হাতে মাইক, মনে জেদ— হাথরসের দুই আসল বীরাঙ্গনা (ভিডিও)

তনুশ্রী পান্ডে এবং প্রতিমা মিশ্র
তনুশ্রী পান্ডে এবং প্রতিমা মিশ্র  © আনন্দবাজার

তনুশ্রী পান্ডের টুইটার বায়ো বলছে ‘ননকনফরমিস্ট অ্যান্ড হিউম্যানিস্ট। আই ইনসিস্ট অন বিয়িং ট্রুথফুল, নট নিউট্রাল’। প্রথাবিরোধী এবং মানবতাবাদী। আমি সত্যের প্রতি দায়বদ্ধ, নিরপেক্ষতার প্রতি নয়। প্রতিমা মিশ্রের ইনস্টাগ্রামে নরম্যান কাজেন্সের উদ্ধৃতি, ‘দ্য ট্র্যাজেডি অব লাইফ ইজ নট ডেথ। বাট হোয়াট উই লেট ডাই ইনসাইড অফ আস হোয়াইল উই লিভ’। মৃত্যু জীবনকে বিষণ্ণ করে না। জীবনের আসল ট্র্যাজেডি হল সেটা, যেটা জীবদ্দশায় আমরা নিজেদের ভিতরে মেরে ফেলি’।

গত রবিবার বিকেলে পরপর দু’জনেরই মোবাইল নম্বর ঘুরিয়ে একাধিকবার শোনা গেল ‘সুইচ্ড অফ’। স্বাভাবিক। প্রথমজনের মোবাইলে আড়ি পেতে ব্যক্তিগত কথোপকথন রেকর্ড করে তা সোশ্যাল মিডিয়ায় ছেড়ে দিয়েছে ভারতের উত্তরপ্রদেশ প্রশাসন। দ্বিতীয়জন সম্ভবত সেই কারণেই আরও সতর্ক। অথবা হতে পারে ৩ অক্টোবর (শনিবার) জন্মদিনটা কাটিয়ে রবিবারটা একটু একান্তে থাকছেন।

প্রিয় রং কালো আর নীল। অমৃতসরে বেড়ে-ওঠা তরুণীর ইনস্টাগ্রাম প্রোফাইলে তাঁর ঘরের টেবিলে ‘আনন্দ’ ছবির বিখ্যাত ডায়ালগ ফ্রেমবন্দি— ‘বাবুমশাই, জিন্দেগি বড়ি হোনি চাহিয়ে, লম্বি নহি’। আর কলকাতা শহরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদযাত্রা কাভার করে পায়ে ফোস্কা-পড়া (তাঁর কথায়, ‘ব্যাটল স্কার অফ আ জার্নালিস্ট’। সাংবাদিকের যুদ্ধক্ষত) প্রথমজনের ইনস্টা প্রোফাইলে লাল পুঁতির মতো চোখের খরগোশের নড়াচড়া। সঙ্গের ক্যাপশনে পোষ্যের পরিচয়, ‘আ পিস অব মাই মেন্টাল পিস’। আমার মানসিক শান্তির এক টুকরো।

উত্তরপ্রদেশের হাথরসে দলিত তরুণীকে ধর্ষণ, তাঁর মৃত্যু এবং যোগী আদিত্যনাথ সরকারের প্রশাসনের ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার মরিয়া চেষ্টায় দেশ উত্তাল। এ তো গেল বহিরঙ্গের দৃশ্যপট। কিন্তু সেই ঘটনাপ্রবাহের সূত্রধর হয়ে রয়ে গেলেন দুই সাংবাদিক। একজন, যিনি সত্যের প্রতি দায়বদ্ধ, নিরপেক্ষতার প্রতি নন। অন্যজন, যিনি মনে করেন, জীবনের আসল বিষাদময়তা হল বেঁচে থাকতে থাকতে নিজেদের ভিতরের বোধগুলোকে মেরে ফেলা।

গভীর রাতে নির্যাতিতার দেহ কাঠের অগোছাল চিতায় চড়িয়ে দেশলাই জ্বালিয়ে সেটা পুড়িয়ে দিচ্ছে যোগীর পুলিশ। ‘ইন্ডিয়া টুডে’-র সাংবাদিক তনুশ্রী এবং তাঁর ক্যামেরাপার্সন ওয়াকার আহমেদ সেই দৃশ্য দেখিয়েছিলেন গোটা দেশকে। দেখাতে দেখাতেই তনুশ্রী টুইট করেছিলেন, ‘অবিশ্বাস্য! আমার ঠিক পিছনেই হাথরাস মামলার মৃতার দেহ পুড়ছে। পুলিশ তার পরিবারকে ঘরে আটক করে রেখেছে। আর সকলের অগোচরে লাশ পোড়াচ্ছে।’

তার অব্যবহিত আগে তনুশ্রী প্রায় দেড় মিনিটের আরও একটি ভিডিও টুইট করে লিখেছিলেন, ‘নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছি না। ইউপি পুলিশ পরিবারকে বলছে, সময়ের সঙ্গে রীতি-রেওয়াজ বদলে যায়। আপনারা মেনে নিন, ভুল করেছেন। আর পরিবারটি বলছে, আপনারা কেন আমাদের মেয়েটাকে কিছুক্ষণের জন্য বাড়ি নিয়ে যেতে দিচ্ছেন না? কেন আমাদের উপর জোর খাটাচ্ছেন?’

