ভারতে সম্রাট আওরঙ্গজেবের সমাধি সরানো নিয়ে বিক্ষোভ-সংঘর্ষ, কারফিউ জারি
- টিডিসি ডেস্ক
- প্রকাশ: ১৮ মার্চ ২০২৫, ১১:৪৮ AM , আপডেট: ১৮ মার্চ ২০২৫, ১২:১০ PM

মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের সমাধি ভারতের মহারাষ্ট্র থেকে সরিয়ে নেওয়ার দাবিকে কেন্দ্র করে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মহারাষ্ট্রের নাগপুরে বেশ কয়েকটি এলাকায় কারফিউ জারি করেছে রাজ্য সরকার। আজ মঙ্গলবার (১৮ মার্চ) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি।
আওরঙ্গজেব ছিলেন ছয়জন মোগল সম্রাটের মধ্যে সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ সম্রাট। তার সমাধি মহারাষ্ট্রের সম্ভাজিনগর (আগে ছিল আওরঙ্গাবাদ) জেলার খুলদাবাদে অবস্থিত। বিজেপি নেতাদের পাশাপাশি কট্টর উগ্র হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলো বেশ কিছুদিন ধরেই তার সমাধিসৌধ সরানোর দাবি করে আসছিল।
এনডিটিভির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের সমাধি মহারাষ্ট্র থেকে সরিয়ে নেওয়ার দাবিকে কেন্দ্র করে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার পর নাগপুরের বেশ কয়েকটি এলাকায় কারফিউ জারি করা হয়েছে। ১৭ শতকের মহান এই সম্রাটের সমাধি আরঙ্গাবাদে অবস্থিত, যা বর্তমানে ছত্রপতি সম্ভাজিনগর জেলা নামে পরিচিত।
আরও পড়ুন: মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে বাংলাদেশ বিষয়ে প্রশ্ন, যা বললেন মুখপাত্র
এদিকে নাগপুরের পুলিশ কমিশনার রবীন্দ্র কুমার সিঙ্গাল ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতার ১৬৩ ধারার অধীন একটি নোটিশ জারি করেছেন। এতে বলা হয়েছে, কোতোয়ালি, গণেশপেঠ, তহসিল, লাকাদগঞ্জ, পাচপাওলি, শান্তিনগর, সক্করদারা, নন্দনবন, ইমামওয়াদা, যশোধরানগর এবং কপিলনগর থানা এলাকায় কারফিউ জারি থাকবে। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত এসব এলাকায় এই নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকবে।
পুলিশ কমিশনারের নোটিশ অনুসারে, কট্টর উগ্র হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠী বিশ্ব হিন্দু পরিষদ এবং বজরং দলের সমর্থকরা গতকাল নাগপুরের মহল এলাকায় শিবাজি মহারাজের মূর্তির কাছে জড়ো হয়ে মহারাষ্ট্র থেকে আওরঙ্গজেবের সমাধি অপসারণের দাবিতে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। এসময় তারা বিভিন্ন স্লোগান দেয় এবং আওরঙ্গজেবের ছবি এবং ‘ঘাসে ভরা সবুজ কাপড়ে মোড়া একটি প্রতীকী সমাধিও’ আগুনে পুড়িয়ে দেয়।
মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের সমাধি
প্রতিবেদন অনুসারে, সবুজ কাপড় পোড়ানোর ফলে ‘গুজব’ ছড়িয়ে পড়ে। কারণ অনেকে দাবি করে— এতে পবিত্র আয়াত লেখা ছিল, ফলে এলাকায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। নোটিশে বলা হয়েছে, গত সন্ধ্যায় একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের প্রায় ৮০ থেকে ১০০ জন হিংসাত্মক হয়ে ওঠে। পুলিশকে লক্ষ্য করে পাথর ছোড়া হয় এবং বেশ কয়েকটি গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। পুলিশ লাঠিচার্জ করে এবং টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। পরিস্থিতি বর্তমানে নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এবং নাগপুরের তিনবারের সংসদ সদস্য নীতিন গড়করি সবাইকে শান্ত থাকার আবেদন জানিয়েছেন এবং ‘গুজবে’ বিশ্বাস না করার জন্য জনগণকে অনুরোধ করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমি আপনাদের সকলকে আশ্বস্ত করছি, যারা ভুল করেছেন বা অবৈধ কার্যকলাপে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে সরকার ব্যবস্থা নেবে। মুখ্যমন্ত্রীকে ইতোমধ্যেই এই পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করা হয়েছে, তাই আমি সকলকে ‘গুজবে’ কান না দেওয়ার জন্য অনুরোধ করছি।’
