জন্ম-বেড়ে ওঠা একত্রে, একসঙ্গে সমাবর্তনে গোল্ড মেডেলিস্ট যমজ বোনের গল্প

অদম্য মেধাবী

আফিয়া আলম এবং লামিয়া আলম
আফিয়া আলম এবং লামিয়া আলম  © টিডিসি ফটো

আফিয়া আলম এবং লামিয়া আলম। দুজনেই যমজ বোন। তবে আফিয়া আলম এক মিনিট আগে এবং লামিয়া আলম এক মিনিট পরে জন্মগ্রহণ করেন। একসঙ্গে যেমন পৃথিবীতে এসেছেন, তাদের বেড়ে উঠাও একসঙ্গে। আর অ্যাকাডেমিক ক্যারিয়ারের সফলতায় দুজনের অর্জনও অসাধারণ। সর্বশেষ ইউনিভার্সিটি অফ এশিয়া প্যাসিফিকের (ইউএপি) দশম সমাবর্তনে আচার্য (রাষ্ট্রপতি) স্বর্ণপদক (গোল্ড মেডেলিস্ট) পেয়েছেন অদম্য এই মেধাবী যমজ বোন।

আফিয়া ও লামিয়ার গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জ জেলায় হলেও জন্ম এবং বেড়ে ওঠা রাজধানী ঢাকাতে। ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিকে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে অদম্য মেধাবী এই দুই বোন ইউনিভার্সিটি অফ এশিয়া প্যাসিফিকে (ইউএপি) ভর্তি হন। বড় বোন আফিয়া আলম বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন এবং ছোট বোন লামিয়া আলম ফার্মেসি বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন।

“আফিয়া আলম এবং লামিয়া আলম যমজ বোন হলেও দু’জন দুটি বিভাগে অধ্যয়ন করেছেন। নিজেদের প্রচেষ্টা এবং সচেতনতায় আজ তারা সর্বোচ্চ রাষ্ট্রপতির স্বর্ণপদক লাভ করেছেন। তাদের মধ্যে আফিয়া আলম সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে রেকর্ড করেছে। ইউএপি তাদের এই অর্জনে গর্বিত-অধ্যাপক ড. কামরুল আহসান, উপাচার্য, ইউএপি

উচ্চশিক্ষায় শুধু ভালো ফলাফল নয়, ভিন্ন দুটি বিভাগ থেকে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করলেও কৃতিত্বের স্বাক্ষর স্বরূপ অনন্য রাষ্ট্রপতির স্বর্ণপদক গলায় জড়িয়েছেন একসাথে সমাবর্তন অনুষ্ঠান থেকে। ব্যতিক্রম এই অর্জনের পেছনে রয়েছে তাদের ব্যতিক্রমী অভিজ্ঞতা। দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের মুখোমুখি হন দুই বোন। জানান, একে অপরের বন্ধুত্ব সুলভ সম্পর্ক, পড়াশোনায় অনুপ্রেরণা এবং সহযোগিতার গল্প।

ইউনিভার্সিটি অফ এশিয়া প্যাসিফিকের (ইউএপি) দশম সমাবর্তন অনুষ্ঠান

সৃষ্টিকর্তাকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আফিয়া আলম জানান, আমি অ্যাকাডেমিক পড়াশোনার পাশাপাশি বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন কর্তৃক আয়োজিত বিভিন্ন এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিতে অংশগ্রহণ করতাম। যেটি আমাকে অন্যদের থেকে ভালো ফলাফল করতে সহায়তা করেছে৷ এই অর্জন আমি আমার পরিবারকে ধন্যবাদ দিতে চাই।

“উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে গিয়ে ডিগ্রি অর্জন ও ফিরে এসে শিক্ষকতায় নিজেকে যুক্ত করতে চাই। কারণ এটি একটি নোবেল প্রফেশন এই কারণে যে, এখানে আমি যা অর্জন করেছি সেটি অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারব। আরেকটি দিক হলো এই পেশায় চিন্তা, গবেষণা ও নিজেকে সময় দেয়ার চমৎকার সুযোগ থাকে-আফিয়া আলম