এখনও পর্যন্ত সেই দৃশ্য দেখেছেন ৩৩ লাখ মানুষ। দেখেছেন, হাথরসের নির্যাতিতার দেহ ‘দাহ’ করা হল না। হেলাফেলায় কাঠকুটোর মতো পুড়িয়ে দেওয়া হল। সেটা ছিল গত মঙ্গলবার-বুধবারের রাত। বৃহস্পতিবার থেকে হাথরসের অজ গাঁয়ে নির্মিত হল বাস্তবের প্রতিমা। প্রতিমা মিশ্র। সারা দেশ গভীর বিস্ময় নিয়ে দেখল, গাঁন্ধী পরিবারের নবীন প্রজন্মের দুই রাজনীতিক রাহুল–প্রিয়ঙ্কা যেখানে ঢুকতে না পেরে ফিরে এসেছেন, সেখানে মাটি কামড়ে পড়ে রয়েছেন ছোট্টখাট্ট, একহারা চেহারার তরুণী।

ব্যারিকেডের সামনে বসে পড়ছেন। পুলিশের মুখে ঠুসে ধরছেন চ্যানেলের বুম। ক্রমাগত প্রশ্ন করছেন। করছেন তো করছেন। করেই যাচ্ছেন। তোতাপাখির মতো পুলিশ যখন বলছে, তাঁকে নির্যাতিতার গ্রামে ঢুকতে দেবে না, এবিপি নিউজের সাংবাদিক তখন গলা চড়িয়ে বলছেন, ‘অর্ডার কোথায়? গ্রামে ঢুকতে না দেওয়ার অর্ডার কোথায়? অর্ডার! অর্ডার! অর্ডার! অর্ডার! অর্ডার! অর্ডার! অর্ডার!’

নাচার, দিশেহারা এবং ভ্যাবাচ্যাকা পুলিশ অফিসার ক্যামেরার লাইভ ফিডের তার ধরে টান মারছেন। তারপর মহিলা পুলিশ ডাকছেন। উর্দিধারী মহিলারা এসে পুঁচকে চেহারার প্রতিমাকে চালের বস্তার মতো তুলে দিচ্ছেন পুলিশের গাড়িতে। গ্রামের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে পাকা রাস্তায় তোলার পরেও তিনি মাইক্রোফোন বাড়িয়ে দিচ্ছেন সামনের সিটে প্রস্তরবৎ বসে থাকা মহিলা অফিসারের দিকে।

বলছেন, ‘খুব পরিশ্রম হল। না? দেখুন, দেখুন। রুমাল বার করে ঘাম মুছছেন উনি এখন!’ তার পর সহযোগী ক্যামেরাপার্সন মনোজকে, ‘ক্যামেরা বন্ধ করবে না একদম!’ অন্তহীন প্রশ্ন তাঁর। যার কোনও জবাব আসছে না। কিন্তু তিনি থামছেন না।

যা দেখে চমৎকৃত প্রবীণ সম্পাদক অশোক দাশগুপ্ত। তাঁর কথায়, ‘এগুলোই হচ্ছে সাংবাদিকতার নিশান। এই হামাগুড়ি দেওয়ার সময় দু’টি বাচ্চা মেয়ে যে সাহস আর দক্ষতা দেখাল, সেটা অভাবনীয়। ওদের দু’জনকেই স্যালুট।’ অশোক আরও বলছেন, ‘এরাই তো ইস্যুটা দিল রাজনীতিকদের। যেখানে রাহুলকে যেতে দিল না যোগীর পুলিশ, এরা সেখানে পৌঁছল। শুধু পৌঁছল না। খুঁড়ে বার করে আনল। ঢুকে পড়ার সাহস, বলায় আন্তরিকতা আর রোখা ভঙ্গি। উত্তরপ্রদেশ সরকার যে কিছুটা হলেও পিছু হটে সিবিআই তদন্তের সিদ্ধান্ত নিল, তাতে তো এদেরই সবচেয়ে বড় ভূমিকা থেকে গেল।’