সহিংসতার ঘটনায় মোট ৫০ জনকে আটক করা হয়েছে। এলাকায় নিরাপত্তা বাহিনী বিপুলসংখ্যক সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে।
আরও পড়ুন: গাজায় ফের ভয়াবহ হামলা ইসরায়েলের, নিহত ২০০
মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী ও বিজেপি নেতা দেবেন্দ্র ফড়নবিশ আইনশৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে পুলিশকে সহযোগিতা করার জন্য জনগণকে আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি নাগরিকদের ‘গুজবে’ বিশ্বাস না করার এবং আইন নিজের হাতে না নেওয়ার জন্যও আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘নাগপুর শান্তিপ্রিয় শহর এবং একে অপরের সুখ-দুঃখে অংশগ্রহণ করে। এমন পরিস্থিতিতে, কোনো ‘গুজবে’ বিশ্বাস করবেন না এবং প্রশাসনকে সহযোগিতা করুন।’
এনসিপির (শারদ পাওয়ার) লোকসভার সংসদ সদস্য সুপ্রিয়া সুলে বলেন, নাগপুরে সহিংসতা দুর্ভাগ্যজনক। এক্সে দেওয়া এক পোস্টে তিনি বলেন, ‘আমরা নাগরিকদের কাছে আবেদন করছি, দয়া করে কোনো ‘গুজবে’ বিশ্বাস করবেন না। আসুন আমরা সকলে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যের পরিবেশ বজায় রাখার জন্য একসাথে কাজ করি। এটি প্রগতিশীল ধারণার মহারাষ্ট্র। আসুন আমরা সকলে আমাদের রাজ্যের এই পরিচয় বজায় রাখার জন্য একসাথে কাজ করি।’
ভারতে সম্রাট আওরঙ্গজেবের সমাধি সরানো নিয়ে বিক্ষোভ-সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়েছে
এ ছাড়া কংগ্রেস নেতা পবন খেরা বলেছেন, নাগপুর তার অস্তিত্বের ৩০০ বছরে দাঙ্গার সম্মুখীন হয়নি। তিনি বলেন, ‘গত বেশ কয়েকদিন ধরে ৩০০ বছরের পুরনো ইতিহাসকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে বিভাজন, বিভ্রান্তি এবং অস্থিরতা তৈরি করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এই সংঘর্ষগুলো কেন্দ্র এবং রাজ্য উভয় ক্ষেত্রেই শাসকগোষ্ঠীর আদর্শের আসল চেহারা উন্মোচিত করে।’
সম্প্রতি, মারাঠা রাজা ছত্রপতি শিবাজি মহারাজের বংশধর ও বিজেপির সাতারা সংসদ সদস্য উদয়নরাজে ভোঁসলে সম্রাট আওরঙ্গজেবের সমাধিটি ভেঙে ফেলার দাবি করেন। তিনি বলেন, ‘কী প্রয়োজন... জেসিবি মেশিন পাঠিয়ে তার সমাধি ভেঙে ফেলা উচিত... তিনি ছিলেন একজন চোর এবং লুটেরা (ডাকাত)।’
এর আগে গত ৪ মার্চ বিজেপি নেতা নবনীত রানাও সম্রাট আওরঙ্গজেবের সমাধি ভেঙে ফেলার দাবি করেছিলেন। সাবেক এই বিজেপি সংসদ সদস্য বলেন, ‘আমি মহারাষ্ট্র সরকারকে অনুরোধ করতে চাই, ঠিক যেভাবে আওরঙ্গাবাদের নাম পরিবর্তন করে আমাদের ভগবান সম্ভাজি মহারাজের নামে রাখা হয়েছিল, তেমনই আওরঙ্গজেবের সমাধিও ভেঙে ফেলা উচিত।’
আরও পড়ুন: খ্রিস্টানদের অনুষ্ঠানে যাই, ইফতারেও অংশ নিই: মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
এরপর চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে আওরঙ্গজেবের সমাধি সরানোর এই দাবির প্রতি সমর্থন জানান রাজ্যটির মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফড়নবিশ। তবে সেসময় তিনি বলেন, এটি আইনের মাধ্যমেই করতে হবে। কারণ পূর্ববর্তী কংগ্রেস সরকার এই সমাধিসৌধটি আর্কেওলজিক্যাল সোসাইটি অব ইন্ডিয়ার (এএসআই) কাছে হস্তান্তর করেছিল এবং স্থানটি ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক সংস্থা কতৃক সুরক্ষিত।
প্রসঙ্গত, সম্রাট আওরঙ্গজেব ছিলেন ছয়জন মোগল সম্রাটের মধ্যে সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ সম্রাট। তিনি মারা গেছেন ৩০০ বছরেরও বেশি সময় আগে। ভারতকে ১৬৫৮ সাল থেকে ১৭০৭ সাল পর্যন্ত অর্ধ-শতাব্দী কাল ধরে শাসন করেছিলেন তিনি।