শুধু কুরআনের আয়াত নয়, পুরো লোগো পরিবর্তন করেছে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

বাউবির পুরনো ও নতুন লোগো
বাউবির পুরনো ও নতুন লোগো  © টিডিসি ফটো

বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাউবি) নতুন লোগো উন্মোচনের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তুমুল সমালোচনা হচ্ছে। এই লোগো থেকে পবিত্র কুরআনের আয়াত বাদ দেয়া হয়েছে জানিয়ে নেটিজেনরা বলছেন, কারও ধর্ম বিশ্বাসের সঙ্গে এই আয়াতটির কথা সাংঘর্ষিক নয়। তাই কর্তৃপক্ষের এই সিদ্ধান্তের ফলে দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষরা ভীষণভাবে মর্মাহত ও সংক্ষুব্ধ হয়েছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে, বাউবিকে বদলে দেওয়ার প্রত্যয় নিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধ ও সংস্কৃতির প্রতিফলন নতুন এই লোগোতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

আরও পড়ুন: বদলে গেল উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের লোগো

জানা যায়, গত ৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. সৈয়দ হুমায়ুন আখতার তার কার্যালয়ের সামনে এক অনুষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষক ও কর্মকতা-কর্মচারীদের উপস্থিতিতে এই লোগোটির উন্মোচন করেন। এসময় নতুন লোগো নিয়ে উপাচার্য বলেন, বাউবিকে বদলে দেওয়ার প্রত্যয় নিয়ে উন্মোচিত হলো নতুন লোগো। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উন্নত বাংলাদেশ গড়ার রূপকল্প বাস্তবায়ন, স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণ ও ডেল্টাপ্ল্যান বাস্তবায়নের পরিকল্পনাকে সামনে রেখেই বাউবি কাজ করে যাচ্ছে।

নতুন লোগোতে যা আছে 
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে, নতুন লোগোতে নানা অঙ্গীকার ও নানা উপলব্ধি সঞ্জীবিত হয়েছে। নতুন লোগোতে প্রযুক্তি নির্ভর উন্মুক্ত ও দূরশিক্ষণ, চতুর্থ শিল্পযুগ ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রতীকী, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সংক্ষিপ্ত বাংলা নাম ‘বাউবি’ আর ইংরেজি নাম ‘BOU’-এর বর্ণ তিনটি স্থান অনুপাতে অর্ধমূর্ত ও মূর্তভাবে এবং বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ‘Bangladesh Open University’ সরাসরি অর্ধবৃত্তাকারে উপস্থাপন ও রঙের বিন্যাস দেখানো হয়েছে।

নতুন লোগোর বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. সৈয়দ হুমায়ুন আখতার দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, নতুন লোগোর সবুজ অংশ দিয়ে বাংলাদেশকে বুঝানো হয়েছে। পরিবেশের সবুজকে বুঝানো হয়েছে। লাল দিয়ে যে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। আমাদের লাল-সবুজের পতাকাকে রিপ্রেজেন্ট করছে। আর নেভিব্লু কালারের ইউ শেফ হচ্ছে ইউনিভার্সাল ইউনিভার্সিটি। তাছাড়া মেঘের মাধ্যমে স্মার্ট এডুকেশনকে রিপ্রেজেন্ট করা হচ্ছে। 

পূর্বের লোগোতে যা ছিল
পূর্বের লোগোর শীর্ষে ডিশ অ্যানটেনা ব্যবহার করা হয়েছে। যার মাধ্যমে তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে জ্ঞান ছড়িয়ে দেওয়াকে বুঝানো হয়েছে। এরপর একটা ডিজাইন ব্যবহার করা হয় সেই ডিজাইনের নিচে ‘হে প্রভু তুমি আমার জ্ঞান বাড়িয়ে দাও’ (সূরা তোহা-১১৪) কুরআনের আয়াত লেখা ছিল। আর মাঝখানে বাংলায় লেখা ছিল ‘বাউবি’।

যে পরিবর্তন করা হয়েছে
দুইটি লোগো বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, পূর্বের লোগোর ভিজুয়াল রিফ্রেজেন্টশনের কোনো অংকিত অংশ নতুন লোগোতে রাখা হয়নি। নতুন লোগোতে নতুন কালারের মাধ্যমে সম্পূর্ণ পরিবর্তন করা হয়েছে। পূর্বের লোগোতে থাকা লোগোর শেষ অংশে ‘হে প্রভু তুমি আমার জ্ঞান বাড়িয়ে দাও’ এটিকে বাদ দিয়ে নতুন লোগোতে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি নাম BANGLADESH OPEN UNIVERSITY লেখা হয়েছে।