পরদিন যখন নাছোড় প্রতিমা গিয়ে পৌঁছেছেন নির্যাতিতার বাড়ির দাওয়ায়, তখনও দিল্লি থেকে হাথরসের পথে রওনা হতে পারেননি রাহুল-প্রিয়ঙ্কা। তনুশ্রী-প্রতিমা হাথরসের পাতায় লিখেছেন নতুন ইতিহাস। ঘটনাস্থলে আগে পৌঁছাবেন রাজনীতির কারবারিরা। আর তাঁদের পিছু পিছু পৌঁছাবে সাংবাদিক। এই ছিল এই দেশের দস্তুর। তনুশ্রী-প্রতিমা সেই ব্যাকরণ বদলে দিয়েছেন। তাঁরা সেখানে পৌঁছেছেন, যেখানে পৌঁছতে পারেননি রাহুল-প্রিয়ঙ্কার মতো আপাত-সর্বশক্তিমান রাজনীতিকরাও!

৪৩ বছর আগে ১৯৭৭ সালের জুলাই মাসে বিহারের নালন্দা জেলার বেলচি গ্রামে দলিত গণহত্যার পরে স্বজনহারা পরিবারগুলোকে ভরসা দিতে ছুটে গিয়েছিলেন ক্ষমতাচ্যুত ইন্দিরা গাঁন্ধী । প্রায় সাড়ে তিন ঘন্টা কাদাভর্তি রাস্তায় হেঁটে, হাতির পিঠে জলাজমি পেরিয়ে পৌঁছেছিলেন ঘটনাস্থলে। তখনও সেখানে পৌঁছয়নি জাতীয় স্তরের কোনও সংবাদমাধ্যম।

তার মাস চারেক আগেই লোকসভা ভোটে ভরাডুবি হয়েছে কংগ্রেসের। দলের অন্দরেও ইন্দিরার নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন তাঁর বিরোধীরা। কিন্তু বিহারের সেই প্রত্যন্ত গ্রামে কার্যত রাজনৈতিক পুনর্জন্ম হয়েছিল ইন্দিরার। কর্নাটকের চিকমাগালুর লোকসভা উপনির্বাচনে জয় তাঁকে নিয়ে গিয়েছিল জনপ্রিয়তার নতুন শিখরে। জরুরি অবস্থার স্মৃতি মুছে ফেলে ফের দিল্লির ক্ষমতায় পুনপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন।

গত লোকসভা ভোটের আগে সক্রিয় রাজনীতিতে এসেছেন প্রিয়াঙ্কা। কিন্তু হাথরস দেখাল, তিনি তাঁর ঠাকুরমার চেয়ে এখনও অন্তত ৪৩ আলোকবর্ষ পিছিয়ে। দুই সাংবাদিকের মধ্যে যে অনমনীয়তা, যে জেদ দেখল গোটা দেশ, তার পাশে ফ্যাকাসে হয়ে গেলেন পেশাদার রাজনীতিকরা।

নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক রাজধানীতে দীর্ঘসময় সাংবাদিকতা-করা বর্ষীয়ান আবার ভিন্নমত। তাঁর কথায়, ‘ওদের নিয়ে অযথা বাড়াবাড়ি করা হচ্ছে। এটা তো ওদের কাজেরই অঙ্গ। আসলে এখন কেউ আর তাদের কাজটা করছে না। তাই এরা যখন নিজের কাজটা মন দিয়ে করছে, তখন সেটাকেও একটা বিশাল ব্যাপার মনে হচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ওদের বীরাঙ্গনা ইত্যাদি বলা হচ্ছে। আমি এর বিরোধী। একটা চাকরিকে কেন অযথা গৌরবাণ্বিত করতে যাব?’

তাঁকে বলা গেল না, তাঁর সিনিয়র এবং দিল্লিতে তিন দশকেরও বেশি সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন জয়ন্ত ঘোষাল বলেছেন, ‘এমন ঘটনা আমি এর আগে কখনও দেখিনি। সম্ভবত এখন সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে সাংবাদিকতা যে জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে, তার ফলেই আমাদের পেশার কোথাও কোথাও এই আগ্রাসন বা এই বিদ্রোহ জন্ম নিচ্ছে। উত্তরপ্রদেশের হিন্দি বলয়ে এমনিতেই সাংবাদিকতা করা কঠিন। সেখানে দু’টি নেহাতই বাচ্চা মেয়ে যে সাহস দেখিয়েছে, তেমনটা আমি অন্তত আমার ৩৫ বছরের সাংবাদিক জীবনে কখনও দেখিনি।’

এখন দেখছে। এখন শুনছে। নতুনের উন্মেষে জাগছে সারা দেশ। প্রথাভাঙা নতুন নক্ষত্রের জন্ম হচ্ছে দেশের আকাশে। তাঁদের অনেক পিছনে মিটমিট করছেন রাজনীতির তারকারা। খবর: আনন্দবাজার।

ভিডিও দেখতে এখানে ক্লিক করুন


সর্বশেষ সংবাদ