লামিয়া আলম তাঁর পরিবারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, স্নাতক এবং স্নাতকোত্তরে আমার এই অর্জন জীবনের গতিপথ নির্ধারণ করে দেয়ার মতো। মা এবং পরিবারের অন্যদের সাথে বিশেষত আমার ফুফুকে ধন্যবাদ দিতে চাই। তিনি আমাদের পড়াশোনার ক্ষেত্রে অনেক বেশি সহায়তা করেছেন।

তিনি আরও যোগ করেন, আমরা দুজন বোন হওয়ায় ভালো ফলাফলের ক্ষেত্রে অনেক বেশি সচেতন হতে পেরেছি। একজন আরেকজনকে সব সময় অনুপ্রাণিত করতে পারতাম। কিংবা যখন দেখতাম আমার বোন পড়তে বসেছে, তখন আমিও পড়তে বসতাম। আমরা সব সময় পড়াশোনার ক্ষেত্রে সচেতন ছিলাম। সব সময় ভাবতাম এখন একটু ১০ মিনিট বেশি পড়ার চেষ্টা করি। পরীক্ষার পরে আমরা ১০ মিনিট উপভোগ করতে পারব। কারণ আমরা সব সময়ই একসাথে ছুটি পেতাম। যদি ভিন্ন ভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় হতো তাহলে সেই সুবিধা পেতাম না।

পড়াশোনায় নিজেদের প্রচেষ্টা সম্পর্কে আফিয়া আলম জানান, যমজ হলেও আমাদের দুই জনের পড়াশোনার ধরন সম্পূর্ণ আলাদা।আমি সকালের দিকে পড়তে পছন্দ করতাম আর বোন রাত জেগে পড়তে পছন্দ করত।

শনিবার (৪ মে) সকালে রাজধানীর পূর্বাচলের বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ-চায়না ফ্রেন্ডশিপ এক্সিবিশন সেন্টারে ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের (ইউএপি) দশম সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে মোট ৯ জন শিক্ষার্থীকে আচার্য স্বর্ণপদক এবং ৫৫ জন শিক্ষার্থীকে উপাচার্য স্বর্ণপদক প্রদান করা হবে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়টির স্নাতক ও স্নাতকোত্তরের মোট ৫ হাজার ৯৭৭ জন শিক্ষার্থীর হাতে সনদ তুলে দেয়া হয়েছে।

ভালো ফলাফলের ক্ষেত্রে তিনি জানান, অনেকে মনে করেন, সারাদিন পড়াশোনা করলে হয়ত রেজাল্ট ভালো করা যায়, তবে আমি মনে করি সারাদিন বসে থাকার চেয়ে মনোযোগ সহকারে পড়তে পারা অনেক বেশি কার্যকরী। পাশাপাশি  আপনি যদি আপনার ইন্সট্রাক্টরের লেকচার মনোযোগ দিয়ে শুনেন, তাহলে অর্ধেক পড়াশোনা হয়ে যায়। সুতরাং কঠোর পরিশ্রমের সাথে আপনাকে আন্তরিক হতে হবে। ভালো ফলাফল করতে হলে সেটি গুরুত্বপূর্ণ।

ইউএপির দশম সমাবর্তনের সভাপতি ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী

সাফল্য অর্জনের পেছনে প্রতিবন্ধকতা কি ছিল জানতে চাইলে লামিয়া আলম জানান, সত্যি বলতে পড়তে কারও ভালো লাগে না, আমাদেরও না। তবে যখন পড়তে ভালো না লাগলেও যখন আরেকটু পড়তে পারা যায়, তখনই সফলতা আপনার জন্য সহজ হয়ে যায়। নিজের সাথে এই চ্যালেঞ্জ নেয়া এবং পরিশ্রম করতে পারা সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি আরেকটি দিক হলো আমরা জমজ হওয়ায় চমৎকার একটি সুবিধা নিতে পেরেছি, অর্থাৎ যখন পড়তাম আমরা একে অপরের সাথে রুটিন শেয়ার করতাম এবং নিয়মিত আপডেট দিতাম যে আজকে এতগুলো চ্যাপ্টার শেষ করবো। তখন আমার বোনও তার পড়া এগিয়ে রাখত।