লোগোতে কুরআনের আয়াত যেভাবে এসেছে
জানা গেছে, এ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের লোগোটি তিনবার পরিবর্তন করা হয়েছে। প্রথমবার প্রতিষ্ঠাকালীন উপাচার্য অধ্যাপক এম শমসের আলী ১৯৯২ সালে করেন। সেখানে কুরআনের কোনো আয়াত ছিল না বলে জানান প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান উপাচার্য।

আরও পড়ুন: উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারবেন তৃতীয় লিঙ্গের শিক্ষার্থীরা

দ্বিতীয়বার সেই লোগো পরিবর্তন করে কুরআনের আয়াত যোগ করেন বাউবির সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এরশাদুল বারীর আমলে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সাবেক ডিন ছিলেন। তিনি ২০০১ সালের ১০ ডিসেম্বর থেকে ২০০৭ সালের মার্চ পর্যন্ত এ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন। এ শিক্ষাবিদ ২০১৩ সালের ১১ নভেম্বর মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে ইন্তেকাল করেন। 

সর্বশেষ ও তৃতীয়বারের মতো লোগোটি পরিবর্তন করেন বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ড. সৈয়দ হুমায়ুন আখতারের সময়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক ২০২১ সালের ১ জুলাই থেকে ৪ বছরের জন্য এই নিয়োগ পান।  

নতুন লোগো নিয়ে চলছে সমালোচনা 
লোগোতে কুরআনের আয়াত বাদ দেওয়াকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষরা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের তুমুল সমালোচনা করছে। বাংলাদেশের সুপরিচিত আলেম ও আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান শায়খ আহমাদুল্লাহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লেখেন, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন লোগো থেকে ‘হে প্রভু তুমি আমার জ্ঞান বাড়িয়ে দাও’ কুরআনিক বাক্যটি সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের এই সিদ্ধান্তে এদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষেরা যে ভীষণভাবে মর্মাহত ও সংক্ষুব্ধ হয়েছে, বলার অপেক্ষা রাখে না।

আরও পড়ুন: ১১২ বিশ্ববিদ্যালয়কে পেছনে ফেললো উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

'আমরা অনেকেই ধর্মকে উন্নতি ও অগ্রগতির পথে বাধা মনে করছি' মন্তব্য করে তিনি আরও লেখেন, অথচ মালয়েশিয়া-সহ পৃথিবীর বহু মুসলিম দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ইসলামি মূল্যবোধ ও আদর্শ বহাল থাকার পরও তারা উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছেছে। শুধু তাই নয়, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, ডেনমার্ক-সহ অনেক খ্রিষ্টান প্রধান দেশের জাতীয় পতাকায় খচিত আছে তাদের ধর্মীয় নিদর্শন ক্রুশের চিহ্ন। পৃথিবীর বহু দেশের জাতীয় সংগীতে উজ্জ্বল হয়ে আছে তাদের ধর্মের অনুষঙ্গ।

তিনি আরও লেখেন, এমনকি যাদের আমরা উন্নয়নের রোল মডেল মনে করি, যাদের উন্নতি দেখে আমরা দিবারাত্র ঈর্ষা করি, সেই তাদের ডলারের গায়ে লেখা আছে ইন গড উই ট্রাস্ট। ধর্ম তাদের উন্নতি ও অগ্রগতির পথে বাধা হলো না, অথচ উন্নতির দোহাই দিয়ে আমরা নানাভাবে ধর্মীয় অনুষঙ্গ ছাঁটাই করে চলেছি। এটা করে আমরা কতটুকু উন্নত হতে পেরেছি তা উল্লিখিত দেশগুলোর সাথে নিজেদের তুলনা করলেই স্পষ্ট হয়ে যায়। 

আরও পড়ুন: ছুটি ছাড়া চার বছর ধরে জাপানে বেরোবি শিক্ষিকা মাশরেকী

শায়খ আহমাদুল্লাহ শেষে লেখেন, পৃথিবীর প্রায় সভ্যতা ধর্মীয় বিশ্বাসের ওপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছে। এ কারণে ধর্মের কাছে আমাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। যারা উন্নয়নের দোহাই দিয়ে ধর্ম ত্যাগ করছে, তারা মূলত বিশ্বসভ্যতার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করছে। আজ একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠানের লোগো থেকে কুরআনিক বাক্য সরিয়ে দেওয়া হলো। কাল অন্য জায়গা থেকে যে সরিয়ে দেওয়া হবে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এভাবে চলতে থাকলে একদিন মুসলিম নামটাই আমাদের কাছে লজ্জার কারণ হয়ে উঠবে।

