিকেরা আমার রুমে বসে আছে।

আমরা যদি তাদের দাবি শোনার পর মেনে না নিতাম তাহলে তারা সাংবাদিকদের জানাতো বা কোন মুভমেন্টে যেতে পারত, সেখানে সাংবাদিকদের অগ্রিম উপস্থিতি আমাকে ভাবিয়েছে। আরেকটা বিষয় দেখে আমি অবাক হয়েছি সেটা হচ্ছে, তারা আসার সময় সাথে করে তালা নিয়ে এসেছে। তাদের প্রস্তুতি ছিল যে দাবি না মানা হলেই ডিপার্টমেন্টে তালা ঝুলিয়ে দেবে। আমরা চাইনি যে কোন ঝামেলার সৃষ্টি হোক, আমরা অনেক কিছু সহ্য করেছি, অঝরেও কেঁদেছি কিন্তু তারপরও তাদের সাথে কোন আরগুমেন্টে যাইনি।

বিভাগের নাম পরিবর্তনের বিষয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, পুরোপুরি নিয়মতান্ত্রিকভাবে বিভাগের নামটি পরিবর্তন করা হয়েছিল। ডিপার্টমেন্টে তখন তিনটি মাত্র ব্যাচ ছিল। সিনিয়র ব্যাচ থেকে নাম পরিবর্তনের আবেদন ও স্বাক্ষর সহ আমাদের কাছে একটি দরখাস্ত এসেছিল যেখানে ৯৭ শতাংশ শিক্ষার্থীর স্বাক্ষর ছিল। যাবতীয় ফর্মালিটি মেইনটেইন করার পর ভিসি স্যার আমাদের ডেকে আরেকবার আলোচনা করতে বলেন। ছলচাতুরি করে স্বাক্ষর নেওয়ার অভিযোগ উঠলে আমরা প্রতিটি ব্যাচকে আলাদা আলাদা করে ডাকি। টেবিলের উপর দরখাস্তটি রেখে আমরা কারো দ্বিমত থাকলে তার নাম কেটে দিতে বলি। তিনটি ব্যাচ মিলে মাত্র একজন তার নাম কেটে দেয়। 

পরবর্তীতে ভিসি স্যার তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনজন অধ্যাপককে বিষয়টি রিভিউ করার দায়িত্ব দেন। একাডেমিক কমিটির সিদ্ধান্ত, বাইরে অধ্যাপকদের রিভিউ এবং সিন্ডিকেট সভায় অনুমোদনের পর বিভাগের নাম পরিবর্তন করা হয়। যদি বর্তমানের সিংহভাগ শিক্ষার্থী আবার চায়, তাহলে যথাযথ প্রক্রিয়ায় বিভাগের নাম আবার পরিবর্তন সম্ভব। 

পদত্যাগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি পদত্যাগ করেছি সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে কারণ এটা তাদেরই ফরমুলা। তারা বলেই দিয়েছিল যে যেভাবে লেখা সেভাবেই দাবি না মানলে পদত্যাগ করতে হবে। তারা বছরে ৪টা সেমিস্টার চায়। এটা আমি কীভাবে মানবো? কলা বা সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদও সর্বোচ্চ চাইলে বছরে ৩ টা সেমিস্টার দিতে পারে কিন্তু আমার বিভাগে ল্যাব আছে, ফিল্ডওয়ার্ক আছে।

তারা বলে দিয়েছে আপনি পদত্যাগ করবেন সাধারণ শিক্ষার্থী এবং ডিনস বরাবরই, তবে আমি বলেছি ভিসি স্যার সেহেতু নাই এভাবে পদত্যাগ করা যায় না তারপরও আমি করেছি। শিক্ষার্থীরা যেহেতু বলেছে তারাই প্রশাসন তাই চিঠিটি আমি সাধারণ শিক্ষার্থী এবং রেজিস্ট্রার বরাবর লিখেছি।


সর্বশেষ সংবাদ