“আমরা দুজন বোন হওয়ায় ভালো ফলাফলের ক্ষেত্রে অনেক বেশি সচেতন হতে পেরেছি। একজন আরেকজনকে সব সময় অনুপ্রাণিত করতে পারতাম। কিংবা যখন দেখতাম আমার বোন পড়তে বসেছে, তখন আমিও পড়তে বসতাম। আমরা সব সময় পড়াশোনার ক্ষেত্রে সচেতন ছিলাম। সব সময় ভাবতাম এখন একটু ১০ মিনিট বেশি পড়ার চেষ্টা করি-লামিয়া আলম

পরবর্তী গন্তব্য সম্পর্কে আফিয়া আলম জানান, উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে গিয়ে ডিগ্রি অর্জন এবং ফিরে এসে শিক্ষকতায় নিজেকে যুক্ত করতে চাই। কারণ এটি একটি নোবেল প্রফেশন এই কারণে যে, এখানে আমি যা অর্জন করেছি সেটি অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারব। আরেকটি দিক হলো এই পেশায় চিন্তা, গবেষণা এবং নিজেকে সময় দেয়ার চমৎকার সুযোগ থাকে। আগামী দশ বছর পরে কোন একটা ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে হয়ত এশিয়া প্যাসিফিকে নিজেকে একজন ফ্যাকাল্টি হিসেবে দেখতে চাই।

তরুণ শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্য করে লামিয়া আলম জানান, আমার পরামর্শ থাকবে, অপরিকল্পিতভাবে সারাদিন পড়াশোনার পেছনে ব্যয় না করে পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।

বড় বোন আফিয়া আলম জানান, আমি মনে করি, সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ফ্যাকাল্টির লেকচার মনোযোগ সহকারে অনুধাবন করা। কারণ তারা অনেক সময় বাস্তবিক জীবন থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সমূহ শেয়ার করেন। পড়াশোনার পাশাপাশি এক্সটার্নাল অ্যাক্টিভিটি এবং কো-কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিতে নিজেদের সংযুক্ত রাখতে হবে। কারণ প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে নিজেকে প্রমাণ করতে হলে দক্ষতার কোন বিকল্প নেই। 

দুই বোনের অনন্য এই সফলতায় উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. কামরুল আহসান জানান, ইউএপি কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতের জন্য একটি আদর্শ পরিবেশ নিশ্চিত করতে পেরেছে। এই চমৎকার ফলাফল তার বহিঃপ্রকাশ। আফিয়া আলম এবং লামিয়া আলম যমজ বোন হলেও দু’জন দুটি বিভাগে অধ্যয়ন করেছেন। নিজেদের প্রচেষ্টা এবং সচেতনতায় আজ তারা সর্বোচ্চ রাষ্ট্রপতির স্বর্ণপদক লাভ করেছেন।

“তাদের মধ্যে আফিয়া আলম সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে রেকর্ড করেছে। ইউএপি তাদের এই অর্জনে গর্বিত। তার মেধাবীদের জন্য অনুপ্রেরণা যোগাবে। পাশাপাশি নতুনদের উদ্দেশ্যে আমি বলব তোমরা কি শিখেছ সেটা বড় কথা নয়, বরং তোমরা কি করতে পার সেটি জাতিকে দেখিয়ে দাও।”

প্রসঙ্গত, শনিবার (৪ মে) সকালে রাজধানীর পূর্বাচলের বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ-চায়না ফ্রেন্ডশিপ এক্সিবিশন সেন্টারে ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের (ইউএপি) দশম সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে মোট ৯ জন শিক্ষার্থীকে আচার্য স্বর্ণপদক এবং ৫৫ জন শিক্ষার্থীকে উপাচার্য স্বর্ণপদক প্রদান করা হবে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়টির স্নাতক ও স্নাতকোত্তরের মোট ৫ হাজার ৯৭৭ জন শিক্ষার্থীর হাতে সনদ তুলে দেয়া হয়েছে।


সর্বশেষ সংবাদ