জনপ্রিয় ইসলামী বক্তা মিজানুর রহমান আল আজহারী লেখেন, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের লোগো থেকে কুরআনের একটি আয়াতকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ধর্মীয় সম্প্রীতির দেশ, ধর্মহীন দেশ নয়। ‘হে প্রভু তুমি আমার জ্ঞান বাড়িয়ে দাও’— বাক্যটি খুবই ইনক্লুসিভ। কারও ধর্ম বিশ্বাসের সাথেই কথাটি সাংঘর্ষিক নয়।  এ বাক্যটি শুধু কুরআনের আয়াতকে প্রতিনিধিত্ব করে না, বরং এটা প্রতিনিধিত্ব করে গোটা দেশের সকল ধর্মের মানুষের মৌলিক ধর্ম বিশ্বাসের। জ্ঞান তো প্রভুর কাছেই চাইতে হবে। 

তিনি আরও লেখেন, কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমরা নয়; হিন্দু, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ নির্বিশেষে যেকোন ধর্মের শিক্ষার্থীরা একই সুরে একই সাথে নির্দ্বিধায় বলতে পারে— ‘হে প্রভু তুমি আমার জ্ঞান বাড়িয়ে দাও’। হোক না ধর্ম বিশ্বাস ভিন্ন ভিন্ন। কিন্তু এ বাক্যটিতে কারো আপত্তি থাকার কথা নয়। তবুও সুকৌশলে ইসলামের চমৎকার এ নিদর্শনগুলো মুছে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে। চাইলে মদিনা সনদেই চলতে পারে যে দেশ; সেখানে এমনটা কেন হচ্ছে?

লোগো পরিবর্তন নিয়ে উপাচার্যের বক্তব্য
লোগো পরিবর্তন কেন প্রয়োজন হল, জানতে চাইলে বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ড. সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, নতুন লোগো নিয়ে যারা সমালোচনা করছে তারা জামায়াতের লোক। এরশাদুল বারী (সাবেক উপাচার্য) জামায়াতের লোক, তারা সমালোচনা করছে। 

সমালোচনা অল্প মানুষ করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, হাজার হাজার মানুষ নতুন এ লোগো নিয়ে প্রশংসা  করছে। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের কনসেপ্ট এটা সবার জন্য শিক্ষা উন্মুক্ত। বর্তমান তথ্য প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশ, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশের কালচার সব নতুন লোগোতে উল্লেখ রয়েছে। 

লোগোর মাধ্যমে ভিজুয়াল ল্যাংগুয়েজ তৈরি হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, লোগো দেখে সবাই বুঝতে পারে এটা কোন অর্গানাইজেশনকে প্রতিনিধিত্ব করছে। এটা কি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে প্রতিনিধিত্ব করছে নাকি কোনো বিজনেস অর্গানাইজেশনকে প্রতিনিধিত্ব করছে অথবা কোনো ধরনের গভর্নমেন্ট অর্গানাইজেশনকে প্রতিনিধিত্ব করছে। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক আরও বলেন, বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের চলতে হবে। আগের লোগো আদিকালের লোগো। এই লোগো দিয়ে বিদেশের কেউ বুঝতে পারে না— এটা কোন দেশের প্রতিষ্ঠান অথবা এটা কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কিনা। বর্তমান লোগো দিয়ে এটা কি ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সবাই বুঝতে পারবে। আগের লোগোতে এগুলো ছিল না। এছাড়াও আগের লোগো উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্যকে  প্রতিনিধিত্ব করে না বলে দাবি করেন তিনি। 

বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আলমগীর দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের লোগো পরিবর্তনটি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে নিজস্ব বিষয়। তাতে ইউজিসির অনুমোদনের প্রয়োজন নেই। 

তিনি আরও বলেন, যেকোন পরিবর্তনই কিছু মানুষকে আহত করে। তবে এই পরিবর্তন স্বাভাবিক বিষয় বলে মনে করছেন তিনি।


সর্বশেষ সংবাদ